সম্পাদকীয় ২

নূতন পাঠ

ভারত কবে বিষয়টি লইয়া চিন্তা করিবে? এ দেশে উন্নত শিক্ষার অর্থ হইয়া দাঁড়াইয়াছে প্রযুক্তি-নির্ভর শিক্ষা। প্রধানমন্ত্রী সকল স্কুলে ডি়জিটাল বোর্ড দিবার প্রতিশ্রুতি দিয়াছেন।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ০০:৪৭
Share:

শিশুশিক্ষার প্রয়োজনীয়তা সংশয়াতীত। কিন্তু শিশুদের কেমন শিক্ষা প্রয়োজন, তাহা লইয়া বিতর্কের শেষ নাই। সম্প্রতি তথ্যপ্রযুক্তির বিশ্ব-রাজধানী ‘সিলিকন উপত্যকা’ হইতে নূতন চিন্তার রসদ মিলিয়াছে। অ্যাপল, গুগল, ইয়াহু প্রভৃতি সংস্থার শীর্ষ কর্তাদের সন্তানদের স্কুলে কম্পিউটার, ট্যাব, স্মার্টফোন সম্পূর্ণ বর্জিত হইয়াছে। খাতা-পেন্সিল, ব্ল্যাকবোর্ড, রঙিন কাগজ ও কাঁচি লইয়া ক্লাস চলিতেছে। পরস্পর আদানপ্রদানের মাধ্যমে শিখিতেছে শিশুরা। তাহাদের কল্পনা উসকাইবার, কৌতূহল বাড়াইবার কাজটি করিতেছে স্কুল। রেনেসাঁসের ইতিহাস পড়িলেই চলিবে না, সে-যুগের বিখ্যাত ছবির অনুকরণে আঁকিতে হইবে। সাহিত্যে শেক্সপিয়র পড়া যথেষ্ট নহে, তাহার নাটক করিতে হইবে। ধাতুর উপর তাপের প্রভাব বুঝিতে কাজ করিতে হইবে কামারশালায়। প্রযুক্তি-সারথিরা ডিজিটাল দক্ষতাকে শিক্ষার প্রধান উদ্দেশ্য বলিয়া মনে করিতেছেন না। পাঠ্যপুস্তকে লিখিত বিষয়কে প্রকৃতির কোলে অথবা ল্যাবরেটরিতে হাতে-কলমে রপ্ত করিলে তাহা সম্পূর্ণ আয়ত্ত হয়। একটি সমস্যার সমাধান অনুসন্ধানের মাধ্যমে গণিত বা জীববিজ্ঞানের তত্ত্ব শিখিলে তাহা আর পড়িবার বিষয় থাকে না, জানিবার বিষয় হইয়া উঠে। অনেকে মিলে একটি সমস্যার সমাধান বাহির করিবারও তালিম দিবে স্কুল। এই গুণগুলিই একবিংশ শতাব্দীর কর্মক্ষেত্রে প্রয়োজন।

Advertisement

ভারত কবে বিষয়টি লইয়া চিন্তা করিবে? এ দেশে উন্নত শিক্ষার অর্থ হইয়া দাঁড়াইয়াছে প্রযুক্তি-নির্ভর শিক্ষা। প্রধানমন্ত্রী সকল স্কুলে ডিজিটাল বোর্ড দিবার প্রতিশ্রুতি দিয়াছেন। অধিকাংশ প্রাথমিক স্কুলে যখন বিদ্যুৎ নাই তখন ডিজিটাল বোর্ড কী করিয়া কাজ করিবে, সেই প্রশ্ন তুলিয়াছেন অনেকে। কিন্তু যে প্রশ্নটি অধিক জরুরি তাহা হইল, ডিজিটাল বোর্ডের কী প্রয়োজন? এ দেশে শিক্ষকের পাঠদানের উদ্দেশ্য পাঠ্যক্রম শেষ করা। ছাত্ররা কী শিখিল, কোন দক্ষতা কতটা রপ্ত করিল, তাহা কতটা কাজে লাগাইল, এগুলির মূল্যায়নও জরুরি বলিয়া কেহ মনে করে না। তাই প্রাথমিক শিক্ষা শেষ হইয়া যায়, সরকারি স্কুলের ছাত্রেরা লিখিতে-পড়িতে, অঙ্ক কষিতে শেখে না। অপর দিকে নামীদামি বেসরকারি স্কুলে চলিতে থাকে তোতাকাহিনির পুনরভিনয়। বিপুল পাঠ্যক্রম, বিচিত্র ‘প্রজেক্ট’, বিরামহীন প্রতিযোগিতা দিয়া যে ভীতিময়, ক্লান্তিকর কার্যক্রম নির্মিত হয়, তাহা কেমন শিক্ষা?

এই শিক্ষা মুখস্থবিদ্যার উপর জোর দিয়া শিশুর অনুসন্ধানী মনকে নিঃশেষ করিয়া দেয়, পরস্পরকে সাহায্য করিবার স্বাভাবিক প্রবণতাকে প্রতিযোগিতার বিরোধী জ্ঞানে হেয় করে, উদ্ভাবনের উত্তেজনা অপেক্ষা গতানুগতিক সমাধানের নিশ্চয়তাকে অধিক নম্বর দেয়। ঊনবিংশ শতাব্দীর কারখানায় যন্ত্রের কাজ মানুষে করিত। তখন প্রশ্নহীন নির্দেশপালন ও নিয়মানুবর্তিতা ছিল শ্রমিকের প্রার্থিত গুণ। তাহাতে মানুষের কেমন অবনমন ঘটিত, তাহা চ্যাপলিন ‘মডার্ন টাইমস’ ছবিতে দেখাইয়াছেন। একুশ শতকে কৃত্রিম বুদ্ধিতে বলীয়ান যন্ত্র অতি দ্রুত, অতি সূক্ষ্ম সমস্যার সমাধান করিতেছে। এখন প্রয়োজন চিন্তার অভিনবত্ব, শক্তিশালী কল্পনা, কাজের নিজস্বতা। ঊনবিংশের শিক্ষায় তাহা সম্ভব নহে, বিংশ শতাব্দীর বিদ্যালয়ও তাহা দিতে পারিবে না। নূতন কর্মক্ষেত্র শিশুশিক্ষার নূতন অধ্যায় দাবি করিতেছে।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement