উত্তরাধিকার: ভারতীয় সংবিধানে স্বাক্ষর করছেন দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু, ১৯৫১।
১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর গণপরিষদ এক সুদীর্ঘ লিখিত নথিতে সঙ্কলিত একগুচ্ছ নীতি গ্রহণ করেছিল, যে নীতিমালা সাত দশক ধরে ভারতের রাজনৈতিক গতিপথ নির্ধারণ করেছে। সেই সংবিধানে বিধৃত যুক্তরাষ্ট্রের আনুষ্ঠানিক সূচনা হয় ১৯৫০ সালের ২৬ জানুয়ারি। মাত্র ১২ শতাংশ মানুষ সাক্ষর— এমন একটি দেশে সমস্ত প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিককে ভোটাধিকার দেওয়ার সিদ্ধান্তই ছিল এই সংবিধানের সবচেয়ে সুদূরপ্রসারী নীতি। সংবিধানের প্রস্তুতি কমিটির চেয়ারম্যান সম্পর্কে রাজনীতিকরা কাঁড়ি কাঁড়ি গালভরা প্রশস্তি উচ্চারণ করেছেন। কিন্তু বি আর অম্বেডকরের যে সৃষ্টিশীল বিচারবুদ্ধি ছিল, তার যথাযথ প্রয়োগে দেশের সংসদীয় গণতন্ত্রের মান যতটা উন্নত হতে পারত, সেই পথে চলার চেষ্টা তাঁরা করেননি।
অম্বেডকর গণপরিষদে প্রথমে নির্বাচিত হয়েছিলেন অবিভক্ত বাংলা থেকে, যশোর ও খুলনার প্রতিনিধি হিসেবে। এতে প্রধান ভূমিকা নিয়েছিলেন যোগেন মণ্ডলের নেতৃত্বে তফসিলি জাতির নেতারা। অতঃপর বাংলার ওপর দেশভাগের খাঁড়া এসে পড়ল, যশোর এবং খুলনার আসনটি চলে গেল পাকিস্তানের গণপরিষদে। এর পরেই, ১৯৪৭ সালের জুলাই মাসে বম্বে প্রদেশের একটি আসন থেকে সরে দাঁড়ালেন এম আর জয়াকর, সেই আসনে গণপরিষদে পুনর্নির্বাচিত হলেন অম্বেডকর।
এ দেশের পরম সৌভাগ্য— ১৯৪৬ সালের ৯ ডিসেম্বর থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পাঁচটি বছর ‘দলিত শ্রেণি’-র নেতা অম্বেডকরের মতো মূলধারার জাতীয়তাবাদের এক জন কঠোর সমালোচক জাতির প্রয়োজনে বিনিয়োগ করেছিলেন তাঁর প্রবল মেধা। ১৯৫১ সালের ১২ অক্টোবর আইনমন্ত্রী অম্বেডকর হিন্দু কোড বিল সংস্কারের বিরুদ্ধে রক্ষণশীলদের অবস্থানের প্রতিবাদে নেহরুর মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেন। আজকের ভারতে যখন শাসকরা সংখ্যালঘুদের নানা দিক থেকে ছেঁটে ফেলতে চাইছে, তখন বিশেষ ভাবে স্মরণীয় সংখ্যালঘু সুরক্ষার প্রশ্নে অম্বেডকরের কথাগুলি: ‘‘যে কট্টরপন্থীরা সংখ্যালঘুর সুরক্ষার বিরুদ্ধে এক ধরনের মতান্ধ অবস্থান নিয়েছেন, তাঁদের উদ্দেশে আমি দুটি কথা বলতে চাই। প্রথমত, সংখ্যালঘুরা এক বিস্ফোরক শক্তি, যার বিস্ফোরণ ঘটলে রাষ্ট্রের গোটা কাঠামোটাই তছনছ হয়ে যেতে পারে। দ্বিতীয়ত, ভারতের সংখ্যালঘুরা তাঁদের অস্তিত্ব সংখ্যাগুরুদের হাতে ন্যস্ত করতে সম্মত হয়েছেন... তাঁরা সংখ্যাগুরুর শাসন স্বীকার করে নিয়েছেন— যে সংখ্যাগুরু চরিত্রে রাজনৈতিক নয়, যা আসলে ধর্মপরিচয়ের ভিত্তিতে তৈরি। সংখ্যাগুরুদেরই বুঝতে হবে যে, সংখ্যালঘুর বিরুদ্ধে কোনও পক্ষপাতিত্ব না করাই তাঁদের কর্তব্য।’’
