নিরাপদ? সিরিয়ার উদ্বাস্তুরা এই কোভিড-কালের নতুন পরিস্থিতিতে সঙ্কটের সঙ্গে যুঝছেন, গ্রিস, ১৮ সেপ্টেম্বর। এএফপি
সারা বিশ্বে ছড়িয়ে থাকা আর্ত এক বিপুলাকার জনগোষ্ঠী তৈরি হয়েছে এখন। তাঁরা সহায়-সম্বলহীন, ছিন্নমূল। শরণার্থী। জুন মাসের ২০ তারিখ তাঁদের জন্য একটি শরণার্থী দিবসও তৈরি হয়েছে। ২০০১ থেকে প্রতি বছর দিনটিকে সামনে রেখে হু, ইউনাইটেড নেশনস হাই কমিশনার ফর রিফিউজিস (ইউএনএইচসিআর), দ্য ইউএন রিফিউজি এজেন্সি-র মতো আন্তর্জাতিক সংগঠন নীতি-নির্দেশ ঘোষণা করে। কিছু উদ্বাস্তু পরিবারকে দেশে ফেরানোর চেষ্টা করে। শিকে ছিঁড়লে কিছু মানুষের আইনি অবস্থানেরও পরিবর্তন হয়। প্রতি বছর ‘দ্য ইউএন রিফিউজি এজেন্সি’ দিনটির তাৎপর্য তুলে ধরতে একটি স্লোগান তৈরি করে। এ বছরও দিনটি অবহেলিত হয়নি। কোভিড পরিস্থিতি বিচারে স্লোগান ছিল: ‘এভরি অ্যাকশন কাউন্টস’। বাংলা তর্জমায় মোটামুটি দাঁড়ায়: মানুষের প্রতিটি ছোট পদক্ষেপই, নৈতিক অবস্থানের দিক থেকে সমান অধিকারের পৃথিবী গড়ে তুলতে পারে। কিন্তু এ বছরের জুনের আগে কিংবা পরে, কেমন আছেন এই ছিন্নমূল মানুষরা? খোঁজ নিয়েছি কি আমরা?
কয়েক দিন আগে আমাদের দেশে পরিযায়ী শ্রমিকদের করোনাকালীন সঙ্কট বিষয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর অসংবেদনশীল মন্তব্য নিয়ে অনেক কথাবার্তা চলছে। তার মধ্যেই আমাদের মনে পড়তে পারে, অতিমারিতে গোটা বিশ্বের প্রান্তিক মানুষদের অস্তিত্ব কী ভাবে বিরাট প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে। এই চরম দুঃসময়ে আশ্রয়প্রার্থী, শরণার্থী, রাষ্ট্রহীন, বিশেষত শিবিরবাসী উদ্বাস্তুদের অবস্থা সঙ্গিন। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাঁরা বেঁচে রয়েছেন কোনওক্রমে। বাসস্থান, খাদ্য, স্বাস্থ্যের জন্য তাঁরা দেশের সরকার, মানবাধিকার রক্ষাকারী সংস্থা ও সহায়ক সংগঠনগুলির উপর নির্ভরশীল। এমন মানুষদের সংখ্যা কত? ইউএনএইচসিআর বা উদ্বাস্তু কল্যাণের কাজে নিয়োজিত আন্তর্জাতিক সংস্থার হিসেব, বিশ্বের ১ শতাংশ মানুষ বাস্তুহারা। নথিভুক্ত বা অনথিভুক্ত শরণার্থী প্রায় ৭.৯৫ কোটি। জবরদস্তি উচ্ছেদ হওয়া গৃহহীনদের মধ্যে ২.৬ কোটি ঘোষিত উদ্বাস্তু, ৪.৫৭ কোটি নিজের দেশের মাটিতেই নাগরিক সুযোগ-সুবিধে ছাড়া পরজীবী হয়ে বাঁচতে বাধ্য, ৪২ লক্ষ অন্য দেশে আশ্রয়প্রার্থী (আইনি ভাষায় ‘অ্যাসাইলাম সিকার’)। মোট উদ্বাস্তু জনসংখ্যার ৪০ শতাংশ অনূর্ধ্ব ১৮, ৭৩ শতাংশের বেশি পরিবারের অবস্থান দারিদ্র সীমার নীচে।
