খেলায়: পুণের জাতীয় প্রতিযোগিতায়। —নিজস্ব চিত্র।
শান্ত স্বর। কিন্তু প্রত্যয়ী উচ্চারণ। ‘‘আমি ব্যতিক্রমী নই। তবে আমি ময়দান ছেড়ে পালাইনি।’’ প্রণতি নায়েকের এই কথার মধ্যেই লুকিয়ে লড়াইয়ের জেদ। আর ফিরে আসার গল্প। সেই জেদের লড়াইয়ে মিলেছে পদক। তিনিই বাংলার জিমন্যাস্টিক্সের ইতিহাসে একমাত্র পদকজয়ী মেয়ে। গত ২০-২৩ জুন মঙ্গোলিয়ার উলানবাটোরে আয়োজিত সিনিয়র এশীয় আর্টিস্টিক জিমন্যাস্টিক্স চ্যাম্পিয়নশিপে ব্রোঞ্জ পদক পেয়েছেন প্রণতি। তিনি দেশের তৃতীয় মেয়ে জিমন্যাস্ট, যিনি আন্তর্জাতিক পদক জিতলেন। ত্রিপুরার দীপা কর্মকার এবং তেলঙ্গানার অরুণা রেড্ডির পর প্রণতি। এর আগে বাংলার কেউ জিমন্যাস্টিকের আন্তর্জাতিক মঞ্চে পদক পান নি।
মঙ্গোলিয়ার লড়াইও কঠিন ছিল। এবং এখানেও ছিল ফিরে আসার গল্প। ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প। কোয়ালিফাইং রাউন্ডেও তিনি ষষ্ঠ স্থানে ছিলাম। প্রথম স্থানে ছিলেন চিনের একটি মেয়ে। দ্বিতীয় স্থানে জাপানের। একটি মেয়ে। তৃতীয় স্থানে কোরিয়ার প্রতিযোগী। সেই সময়ে প্রশিক্ষক কী ভাবে মনের জোর ফিরিয়েছিলেন জানালেন প্রণতি। বললেন, ‘‘আমার কোয়ালিফাইং রাউন্ড দেখার পর প্রশিক্ষক জানান, ভল্ট খুব ভাল হয়েছে। প্রতিটি ধাপ খুব সুন্দর হয়েছে। কিন্তু ল্যান্ডিংয়ের সময় ব্যাল্যান্স রাখার ক্ষেত্রে একটু নজর দিতে হবে।’’ ফাইনালের আগে হাতে একদিন সময় পেয়েছিলেন প্রণতি। নিজের খামতি ঢাকতে টানা অনুশীলন করলেন। তার পর এল ফাইনালের দিন। প্রণতির পালা ছিল সবথেকে শেষে। তখনও পর্যন্ত কোরিয়ার প্রতিযোগী তৃতীয় স্থানে ছিলেন। তাঁর ঠিক আগেই ভল্ট শেষ করেছেন কোরিয়ার মেয়েটি। প্রণতি বললেন, ‘‘ ভল্ট দেওয়ার সময় ল্যান্ডিংয়ের ব্যালান্স ঠিক রাখতেই পয়েন্ট বেশি পাই।’’
সাফল্যের জন্য বারবার প্রশিক্ষক মিনারা বেগমকে গুরুত্ব দিয়েছেন। কিন্তু নিজের সঙ্গে লড়াইটাও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। ২০১৪ সালে স্কটল্যান্ডে কমনওয়েলথ গেমসে যোগ দেন। ২০১৪ সালেই দক্ষিণ কোরিয়ায় এশিয়ান গেমসে যোগ দিয়ে অল রাউন্ড ইভেন্টে ফাইনালে ওঠেন। সফল হতে পারেননি। ২০১৪ সালেই চিনে ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নশিপে যোগ দেওয়ার সুযোগ পান। মাঝে দু’বছর আন্তর্জাতিক স্তরের কোনও প্রতিযোগিতায় যোগ দেন নি। ২০১৭ সালের মে মাসে ব্যাঙ্ককে আয়োজিত সিনিয়র এশিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপে ভল্ট ইভেন্টে চতুর্থ ও বিম ইভেন্টে পঞ্চম স্থান দখল করেন। দু’বছর পরে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় চতুর্থ স্থানে থেমে যেতে হয়। এই ফলেই সকলে খুশি। ব্যাঙ্ককেই প্রশিক্ষক-সহ সকলে সেলিব্রেশন শুরু করে দেন। ২০১৭ সালে অক্টোবরে জার্মানিতে ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়ানশিপে যোগ দিয়েছিল। এই সময় জন্ডিস থাকায় ভাল ফল করতে পারেননি। শরীর খারাপ নিয়ে অনুশীলন করায় কয়েক মাস ভুগতে হয়।
