বিধানসভা নির্বাচনে তেলঙ্গানার মুখ্যমন্ত্রী কে চন্দ্রশেখর রাও-এর মস্ত সাফল্যের অন্যতম কারণ নাকি ‘রায়তু বন্ধু যোজনা’। অনেকেই বলছেন, চাষিকে বাঁচাতে ফসলের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য দেওয়া, আর কৃষিঋণ মকুব করার দিন শেষ। এখন কেসিআর-এর পথেই এগোতে হবে। মোদীও নাকি সেই পথ নেওয়ার কথা চিন্তা করছেন।
কী সেই পথ? সহায়ক মূল্য বা ঋণ মকুব, কোনওটারই স্থান নেই রায়তু (কৃষক) বন্ধু যোজনায়। বদলে তেলঙ্গানার প্রতিটি চাষিকে একর প্রতি চার হাজার টাকা অনুদান দিচ্ছে তেলঙ্গানা সরকার। বছরে চাষের মরসুম দু’টি, তাই একর প্রতি চাষি বছরে পাচ্ছেন আট হাজার টাকা। কী ফসল চাষ হচ্ছে, তা দেখা হয় না। ছোট চাষি ও বড় চাষির অনুদানে হেরফের করা হয় না। শুধু দেখা হয়, চাষির নামে জমির নথিপত্র আছে কি না।
জমির নথির ভিত্তিতে অনুদান, তাই ২০১৭ সালে তেলঙ্গানার সমস্ত জেলায়, সমস্ত ব্লকে জরুরি ভিত্তিতে জমির সমীক্ষা করা হয়েছে। অন্য দিকে জমি ঠিকা বা ‘লিজ়’ নিয়ে যাঁরা চাষ করেন, সেই চাষিদের চিহ্নিত করা হয়েছে। কোন জমিতে মালিকানার বিবাদ আছে, আদালতে মামলা ঝুলছে, তাও চিহ্নিত করা হয়েছে। চাষিদের নতুন করে পাট্টাদার পাসবুক দেওয়া হয়েছে। এর সুবিধে অনেক। প্রথমত ন্যূনতম কৃষি মূল্য বা কৃষি ঋণ মুকুব, দুটোই ফসল ওঠার পরের ঘটনা। চাষির টাকার প্রয়োজন চাষের আগে। দ্বিতীয়ত সবাই জানে যে ন্যূনতম সহায়ক মূল্য একটা বাজারি কৌশল। সরকার ফসল ওঠার ঠিক পরেই বাজার থেকে অনেকটা ফসল ন্যায্য দামে কিনে নিলে বাজারে ফসলের দাম বেড়ে যায়। চাষিরা তখন বাজার থেকে ন্যায্য দাম পেতে পারেন। কিন্তু, কতটা কিনলে বাজারে সত্যি ফসলের দাম বাড়ে? কতটা বাড়ে? সরকার বর্ধমানে ফসল কিনলে উত্তর দিনাজপুরে সেই ফসলের দাম বাড়ে কি? এগুলোর উত্তরের উপরেই চাষির ন্যায্য দাম পাওয়া নির্ভর করে, অথচ প্রতিটা উত্তরই অনিশ্চিত। ‘ন্যায্য দাম’ কী করে নির্ধারিত হবে, সে বিতর্ক তো আছেই।
প্রশ্ন সরকারি পরিকাঠামো নিয়েও। সরকার ততটাই কিনতে পারে যতটা গুদামজাত করতে পারে। গুদামে কত দিন ফসল মজুত সম্ভব তাও দেখতে হয়। পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজ্যে যে ধান আর পাট ছাড়া প্রায় কোনও ফসল সহায়ক মূল্যে কেনা হয় না, তার কারণ সেই সব ফসল কেনা, মজুত বা বণ্টনের পরিকাঠামো তৈরি নেই।
ঋণ মকুব জটিলতর ব্যাপার। কবে মকুব হবে, কতটা হবে, কোন চাষিদের মকুব হবে, ফের চাষের আগে ঋণ পাওয়া যাবে কি না, সে প্রশ্ন থেকেই যায়। সহায়ক মূল্য আর ঋণ মকুব, এই দুইয়ের চক্করে চাষি, বিশেষত প্রান্তিক, ছোট ও মাঝারি চাষি যে বিপন্ন, সেটা আজ আর কোনও নতুন কথা নয়।
