পীর বহমান সাহেবের মাজার। আউশগ্রামে। নিজস্ব চিত্র
বাংলা সাহিত্য ও সমাজে চিরকালই ‘নানা ভাষা, নানা মত, নানা পরিধান’ মিলেমিশে গিয়েছে। সেই মধ্যযুগ থেকেই বাংলার সমাজে ‘সত্যপীর’, মাণিকপীরদের একটি স্বতন্ত্র অস্তিত্ব ছিল। জনমানসে এরা দেবতা হিসেবে পূজিত হয়ে আসছেন। ইতিহাসবিদ ও সমাজ সমালোচকদের একাংশ মনে করেন, মধ্যযুগে হিন্দু, মুসলিম দু’ই সম্প্রদায়ের মধ্যে পারস্পরিক ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক লেনদেনের মাধ্যমে এদের উদ্ভব। এই কারণে তাঁদের ‘সংমিশ্রিত দেবতা’ বলে অভিহিত করা হয়। ইতিহাসবিদ ও সাহিত্য সমালোচকেরা মনে করেন, বাংলায় ত্রয়োদশ শতকে তুর্কি আক্রমণের প্রভাবে প্রাথমিক ভাবে বাংলার প্রাচীন সমাজ ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছিল। পরে দুই সম্প্রদায় পারস্পরিক জড়তা কাটিয়ে একে অন্যের কাছাকাছি আসতে শুরু করে। তারই সঙ্গে ইলিয়াস শাহ, হোসেন শাহদের মতো সম্রাটদের অবির্ভাবের ফলে হিন্দু-মুসলিম মেলবন্ধনের পটভূমিটা নির্মিত হয়েছিল। সেই পটভূমিকেই বৃহত্তর রূপ দেন শ্রীচৈতন্য। এই মিলনের পটভূমি রচনার পিছনে সে কালের সুফি সাধকদেরও একটা বড় ভূমিকা ছিল।
তুর্কী আক্রমণের পরে, সুফি, সাধকেরা বাংলায় এসেছিলেন (যদিও কয়েক জন ইতিহাসবিদ মনে করেন তার আগে থেকেই সুফি সাধকেরা এ দেশে আসতে শুরু করেছিলেন)। তাঁদের ধর্মতত্ত্ব ও দেবদেবীর অলৌকিক মাহাত্ম্যমণ্ডিত কথা সে কালের বাংলার জনমানসে একটা বিরাট প্রভাব বিস্তার করেছিল। এই সময় ‘মানবের দেবায়ন’-এর ধারার সুবাদে বাঙালি জনমানসে এই সব সাধকেরা দেবত্বে উন্নীত হতে থাকেন। সে কালের বাঙালি হিন্দুদের একটি অংশও নানা বিপদে আপদে পীরের ‘থানে’ মানত করত। শ্রীচৈতন্যের হাত ধরে যে মিলনের ধারা নতুন রূপ পেল তার সুবাদেই সপ্তদশ শতকে দেখা গেল হিন্দুর নারায়ণ ও মুসলমানের পীর এক দেহে লীন হয়ে গিয়েছে। সত্যনারায়ণের ব্রতকথা ও হিন্দুপুরাণ ও মুসলিম পীরদের সম্পর্কে প্রচলিত অলৌকিক কাহিনির মধ্যে মিশ্রণ ঘটতে শুরু হয়েছিল। সপ্তদশ শতকে লেখা ধর্মমঙ্গল-সহ নানা কাব্যে এই মিলনের সুরটি অতি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। কৃষ্ণরাম দাসের ‘রায়মঙ্গল’ কাব্যে দেখা যায়, সুন্দরবনের হিন্দু ব্যাঘ্রদেবতা দক্ষিণরায়ের সঙ্গে ইসলাম ধর্ম-প্রচারক পীর বড়খাঁ গাজীর যুদ্ধের কাহিনি। দুই বীরের এই ভয়াবহ যুদ্ধ প্রশমনের জন্য হিন্দু-মুসলিমের মিলিত দেবতা অর্ধ-শ্রীকৃষ্ণ-পয়গম্বরের (কৃষ্ণপয়গম্বর) আবির্ভাব ঘটে। কাব্যে আছে ‘অর্দ্ধেক মাথায় কালা একভাগা চুড়া টালা/ বনমালা ছিলিমিলী তাতে।/ ধবল অর্দ্ধেক কায় অর্দ্ধ নীলমেঘ প্রায়/ কোরান পুরাণ দুই হাতে।’
বাংলার অন্য স্থানের মতোই বর্ধমানের বিস্তীর্ণ এলাকায়ও সত্যপীরকে নিয়ে একটি সংস্কৃতি তৈরি হয়েছিল। জনজীবনে ধর্মীয় গোঁড়ামিকে পিছনে ফেলে সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠার জন্য বহু সাধক গান বেঁধেছিলেন। তাঁদের মধ্যে ফয়জুল্লার গানে রয়েছে ‘হিন্দু দেবতা আমি মুসলমানের পীর/ দুই কুলেতে পূজা লই, দুই কুলেতে জাহির’’। আজও হিন্দু বাড়িতে সত্যপীরের পুজো হলে সেই শিরনি পৌঁছে দেওয়া হয় পীর ঠাকুরের থানে। সত্যপীরের গানের পালাকীর্তন কবিগান, রামযাত্রার মতোই একটি লোক আঙ্গিক। পালা ধরেই এই গান