ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো পরস্পরের মুখোমুখি হলেন। ছবি: সংগৃহীত।
অনেক বিতর্ককে পাশ কাটিয়ে অবশেষে সাক্ষাৎ হল। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো পরস্পরের মুখোমুখি হলেন। ট্রুডোর ভারত সফর শুরু হওয়ার মুহূর্ত থেকে গুঞ্জন শুরু হয়েছিল যা নিয়ে, সেই শৈত্য লহমায় উধাও হয়ে গেল দুই নেতা মুখোমুখি হতেই। প্রধানমন্ত্রী মোদী তাঁর অতিপরিচিত অন্তরঙ্গ আলিঙ্গনে বাঁধলেন প্রধানমন্ত্রী ট্রুডোকে। দুই প্রধানমন্ত্রীর বৈঠক হল, একগুচ্ছ সমঝোতা হল, যৌথ বিবৃতি হল, সহাস্য তথা ‘ফিল গুড’ ফোটোফ্রেম তৈরি হল। আর গোটা ঘটনাপ্রবাহের মধ্যে দিয়ে এক অন্য ধাঁচের কূটনীতির আভাস মিলল।
কানাডার প্রধানমন্ত্রী যখন ভারত সফরে, তখন তিনি ভারতের অতিথি। আতিথেয়তায় কোনও ত্রুটি থাকা যে উচিত নয়, তা নিয়ে কোনও দ্বিমত নেই, বিশেষত অতিথি যখন বিদেশি রাষ্ট্রপ্রধান। প্রধানমন্ত্রী ট্রুডো বা তাঁর পরিবার অস্বাচ্ছন্দ্য বোধ করুন, এমন কোনও পরিস্থিতি নয়াদিল্লি তৈরি হতে দেয়নি। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী মোদীর যে উচ্ছ্বসিত উষ্ণতা দেখতে বৈদেশিক রাষ্ট্রপ্রধানরা অভ্যস্ত, ট্রুডোর ক্ষেত্রে গোড়া থেকে তেমনটা ঘটেনি।
কূটকৌশলটা এইখানেই। সন্ত্রাসের সঙ্গে ভারত যে আপস করবে না বিন্দুমাত্র, সে কথা অত্যন্ত স্পষ্ট উচ্চারণে একাধিকবার গোটা বিশ্বকে জানিয়েছে নয়াদিল্লি। কোনও আন্তর্জাতিক সমীকরণ বা কোনও বৈদেশিক সম্পর্কই যে নয়াদিল্লির কাছে ভারতের অখণ্ডতা, ভারতের সার্বভৌমত্ব, ভারতের জাতীয় নিরাপত্তার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ নয়, সে বার্তাও একাধিকবার দেওয়া হয়েছে। কানাডার প্রধানমন্ত্রীকে আরও একবার সেই বার্তাটা দেওয়া জরুরি ছিল সম্ভবত। কানাডার মাটিতে পঞ্জাবের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের অবাধ গতিবিধি নিয়ে ভারত আগেও উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী ট্রুডোর সঙ্গে খলিস্তানপন্থীদের ওঠাবসা তাতে বন্ধ হয়েছে, এমন নয়। কানাডার ভূখণ্ডে খলিস্তানপন্থীদের বাড়বাড়ন্ত রুখতে হবে— নয়াদিল্লির এই বার্তা যে স্রেফ কথার কথা নয়, এই বার্তাকে যে গুরুত্ব দিতেই হবে, সে কথা প্রধানমন্ত্রী ট্রুডোকে আরও একটু স্পষ্ট করে বুঝিয়ে দেওয়া জরুরি ছিল অতএব। তার জন্য ট্রুডোর ভারত সফরের চেয়ে ভাল অবকাশ আর কিছুই হতে পারত না সম্ভবত। আতিথেয়তায় ত্রুটি রাখেনি ভারত, কিন্তু উচ্ছ্বাসের রাশটা টেনে ধরা হয়েছিল কিয়ৎ প্রথম কয়েকদিনের জন্য। জরুরি কথাগুলো অনুচ্চারেই বুঝিয়ে দেওয়া গিয়েছে সেই কৌশলে।
আরও পড়ুন: উপেক্ষার পর অবশেষে ট্রুডোকেও আলিঙ্গন
কানাডার প্রধানমন্ত্রী ভারতের সার্বভৌমত্ব বা অখণ্ডতার প্রতি অশ্রদ্ধা নিয়ে ভারতের মাটিতে পা রেখেছিলেন, এমন কিন্তু নয়। ভারত এবং ভারতীয়ত্বের প্রতি পূর্ণ শ্রদ্ধা, সম্মান এবং উৎসাহ নিয়েই এ দেশে এসেছিলেন সপরিবার ট্রুডো। কানাডা হাউসে তিনি ভাঙড়া নেচেছেন, অমৃতসরে স্বর্ণমন্দিরে গিয়ে করসেবা করেছেন, ভারতীয় পোশাক আপন করে নিয়েছেন। মৈত্রীর বার্তা দেওয়ার এই ভঙ্গি অবশ্যই প্রশংসনীয়। তবে খলিস্তান কাঁটার নেতিবাচকতা সেই প্রশংসনীয় ভঙ্গিকে ছাপিয়ে যায়।
যশপাল অটওয়ালের মতো কুখ্যাত খলিস্তানপন্থী জঙ্গিকে ভারত সফররত ট্রুডোর পাশে দেখা যাওয়া মোটেই কোনও ইতিবাচক ছবি নয়। তাই ভারত এবং ভারতীয়ত্বের প্রতি ট্রুডোর শ্রদ্ধা প্রদর্শনের সব ছবি ম্লান হয়ে যায় তাঁর আশপাশে যশপাল অটওয়ালকে দেখা যেতেই।
সম্পাদক অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা আপনার ইনবক্সে পেতে চান? সাবস্ক্রাইব করতে ক্লিক করুন
বার্তাটা ট্রুডোকে গোড়া থেকেই দেওয়া শুরু হয়েছিল। মোদী গোড়ায় মুখ ফিরিয়ে রেখেছিলেন কানাডার প্রধানমন্ত্রীর দিক থেকে। কিন্তু অমৃতসরে কানাডার প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন পঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী ক্যাপ্টেন অমরেন্দ্র সিংহ। খলিস্তানি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের যে প্রশ্রয় দেওয়া যাবে না, অমৃতসরে বসেই সে বিষয়ে ট্রুডোর আশ্বাস আদায় করে নিয়েছিলেন ক্যাপ্টেন। সফরের শেষ পর্বে মোদীও একই বার্তা দিলেন ট্রুডোকে। পঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী যাদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপের দাবি তুলেছিলেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রীও তাদের বিরুদ্ধেই নয়াদিল্লির কঠোর অবস্থানের কথা আরও স্পষ্ট করে জানিয়ে দিলেন। রাজনৈতিক শিবির ভিন্ন হওয়া সত্ত্বেও জাতীয় স্বার্থে ক্যাপ্টেন ও মোদী যে একই সুরে কথা বলেন ভারতে, খলিস্তানপন্থীদের প্রতি কানাডার বিন্দুমাত্র সহানুভূতিও যে ভারতের কোনও রাজনৈতিক শিবিরের কাছেই কাম্য নয়, সে বার্তা বেশ মজবুত ভঙ্গিতে উপস্থাপন করা গেল ট্রুডোর সামনে। এই অন্য ধারার কূটনীতি, এই জাতীয় সংহতির ছবি প্রশংসার দাবি রাখে।