রায়তু বন্ধু সে তুলনায় সহজ-সরল এক ব্যবস্থা। ফসল ওঠার পরে নয়, মরসুমের গোড়াতেই ‘কৃষি অনুদান’ পাচ্ছেন চাষি। জমির পরিমাণ অনুযায়ী টাকা বেশি-কম হলেও, সব চাষি সমান হারে টাকা পাচ্ছেন। চাষি ইচ্ছেমতো ফসল বুনছেন। সরকার কোন ফসল সহায়ক মূল্যে কিনবে, তা চিন্তা করে চাষ করতে হচ্ছে না। সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ হল সহায়তার সময়। চাষি অনুদান পাচ্ছেন চাষের মরসুমের একেবারে গোড়ায়। সরকারের আন্দাজ ছিল, মরসুমের শুরুতে চাষির হাতে টাকা এলে তা চাষের কাজেই লাগবে। দেখা গিয়েছে, সত্যিই তাই। একটি আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থা সমীক্ষায় দেখেছে, বিরাশি শতাংশ চাষি ঠিক সময়ে টাকা পেয়েছেন, এবং উনআশি শতাংশ চাষি সেই টাকা চাষের কাজেই লাগিয়েছেন। তেলঙ্গানা সরকার এই প্রকল্পে বারো হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করেছিল। পঞ্চাশ লক্ষের উপরে চাষি ঠিক সময়ে টাকা পেয়েছেন। নির্বাচনের এর প্রভাব পড়বে আশ্চর্য কী।
তবে কিছু প্রশ্ন থেকেই যায়। প্রথমত ঠিকা চাষিরা এই প্রকল্পের বাইরে রয়ে গেলেন। তাঁরা চাষিদের তিন ভাগের একভাগ। শুধু তা-ই নয়। মুম্বইয়ের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, আত্মহত্যা করেছেন যে চাষিরা, তাঁদের চার জনের তিন জনই ঠিকা চাষি। এই সমস্যা তেলঙ্গানা রাজ্যে যথেষ্ট গুরুতর। অবিভক্ত অন্ধ্রপ্রদেশে ঠিকা চাষিদের জন্য একটা আইন হয়েছিল যাতে বলা হয়েছিল, ঠিকা চাষিরা সরকারি পরিচয়পত্র পাবেন, যার ভিত্তিতে ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ পাবেন। তেলঙ্গানায় সেই কাজটা সফল হয়নি। পাঁচ লক্ষ ঠিকা চাষির লক্ষ্যমাত্রা স্থির হলেও, পঞ্চাশ হাজার চাষিও পরিচয়পত্র পাননি। অথচ অন্ধ্রপ্রদেশের পরে, তেলঙ্গানার চাষিরা দেশের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বাধিক ঋণী। রাজ্যের উননব্বই শতাংশ চাষি ঋণে ডুবে আছেন। ভারতের গড় বাহান্ন শতাংশ। এই প্রকল্প চাষিদের ঋণ কমাবে কি না, সে প্রশ্নও থাকছে।
থাকছে ধনী-দরিদ্রের অসাম্যের প্রশ্নও। তেলঙ্গানায় জমির মালিকানার চেহারা পশ্চিমবঙ্গের মতো নয়, বড় চাষির সংখ্যা অনেক। যদি প্রকল্পে জমির ঊর্ধ্বসীমা না থাকে, বড় চাষিরা প্রকল্পের সুবিধা বেশি পাবেন। তিন শতাংশ চাষি প্রকল্পের প্রায় আঠারো শতাংশ টাকা পাচ্ছেন। সরকারি ব্যয়ও কম নয়। বারো হাজার কোটি টাকা তেলঙ্গানার বাজেটের আট শতাংশ। কেসিআর নাকি অনুদানের পরিমাণ বাড়াচ্ছেন। তা হলে রাজ্য বাজেটের অন্তত দশ শতাংশ চাষিকে অনুদানের পিছনেই যাবে। পরিকাঠামোর উন্নয়নের জন্য যথেষ্ট খরচ হবে কি?
থাকছে রাজনৈতিক প্রশ্নও। অনুদান পেয়ে আজ চাষি খুশি। কিন্তু কাল উৎপাদন বেশি হলে, কিংবা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে ফসল নষ্ট হলে বাজার পড়বে। তখন চাষি যে ঋণ মকুব বা সহায়ক মূল্যের দাবি তুলবেন না, তার নিশ্চয়তা কী? কেসিআর-এর বিকল্প কৃষিনীতি একটা দান জিতিয়েছে। শেষ পর্যন্ত বাজিমাত হয় কি না, সেটাই দেখার।
আজিম প্রেমজি বিশ্ববিদ্যালয়ে ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ়-এর শিক্ষক