এই ভাষণেই অম্বেডকর সেই সমালোচকদেরও জবাব দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন যাঁদের অভিযোগ ছিল, ‘‘খসড়া সংবিধানটিতে নতুন কিছুই নেই, এর অর্ধেকটা ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন থেকে টুকে দেওয়া হয়েছে, আর বাকিটা নেওয়া হয়েছে অন্য নানা দেশের সংবিধান থেকে।’’ অম্বেডকর বললেন যে, তিনি ঋণ নিয়েছেন, চুরি করেননি। এটা তাঁরও আক্ষেপের কারণ যে, ১৯৩৫-এর ভারত শাসন আইন থেকে প্রধানত প্রশাসনিক খুঁটিনাটির ব্যাপারগুলি নেওয়া হয়েছে। ভারতের পরিস্থিতিতে এগুলো রাখা দরকার। এই প্রসঙ্গেই অম্বেডকর সাংবিধানিক নৈতিকতার ধারণাটি উল্লেখ করেন। বুঝিয়ে বলেন, ১৯৪০-এর দশকের শেষভাগের সেই ভারতে ‘‘সাংবিধানিক নৈতিকতা স্বাভাবিক ধারণা হিসেবে প্রচলিত বা স্বীকৃত নয়, তার অনুশীলন আবশ্যক। আমাদের বুঝতে হবে যে, এই ধারণাটি এখনও আমাদের দেশের মানুষের রপ্ত হয়নি।’’
এর পরে একটি বিতর্কিত কথা বলেছিলেন তিনি: ‘‘ভারতে গণতন্ত্র ব্যাপারটা মাটির উপরিভাগে ছড়ানো, মাটিটা মূলত অ-গণতান্ত্রিক।’’ আজকের ভারতে এমন কথা বললে হয়তো তাঁকে অ্যান্টি-ন্যাশনাল বলে দাগানো হবে। কিন্তু একটা পরিণত গণতন্ত্রের উচিত এই মন্তব্যটি বিচার করে দেখা, সাংবিধানিক নৈতিকতার মূল্যকে স্বীকৃতি দেওয়া। সাংবিধানিক নৈতিকতার ধারণাটি কেমন? গ্রিসের ইতিহাসবিদ গ্রোট যাকে ‘দলীয় প্রতিদ্বন্দ্বিতার তিক্ততা’ বলেছেন, সেই তিক্ততা অতিক্রম করে বিভিন্ন মতের পারস্পরিক বোঝাপড়া ও বিচার এবং মতানৈক্য নিরসনের পদ্ধতিগুলির প্রতি শ্রদ্ধাময় অনুশীলনই সেই নৈতিকতার গোড়া। গণপরিষদের আর এক বাগ্মী সদস্য জ়য়রুল-হাসান লারি খেয়াল করিয়ে দিয়েছিলেন, সাংবিধানিক নৈতিকতার শিক্ষা গ্রহণের প্রয়োজন কেবল নাগরিকদের নয়, সরকারকেও তা শিখতে হবে। কিছু করার ক্ষমতা থাকলেই সরকারের সেটা করা উচিত, এমন নয়। সংবিধানের শব্দমাত্র নয়, তার অন্তর্নিহিত আদর্শই যেন সরকারকে চালনা করে, তাকে নিয়ন্ত্রণ করে।