সিরিয়ার যুদ্ধ শেষ কয়েক বছরে যে অমানবিক অবস্থা তৈরি করেছে, তাতে অন্তত ১.২ কোটি মানুষ সিরিয়ার পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র বা ইউরোপে মাথা গোঁজার চেষ্টা করেছেন। বাস্তুচ্যুতি, অসুস্থতা ও ক্ষুধার সঙ্গে লড়াই করে প্রায় ৬২ লক্ষ সিরীয় উদ্বাস্তু আশ্রয় নিয়েছেন জর্ডন, লেবানন, ইরাক, মিশর, তুরস্ক প্রভৃতি পশ্চিম এশিয়ার দেশগুলিতে। অনেকে সাময়িক আশ্রয় পেয়েছেন গ্রিস, সুইডেন, অস্ট্রিয়া, জার্মানিতে। কানাডা, আমেরিকা, আয়ারল্যান্ড, আর্জেন্টিনা, স্পেন, নরওয়ে, নিউ জ়িল্যান্ডও উদ্বাস্তু-ত্রাতা রাষ্ট্রগুলির অন্যতম। কেনিয়া, সোমালিয়াতেও উদ্বাস্তু প্রচুর। অধিকাংশ দেশেই তাঁদের শিবিরের বাইরে বেরিয়ে কাজের অধিকার নেই। যাঁরা সামান্য উপার্জন করতেন, তাঁরা এখন কাজ পাচ্ছেন না।
সিরিয়ায় ৩৫০টি হাসপাতাল বা স্বাস্থ্য বিভাগকে বোমায় উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। অন্তত ৯০০ জন ডাক্তার বা সেবাকর্মীকে খুন করা হয়েছে, বা পালাতে বাধ্য করা হয়েছে। প্রতিটি উদ্বাস্তু শিবিরেই করোনা-আক্রান্ত প্রচুর। লেবাননের ক্যাম্প কর্তৃপক্ষ এক করোনা-আক্রান্ত মহিলার রিফিউজি কার্ড কেড়ে নেন, যাতে তিনি পালিয়ে যেতে না পারেন। সংক্রমণ বৃদ্ধি বন্ধ করার চেষ্টার মূল্য তাঁকে অন্য ভাবে দিতে হয়। বিশেষ সুবিধা দূরস্থান, কার্ডটি না থাকায় তাঁর নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের জোগানই বন্ধ হয়। খাদ্য, ভিটামিনের মাধ্যমে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে বলেছেন ডাক্তারেরা। অথচ, পশ্চিম এশিয়ার শিবিরগুলোতে খাদ্যের ন্যূনতম জোগানও বন্ধের উপক্রম। ক্যাম্পের বাইরে ‘শেল্টার হাউস’-এ পায়রার খুপরির মতো ঘরের ভিতর আবার খাঁচার মতো করা। এক জন সংক্রমিত হলে বাকিদের প্রাণ বাঁচানোই মুশকিল। গ্রিসে শিবিরবাসীরা সংক্রমণের চেয়েও বেশি ভয় পাচ্ছেন অভাবে, অনাহারে মৃত্যুর আশঙ্কাকে। রাষ্ট্রপুঞ্জ পরিচালিত শিবিরগুলিতে ১৫০-২০০ রোগীর জন্য নিভৃতবাস কেন্দ্র গড়া হয়েছে, অথচ উদ্বাস্তু কয়েক হাজার। টেস্ট না করানোর অভিযোগ উঠছে। শিবিরের ভিতরে অস্থায়ী হাসপাতালে বেড খুব কম। ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট, ভেন্টিলেশন ইত্যাদির ব্যবস্থাও নেই।
দক্ষিণ এশিয়াতেও বিভিন্ন শরণার্থী, আশ্রয়প্রার্থী, শিবিরবাসী, ডিটেনশন ক্যাম্পে আটক— তথাকথিত রাষ্ট্রহীনেরা— আছেন। তাঁদের জন্য ঘোষিত বা অঘোষিত নীতি-নির্দেশও আছে। কিন্তু এই প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ভাগ্য রাষ্ট্রের সদিচ্ছার উপরেই নির্ভরশীল। বাংলাদেশে চট্টগ্রামের কক্সবাজার জেলায় আছেন মায়ানমার থেকে আসা বিশাল সংখ্যক রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু। ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে এঁদের সংখ্যা ছিল ৯ লক্ষ ১৪ হাজার, যার ৬০ শতাংশই শিশু। শরণার্থী ত্রাণ প্রত্যাবাসন কমিশনার, ইউএন এজেন্সির মতো আন্তর্জাতিক সংগঠন এবং কিছু স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের মাধ্যমে বাংলাদেশ সরকার বিদেশি বিনিয়োগে ত্রাণের ব্যবস্থা করেছে। কিন্তু রোহিঙ্গা শিবিরে এক কিলোমিটারের মধ্যে অন্তত ৪০০টি পরিবারের বাস। ত্রাণকাজে যুক্ত স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের লোকজনও কোভিডের খবরের পর ক্যাম্পে ঢুকতে ভয় পাচ্ছেন। যদিও জনঘনত্বের তুলনায় কোভিড রোগী এখনও বেশ কম। সদর হাসপাতাল ছাড়া রামু, চাকারিয়া, উখিয়া ও টেকনাফে রোগীদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা রয়েছে। সেখানে টেস্ট কিটের অপ্রতুলতার অভিযোগ।
কোভিডে, লকডাউনে এ দেশের মাটিতে কয়েকটা শব্দ চাপা পড়েছিল— ডি-ভোটার, এনআরসি, ডিটেনশন ক্যাম্প ইত্যাদি। ভাবা গিয়েছিল, রাষ্ট্রের চোখে সন্দেহের তালিকায় থাকা মানুষগুলি আপাতত খানিক স্বস্তির সুযোগ পেলেন। লকডাউনের আগে ১৫ মার্চ অসমের মানবাধিকার সংস্থা ‘অল অসম পিস অ্যান্ড লিবার্টি ইনিশিয়েটিভ’ (এপিএলআই) সুপ্রিম কোর্টে অসমের ছ’টি ডিটেনশন ক্যাম্পে বন্দিদের মুক্তির আবেদন জানায়। বলে, ডিটেনশন ক্যাম্পে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা দুষ্কর। কাজেই স্বাস্থ্য সতর্কতা ও মানবিক কারণে বন্দিদের শর্ত সাপেক্ষে মুক্তি দেওয়া উচিত। সরকারের যুক্তি ছিল, বন্দিরা জামিন পেলে সরকারের নজরের বাইরে গিয়ে হাতছাড়া হয়ে যাবে! বিরোধিতা সত্ত্বেও, মানবিক কারণে সুপ্রিম কোর্ট আবেদনের পক্ষে রায় দেয়। জামিনের অর্থ পরিমাণ ২ লক্ষ টাকা থেকে ১০ হাজারে, এবং ডিটেনশন ক্যাম্পে ন্যূনতম থাকার মেয়াদ ৩ বছর থেকে ২ বছরে নামানো হয়। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশের ভিত্তিতে গৌহাটি হাইকোর্ট অসম বর্ডার পুলিশকে দু’বছরের মেয়াদ উত্তীর্ণ বন্দিদের তালিকা তৈরির নির্দেশ দেয়। তার ভিত্তিতে সপ্তাহে এক বার স্থানীয় থানায় হাজিরার শর্তে এখনও পর্যন্ত মুক্তি পেয়েছেন ৩৩৯ জন। কিন্তু জুনের মাঝামাঝি দ্য ইকনমিক টাইমস-এর খবরে জানা যায়, অসম সরকার সুপ্রিম কোর্টে এনআরসি পুনঃপ্রমাণের আবেদনের কথা ভাবছে। ডি-ভোটার নোটিসের কাজও চলছে।
অতিমারির লগ্নে শরণার্থী, উদ্বাস্তু বা রাষ্ট্রহীনদের পাশে দাঁড়ানোই রাষ্ট্রের বিধেয়। অথচ, সরকার ও সাধারণ মানুষ উদ্বাস্তুবিরোধী হয়ে উঠছেন। অসামঞ্জস্যমূলক ব্যবহার, হিংসার শিকার হচ্ছেন প্রান্তিকেরা। শিবিরের বাইরে আসেননি, তবু এলাকায় সংক্রমণ ছড়ানোয় দায়ী করা হচ্ছে ছিন্নমূলদের। স্থানীয় হাসপাতাল ব্যবহারে বাধা দেওয়া হচ্ছে, একঘরে করা হচ্ছে। এমনকি, সরকারি নির্দেশে অনেক শিবিরের মধ্যে মোবাইল বা ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ রাখা হয়েছে। তাতে নাকি গুজব ছড়াবে না, ভিতরের খবর বাইরেও বেরোবে না। উদ্বাস্তুদের আশঙ্কা, আস্তে আস্তে সমাজ ও পৃথিবী থেকেই বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবেন তাঁরা। রাষ্ট্র মানবিক না হলে, পাশে না দাঁড়ালে, তাঁদের অস্তিত্ব হয়তো সত্যিই অদৃশ্য হয়ে যাবে।
ইতিহাস বিভাগ, ডায়মন্ড হারবার মহিলা বিশ্ববিদ্যালয়