গাওয়া হয়। এক জন থাকেন মূল গায়েন, আর তিন, চার জন দোয়ার। এক থেকে দু’জন বাজিয়ে থাকেন। খোল-করতাল হল মূল বাদ্যযন্ত্র। বর্তমানে কেউ কেউ হারমোনিয়াম, কি-বোর্ডও ব্যবহার করছেন। মূল গায়েন শেরওয়ানি জাতীয় পোশাক পরে আসরে নামেন। হাতে থাকে চামর। এই চামর বক্তা পরম্পরায় হাত বদল হয়। পালা অনুসারে সুর আরোপ করা হয়ে থাকে। কয়েকটি সত্যপীরের গান পরিবেশক দলের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, অগ্রহায়ণ থেকে চৈত্র পর্যন্ত নানা প্রান্ত থেকে ডাক আসে। বিভিন্ন ক্লাব, বিভিন্ন অনুষ্ঠানের পাশাপাশি, মুসলিম ঘরের নানা অনুষ্ঠানের সময়ে ডাক আসে। আসরেও মাথায় চামর ঠেকানো বাবদ কিছু পয়সা পাওয়া যায়।
দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯
এই সব গায়েনেরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছেন পূর্ব বর্ধমানের নানা প্রান্তে। মঙ্গলকোটের আলো মির্জার দলে তিনিই মূল গায়েন, তাঁর সঙ্গে দোয়ার বাজান জাসন শেখ, গোপাল ডোমত আর সঙ্গত করেন কার্তিক ডোম। তাঁদের সবাইকে নিয়ে গড়ে উঠেছে একটি দল। অনুরূপ ভাবে শেখ মহম্মদের ছেলে শেখ মুজিবর, গোপাল ঘড়ুই ও ভাগু সিংহকে নিয়ে গড়ে তুলেছেন রায়নার বেলসর গ্রামের ‘দয়াল সত্যপীর’ গানের দল। তাঁদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বছরের একটি নির্দিষ্ট সময়ে গান পরিবেশ করলেও বাকি সময়টা কাটে মুটেগিরি, দিনমজুরি করে।
তাঁরা জানান, সত্যপীরের গানের ‘পালা’ নির্বাচনের দায়িত্ব দেওয়া থাকে দর্শকদের উপরে। দর্শকরা যে পালা বলে দেন সেই পালাই তাঁরা গান। পালা নির্বাচনও এলাকাভেদে বদলে যায়। মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায় ‘ইউসুখ জুলেখা’, ‘কুলসম ফতেমা খানদান’, ‘বাহারম বাদশা’ ইত্যাদি পালা গাওয়া হয়। আবার হিন্দু অধ্যুষিত এলাকায় গাওয়া হয় ‘শঙ্করী ময়রা’-র মতো পালা। পালার মধ্যে পরিবেশিত আখ্যানের সঙ্গে মঙ্গলকাব্যের আখ্যানের খানিকটা মিল রয়েছে। মঙ্গলকাব্যের দেবদেবীর মতোই এই পালাগুলিতেও রয়েছে পুজো প্রচার, অভিশাপ, শাপমুক্তির শেষে দুঃখের অবসান প্রভৃতি ঘটনার কথা। মঙ্গলকাব্যের মতো এই গানগুলিতেও বন্দনা অংশ রয়েছে। অনেক পালার বন্দনা অংশে পীরের জন্ম প্রসঙ্গে উঠে আসে হিন্দু মায়ের কথা। স্পষ্ট ভাবেই বোঝা যায়, যুগের দাবি মেনে, হিন্দু মুসলিম সংস্কৃতির যে মিলনের সুর তৈরি হয়ে গিয়েছিল তা থেকেই এই পালার কাহিনিগুলির উদ্ভব।
বর্তমানের পালা গায়কদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বর্ধমানের বেশ কিছু জায়গায় এই পালার জনপ্রিয়তা রয়েছে। মানুষের মনোবাসনার পূরণের পাশাপাশি, কাহিনির রসবেদনাও এই পালাগুলিকে টিকিয়ে রাখার একটা বড় কারণ সে কথা স্বীকার করেন পালার গায়কেরা। যুগরুচিকে তৃপ্ত করতে পুরনো কাহিনির পাশেই স্থান পেয়েছে আজকের যুগের বাল্যবিবাহ কুফলের মতো সামাজিক বিষয়ও। পালার গায়কদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তাঁরা সকলেই এই ধারাটিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে উৎসাহী কিন্তু তার জন্য প্রয়োজন রয়েছে লোকশিল্পী হিসেবে স্বীকৃতি এবং প্রশাসনিক সহযোগিতার।
লেখক মঙ্গলকোট একেএম উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও সংস্কৃতিকর্মী