বিবেকবুদ্ধির স্বাধীনতা, সংখ্যালঘুর সুরক্ষা, সাংবিধানিক নৈতিকতা বিষয়ে অম্বেডকরের গভীর অন্তর্দৃষ্টি ছিল। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের প্রশ্নে তাঁর, এবং গণপরিষদের অন্য সদস্যদের চিন্তায় খামতি ছিল। সংবিধান রচিত হয়েছিল দেশভাগ-উত্তর পরিবেশে। কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে অতিরিক্ত ক্ষমতা দেওয়ার বিরোধিতা যাঁরা করতেন, মুসলিম-প্রধান প্রদেশগুলির বিদায় বা বিভাজনের ফলে তাঁদের গলার জোর কমে গেল। অম্বেডকর স্বীকার করেছিলেন যে, এই সংবিধান মার্কিন সংবিধানের মতো নিখাদ যুক্তরাষ্ট্রীয় ছাঁচে ঢালা নয়। বলেছিলেন, ভারতীয় সংবিধান ‘‘সময় এবং অবস্থা অনুসারে এককেন্দ্রিক এবং যুক্তরাষ্ট্রীয়, দু’রকম চরিত্রই ধারণ করতে পারে। এই সংবিধান স্বাভাবিক অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার উপযোগী। কিন্তু এটি এমন ভাবে তৈরি হয়েছে, যাতে যুদ্ধপরিস্থিতিতে তা এককেন্দ্রিক শাসনতন্ত্র হিসেবে কাজ করতে পারে।’’ তিনি আরও বলেছিলেন, ‘‘সংবিধানের ২৭৫ ধারার বলে রাষ্ট্রপতি (জরুরি অবস্থা) ঘোষণা করলে ছবিটা পাল্টে যেতে পারে এবং রাষ্ট্র হয়ে উঠতে পারে এককেন্দ্রিক।’’ পরবর্তী ইতিহাস দেখিয়েছে, জরুরি অবস্থার বন্দোবস্তের সুযোগে যুক্তরাষ্ট্রীয়তা ও গণতন্ত্র, দুটিকেই গ্রাস করতে পারে স্বৈরতন্ত্র। ভারতীয় সংবিধানের মৌলিক অধিকারও আমেরিকার ‘বিল অব রাইটস’-এর মতো অলঙ্ঘ্য নয়।
ভারতীয় সংবিধানের আদর্শের সঙ্গে তার কিছু অংশের যে বিরোধ, তার একটা বড় কারণ এই সংবিধানের ঔপনিবেশিক উত্তরাধিকার। এখন দেশ জুড়ে সংবিধানের ‘প্রস্তাবনা’ পাঠ করা হচ্ছে। উত্তরণের যে মহান আদর্শ এই প্রস্তাবনাটিতে নিহিত, সংবিধানের কিছু অনুচ্ছেদে ঔপনিবেশিক স্বৈরবাদের উত্তরাধিকার কিন্তু তার পরিপন্থী। ঔপনিবেশিক ভারতে আইনের শাসনের মধ্যেই রাষ্ট্রের হাতে জরুরি অবস্থার বিশেষ ক্ষমতা তুলে দেওয়া হয়েছিল। ভারত রক্ষা আইন ও বিধিতে এই ক্ষমতা পুরো মাত্রায় বহাল ছিল। সেই ক্ষমতার বলেই জালিয়ানওয়ালাবাগের নৃশংস হত্যাকাণ্ড ঘটেছিল। ওই আইনের নাম করে সেই পৈশাচিকতার পক্ষে ‘যুক্তি’ও খাড়া করা হয়েছিল! উপনিবেশবাদ ও আইনের শাসন বিষয়ে নাসের হুসেনের গবেষণা দেখিয়েছে, ‘‘আইন ও জরুরি অবস্থার ধারণা এবং অনুশীলন কী ভাবে ঔপনিবেশিক ও জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্রের শাসনে একই ধারায় চলে এসেছে।’’
এই ফাঁক দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রীয়তা ও গণতন্ত্রের যে বিপদ তৈরি করে রাখা হল, গণপরিষদের কোনও সদস্যই কি তার আভাস পাননি? কয়েক জন পেয়েছিলেন। কিন্তু তাঁদের প্রস্তাবিত দূরদর্শী সংশোধনীগুলি সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের ভোটে নাকচ হয়ে গিয়েছিল। এই প্রসঙ্গে হরি বিষ্ণু কামাথ-এর