২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে অস্ট্রেলিয়ায় ওয়ার্ল্ড কাপে যোগ দেন। এই প্রতিযোগিতায় ভারত থেকে যোগ দিয়েছিলেন বাংলার প্রণতি নায়েক ও তেলঙ্গানার অরুণা রেড্ডি। প্রণতি ও অরুনা দু’জনেই খুব ভাল বন্ধু। সমবয়সি হওয়ার ফলে সাব জুনিয়র বিভাগ থেকে এক সঙ্গেই বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়া। কয়েকবার বিদেশে দু’জনে একসঙ্গে দেশের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করেন। অস্ট্রেলিয়ার এই প্রতিযোগিতায় দু’জনেই ফাইনালে ওঠেন। ফাইনালে ভল্ট ইভেন্টে অরুণা তৃতীয় হয়ে পদক পান। ষষ্ঠ স্থান দখল করে খালি হাতেই ফিরতে হয় প্রণতিকে। ২০১৭ সাল থেকে বারবার বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় ফাইনাল রাউন্ডে উঠলেও ষষ্ঠ এবং অষ্টম স্থানে শেষ করতে হয়েছে। এতে মনের উপর চাপ পড়েনি? প্রণতি বলেন, ‘‘বারবার সাফল্যের খুব কাছ থেকে ফিরতে হলে সকলেরই মন খারাপ হয়।’’ মন খারাপ খুব বেশি হয়েছিল ২০১৮ সালে অস্ট্রেলিয়ায় ওয়ার্ল্ড কাপে। সেখানে ষষ্ঠ স্থান পান। তার থেকেও বেশি মন খারাপ হয়েছিল বন্ধু অরুণা রেড্ডি ওই প্রতিযোগিতায় তৃতীয় হয়েছিলেন। প্রণতি মন খারাপের কারণ ব্যাখ্যা করেন, ‘‘বন্ধুর সাফল্যে হিংসা হয়নি। কারণ আমার দেশের জন্য পদক এসেছে। কিন্তু আমি পদক থেকে খুব দূরে ছিলাম না। এতেই খুব মন খারাপ হয়েছিল। রুমে ফিরে খুব কেঁদেছিলাম। ঘুমোতে পারিনি। আমার কোচ খুব দুঃখ পেয়েছিলেন। তার পরেও আমাকে সাহস দিয়েছেন।’’
বাড়িতে ফোন করেছিলেন। মা-বাবা সান্ত্বনা দিয়েছিলেন, পরের বার আবার চেষ্টা করতে হবে। বিদেশে সাফল্য ছিল না। কিন্তু প্রণতির প্রশিক্ষক, মিনারা বেগম সব সময়ই তাঁর পাশে থেকেছেন। বিদেশ সফরের ম্যানেজারেরাও কখনও কেউ খারাপ কথা বলেননি। বরং সাহস দিয়েছেন। অস্ট্রেলিয়া ওয়ার্ল্ড কাপের পরই প্রণতি ঠিক করে নিয়েছিলেন, পদক তাঁকে পেতেই হবে। শুরু করেন কঠোর অনুশীলন। এতদিন ‘সুখাহারা ৩৬০ ডিগ্রি’ ভল্ট দিতেন। যার ভ্যালু ১৪.৮০। এবার ডিফিক্যাল্টি বাড়িয়ে ‘সুখাহারা ৭২০ ডিগ্রি’ ভল্ট দেওয়া শুরু করেন। যার ভ্যালু ১৫.৪০। কঠোর অনুশীলনের পর ২০১৯ সালে ঔরঙ্গাবাদে সিনিয়র ন্যাশনালে প্রথম স্থান পান। তার পরই আন্তর্জাতিকে সাফল্য।
প্রণতি জানান, প্রথমবার আন্তর্জাতিক পদক পাওয়ায় জন্য ভাগনি আরাধ্যাকেই লাকি-চার্ম মনে করেন প্রণতি। প্রণতির কথায়, ‘‘মার্চ মাসে আরাধ্যা জন্মায়। তারপর মে মাসে সিনিয়র ন্যাশনালে প্রথম হই। জুন মাসে এশিয়া জিমন্যাস্টিক্সে ব্রোঞ্জ পদক পাই। আমার কাছে আমার ভাগনি খুবই লাকি।’’ প্রণতির দিদি জয়তী বলেন, ‘‘পদক পেয়েই মঙ্গোলিয়া থেকে বোন ফোন করে জানায়, আরাধ্যা-ই তাঁর কাছে খুব লাকি। আরাধ্যা জন্মানোর পরেই আন্তর্জাতিক মঞ্চে পদক মিলেছে।’’ প্রণতি আদর করে ভাগনির নাম রেখেছেন ‘রাই’। এখন রাই নামেই সকলে তাঁকে ডাকে। এখন সব সময় ‘রাই’য়ের ছবি সঙ্গে নিয়ে ঘুরছেন প্রণতি। মোবাইলের স্ক্রিন ব্যাকগ্রাউন্ডে ও হোয়াটস অ্যাপ প্রোফাইল পিকচারেও রাই এর ছবি রয়েছে।
আন্তর্জাতিক সাফল্য এল। দেশের জিমন্যাস্টিক্সের পরিকাঠামো নিয়ে কিছু বলবেন? প্রণতির কথায়, ‘‘আমাদের এখানে পরিকাঠামোর আরও উন্নতি করতে হবে। আমাদের এখানে ভল্ট দেওয়ার জায়গায় ফোমের পিট থাকে। চোট লাগার সম্ভাবনা কম। কিন্ত বিম বারের কাছে ফোম পিট থাকে না। ঝুঁকি নিয়ে ভয়ে ভয়ে অনুশীলন করতে হয়। বিম বার অনুশীলনে আমরা হাতে গ্রিপ পরি না। এটাও আমাদের একটা দুর্বলতা।’’
পশ্চিম মেদিনীপুরের পিংলার করকাই গ্রামের দরিদ্র বাড়ির মেয়ে। সেখান থেকে আন্তর্জাতিক মঞ্চে সফল। এবার লক্ষ্য? প্রণতি জানান, এখন তাঁর মনের জোর অনেক বেড়েছে। এবার লক্ষ্য অলিম্পিক। সামনেই ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নশিপ রয়েছে। এখানে ৫০ পয়েন্ট পেয়ে অলিম্পিক্সে যাওয়ার ছাড়পত্র পেতেই হবে।
নতুন লড়াইয়ের জেদ জমছে প্রণতির মনে।