কথা বলতে হয়। কামাথ স্বাধীনতা সংগ্রামে সুভাষচন্দ্র বসুর ঘনিষ্ঠ সহযোগী ছিলেন। ১৯৪৯ সালের ২ অগস্ট তিনি গণপরিষদের বিতর্কে বলেছিলেন: ‘‘আমি দুনিয়ার— রাজতন্ত্রের ও প্রজাতন্ত্রের অনুসারী— অধিকাংশ গণতান্ত্রিক দেশের সংবিধান তন্ন তন্ন করে দেখেছি, জরুরি অবস্থা সংক্রান্ত এই ব্যবস্থাগুলির তুলনীয় কিছু কোথাও পাইনি। আমার মতে এর সবচেয়ে কাছাকাছি দৃষ্টান্ত হল থার্ড রাইখ-এর ওয়াইমার সংবিধান, যেখানে ঠিক এই ধরনের বিশেষ ব্যবস্থার সুযোগ ছিল, যে সুযোগ কাজে লাগিয়ে হিটলার সেই সংবিধানকেই ধ্বংস করেন।’’
প্রস্তুতি কমিটিতে অম্বেডকরের সহকর্মী টি টি কৃষ্ণমাচারি ওয়াইমার সংবিধানের সঙ্গে এই তুলনাকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেন। কামাথ বলেন, ওয়াইমার সংবিধানের ব্যবস্থাগুলি কাজে লাগিয়ে হিটলার কী ভাবে একনায়কতন্ত্র কায়েম করেছিলেন, তিনি সেটাই বলতে চেয়েছেন। অম্বেডকর জানিয়ে দেন, এই নিয়ে ‘বিস্তর সময়’ ব্যয় করা হয়েছে, ‘‘কামাথের প্রশ্নের আর উত্তর দেওয়ার দরকার নেই, কৃষ্ণমাচারি আগেই তাঁর বক্তব্যের উত্তর দিয়েছেন।’’ গণপরিষদে প্রস্তাব হয় যে, ‘‘যুদ্ধ বা বাইরের আগ্রাসনের কারণেই হোক, কিংবা অভ্যন্তরীণ গোলযোগেই হোক, দেশের নিরাপত্তা যদি বিপন্ন হয়’’ বা রাষ্ট্রপতি যদি মনে করেন ‘‘বিপদের আশঙ্কা ঘনিয়েছে’’, জরুরি অবস্থা ঘোষিত হতে পারে।
পরের দিন ২৭৭-ক অনুচ্ছেদ নিয়ে বিতর্কে কামাথ আবার যুক্তরাষ্ট্রীয়তাকে রক্ষা করার জন্য সওয়াল করেন। কে টি শাহ, শিব্বুন লাল সাক্সেনা, হৃদয়নাথ কুঞ্জরু, রেণুকা রায় এবং বিশ্বনাথ দাসের মতো কয়েক জন সদস্য তাঁকে সমর্থন করলেন। কিন্তু তাঁরা ভোটে হেরে যান। ‘প্রকৃত গণতন্ত্রের ভিত্তি’ স্থাপনের জন্য কামাথের আবেদন অরণ্যে রোদনের শামিল হয়। অম্বেডকর স্বীকার করেন, ‘‘আমি এ কথা সম্পূর্ণ অস্বীকার করছি না যে, রাজনৈতিক উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে অনুচ্ছেদগুলি প্রয়োগের বা অপব্যবহারের একটা সম্ভাবনা থেকে যায়... (তবে) আমাদের আশা রাখা উচিত যে, এ ভাবে অনুচ্ছেদগুলি কখনওই প্রয়োগ করা হবে না।’’ নেহাতই আশার বাণী— যা পরে ভুল প্রমাণিত হবে।
শরৎচন্দ্র বসু ১৯৫০ সালে ইন্ডিয়ান ল রিভিউ-তে একটি প্রবন্ধে লিখেছিলেন, সংবিধানের যে অষ্টাদশ অধ্যায়টি রাষ্ট্রপতিকে জরুরি অবস্থাকালীন বিশেষ ক্ষমতা দিয়েছে, তার সঙ্গে ১৯৩৫-এর ভারত শাসন আইনের ৪২, ৪৩ ও ৪৫ অনুচ্ছেদের সাদৃশ্য আছে। এই বিশেষ ক্ষমতা সম্পর্কে তাঁর মন্তব্য ছিল: এটি একটি ‘টাইম-বোমা’। এরই ফলে ১৯৭৫ সালে জরুরি অবস্থার সময়ে জীবন এবং স্বাধীনতার মৌলিক অধিকার সাময়িক ভাবে নাকচ করা যায়। এরই ফলে আদালত হেবিয়াস কর্পাস (বন্দিকে আদালতে হাজির করানোর নির্দেশ)-এর আবেদন মঞ্জুর করতে পারেনি। প্রসঙ্গত, জরুরি অবস্থার সময় হেবিয়াস কর্পাস নিষ্ক্রিয় রাখা যাবে, সংবিধানের এই অনুচ্ছেদটি ১৯৪৯ সালের ২০ অগস্ট গৃহীত হওয়ার পরে কামাথ বলেছিলেন, ‘এই দিনটা দুঃখের এবং লজ্জার’— ‘ঈশ্বর ভারতবাসীর সহায় হোন।’
জরুরি অবস্থার সময়ে শাসনতন্ত্রে যে সব ভয়ানক পরিবর্তন ঘটানো হয়েছিল, পরবর্তী কালে সংবিধানের ৪৩তম সংশোধনীতে তার কয়েকটি বাতিল করে পূর্বাবস্থা ফিরিয়ে আনা হয়। কিন্তু ঔপনিবেশিক আমলের উত্তরাধিকার হিসেবে পাওয়া বিশেষ ক্ষমতাগুলির বেশির ভাগই আইনের কেতাবে থেকে গেল। যেমন, উনিশ শতক থেকে চলে আসা ভারতীয় দণ্ডবিধির ১২৪ক অনুচ্ছেদ— রাষ্ট্রদ্রোহ আইন। কেউ সরকারের বিরুদ্ধাচরণ করলে তাকে ‘অ্যান্টি-ন্যাশনাল’ বলে দাগিয়ে দেওয়ার জন্য এই আইন প্রয়োগ করার ফলে ভারতের ধারণাটির যে পরিমাণ ক্ষতি করা হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই।
উপনিবেশ-উত্তর কেন্দ্রীভূত রাষ্ট্রকে বৈধতা দেওয়ার জন্য যে ধর্মনিরপেক্ষতা এবং সমাজতন্ত্রের যুক্তি ব্যবহার করা হত, এক সময় তার জোর কমে গেল। তখন বিভিন্ন আঞ্চলিক ও নিম্নবর্গীয় প্রতিস্পর্ধাকে দমন করে কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রশক্তির আধিপত্য প্রতিষ্ঠার জন্য প্রথমে প্রচ্ছন্ন ভাবে এবং ক্রমে খোলাখুলি হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠতার রাজনীতিকে কাজে লাগানো হল। এই প্রবণতাই চরমে পৌঁছল ২০১৪ এবং ২০১৯ সালে বিজেপির জয়লাভে এবং মোদীর প্রধানমন্ত্রিত্বে। গত কয়েক বছর ধরে সংবাদমাধ্যম এবং বিচারবিভাগ সহ বিভিন্ন গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলির ওপর বিরামহীন আক্রমণ চলছে। ১৯৭৭ সালে ঘোষিত জরুরি অবস্থার অবসান ঘটানো গিয়েছিল। কিন্তু গণতান্ত্রিক নির্বাচনে বিজয়ী একাধিপত্যবাদী নায়ক এবং তার পাশাপাশি হিন্দুত্বের সংগঠিত শক্তি দুনিয়ার বৃহত্তম গণতন্ত্রকে যে বিপদের সামনে ফেলেছে, সেটা সত্তরের দশকের জরুরি অবস্থার চেয়েও ভয়ানক।
ভারতীয় সংবিধানের প্রণেতারা এই নথিটিকে দেখেছিলেন এক সজীব সত্তা হিসেবে, যা ভবিষ্যতে পরিবর্তনশীল প্রয়োজনের মোকাবিলা করতে পারবে। তাঁরা ভাবতে পারেননি, প্রবল সংসদীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে সংবিধানের শব্দগুলিকে কাজে লাগিয়েই তার আদর্শ বিনাশ করার চেষ্টা চলতে পারে। গণপরিষদ সংসদের হাতে সংবিধান সংশোধনের যে ক্ষমতা দিয়েছিলেন, তার জোরে সংসদ নিজেই অংশত সংবিধান রচয়িতা হিসেবে বহাল থেকেছে। সংবিধান সংসদকে আইন প্রণয়ন করে সংবিধানের নির্দেশ পরিপূরণের ক্ষমতাও দিয়েছে। এই ক্ষমতা কাজে লাগিয়েই ১৯৫৬ সালে আদি নাগরিকত্ব আইনটি প্রণীত হয়। এখন সেই আইন এমন ভাবে সংশোধন করা হল, যার সাংবিধানিক বৈধতা নিয়েই বড় রকমের প্রশ্ন উঠেছে।
প্রসঙ্গত, ভারতের সংবিধানের সঙ্গে মার্কিন সংবিধানের একটি পার্থক্য হল, সেখানে পরিষ্কার করে বলা আছে যে, রাজ্যগুলির অস্তিত্ব বা মর্যাদায় কেন্দ্রীয় সরকার নিজের ক্ষমতায় কোনও ভাবেই কোনও পরিবর্তন ঘটাতে পারবে না, এবং রাজ্যগুলি যেহেতু কেন্দ্রের সঙ্গে সমান সাংবিধানিক মর্যাদা ভোগ করে, তাই তাদের ক্ষেত্রে যে কোনও পরিবর্তনের জন্য সংশ্লিষ্ট রাজ্যের আইনসভার সম্মতি আবশ্যক হবে। ২০১৯ সালের ৫ অগস্ট যে ভাবে সংসদীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে একটি রাজ্যকে কেন্দ্রশাসিত এলাকা বানিয়ে তার মর্যাদাহানি করা হল, সেটা যথার্থ যুক্তরাষ্ট্রীয় আদর্শের সম্পূর্ণ প্রতিকূল।
আজ যে সাহসী তরুণতরুণীরা দেশ জুড়ে অন্যায়ের প্রতিবাদ জানিয়ে চলেছেন, তাঁদের একটি পরামর্শ দিতেই সংবিধানের এই সংক্ষিপ্ত ইতিহাস পরিবেশনের চেষ্টা। সংবিধানের কিছু অনুচ্ছেদ চতুর ভাবে কাজে লাগিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদী শাসক গণতন্ত্রকে একনায়কতন্ত্রে রূপান্তরিত করতে চাইছে, যুক্তরাষ্ট্রকে এককেন্দ্রিক করে তুলতে চাইছে। এই তৎপরতার বিরুদ্ধে সংবিধানের আদর্শকে তুলে ধরতে গেলে যুক্তি এবং আবেগ, উভয়কেই ব্যবহার করা দরকার। এখন আমাদের সুদীর্ঘ সত্যাগ্রহের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। আধিপত্যকামী কেন্দ্রের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়তে যত বেশি সম্ভব রাজ্যের উদ্যোগী হওয়া জরুরি। ‘আমরা, জনসাধারণ’ (উই, দ্য পিপল) যত দিন না সংসদীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতার অঙ্কটাকে উল্টে দিতে পারছি, তত দিন নিরাপদ সুস্থিতি মিলবে না। তার পর আমাদের কর্তব্য হবে গণপরিষদের উত্তরাধিকারী হিসেবে কার্যকর সংসদের সজীব সত্তাটিকে এমন ভাবে ব্যবহার করা, যাতে যুক্তরাষ্ট্র এবং গণতন্ত্রের কাঠামো জোরদার হয়, মৌলিক অধিকার এবং হেবিয়াস কর্পাস অলঙ্ঘ্য হয়। তবেই দেশে সংখ্যাগুরুবাদী অত্যাচার থেকে মুক্তি মিলতে পারে।
ইতিহাস বিভাগ, হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি