চিলির এই জনজোয়ার

এই আন্দোলনের গোড়ার দিকে সরকার নানা বক্রোক্তি করে। পরামর্শ দেয়: কিছু খরচ বাড়ায় এত হইচই কিসের! ফুলের দাম তো কম! প্রিয়জনকে বেশি করে ফুল দিয়ে খুশি করা যায়!

Advertisement

সব্যসাচী বসুরায়চৌধুরী

শেষ আপডেট: ১৩ নভেম্বর ২০১৯ ০০:০০
Share:

অক্টোবর পর্যন্ত ঠিকই ছিল সব। মাত্র ১ কোটি ৮০ লক্ষ মানুষের বাস চিলি-তে। বিশ্ব ব্যাঙ্কের হিসেবে, ২০০০ সালেও এ দেশে দারিদ্রের হার ছিল ৩১ শতাংশ, ২০১৭’য় তা নেমেছে ৬.৪ শতাংশে। তামা ও ব্যাটারি তৈরির উপকরণ লিথিয়াম-সমৃদ্ধ দেশটি রাষ্ট্রপুঞ্জের মানবাধিকার সূচকের নিরিখে দক্ষিণ আমেরিকার শীর্ষে। ইদানীং আর্থিক বিকাশও বেশ দ্রুত। প্রধানত, বাজার অর্থনীতির পথে চলা ৩৬টি ধনী দেশের জোট ‘অর্গানাইজ়েশন ফর ইকনমিক কোঅপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট’-এ (ওইসিডি) দক্ষিণ আমেরিকার প্রথম সদস্য চিলিতে গড় মজুরিও ১৯৯০ থেকে ২০১৫’র মধ্যে ১২০ শতাংশ বেড়েছে বলে দাবি। সেই দেশে কী এমন ঘটল যে ১৮ অক্টোবর রাজধানী সান্তিয়াগোর রাস্তায় অগণিত ছাত্রছাত্রী তীব্র প্রতিবাদে মুখর হলেন?

Advertisement

অক্টোবরের শুরুতে সান্তিয়াগোর মেট্রোয় ৩০ পেসো (ভারতীয় তিন টাকার সমতুল্য) ভাড়া বাড়ে। বাড়ে বাস ভাড়া ও বিদ্যুতের খরচ। প্রতিবাদে মেট্রো স্টেশনগুলিতে ব্যাপক ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। গোড়ায় মনে হয়েছিল, ক্ষণস্থায়ী বিক্ষোভ। অচিরে ভুল ভাঙে। ২৫ তারিখেই দেশের রাজধানী দেখল ঐতিহাসিক প্রতিবাদ, আন্দোলনে পা মেলালেন ১০ লক্ষাধিক মানুষ। চিলি সাম্প্রতিক কালে এত বড় মাপের প্রতিবাদ দেখেনি।

৩০ পেসো ভাড়া বৃদ্ধি উপলক্ষমাত্র। এই আন্দোলন চরম আর্থিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে। ২০১৭ সালে রাষ্ট্রপুঞ্জ প্রকাশিত এক রিপোর্ট বলছে, চিলির এক শতাংশ ধনীর হাতে দেশের মোট রোজগারের এক তৃতীয়াংশ। যাবতীয় আর্থিক বিকাশের সুবিধে এঁরাই মূলত পেয়েছেন। সব উন্নত মানের পরিষেবা (প্রায় পুরোটাই বেসরকারি) এঁদের হস্তগত। গত তিন দশক ধরে আর্থিক উদারীকরণের ফলে শিক্ষা, স্বাস্থ্য বা পেনশন ব্যবস্থার বেসরকারিকরণ হয়েছে। অভিযোগ, তামার খনি, অন্য প্রাকৃতিক সম্পদের ভাণ্ডার, এমনকি জলের উৎসও বিদেশি লগ্নিকারীদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। বিশ্বে তামার বৃহত্তম ভাণ্ডার এই দেশটির সাধারণ মানুষকে চিকিৎসার প্রয়োজনে সরকারি হাসপাতালেই যেতে হয়। বেসরকারি চিকিৎসার ব্যয় এঁদের অনেকেরই অসাধ্য। অথচ সরকারি হাসপাতালে বিশেষজ্ঞ ডাক্তার দেখাতে চাইলে এত অপেক্ষায় থাকতে হয় যে, তত দিনে সংশ্লিষ্ট রোগী হয়তো মারাই যাবেন।

Advertisement

একই ভাবে উন্নত মানের শিক্ষার সুযোগের জন্য ছাত্রছাত্রীরা ঋণ নিলে তা শোধ করতে তাঁদের চল্লিশ-পঞ্চাশ বছর বয়স পার হয়ে যায়। প্রসঙ্গত, বেসরকারি ক্ষেত্রে লভ্য উন্নত শিক্ষা বা স্বাস্থ্য পরিষেবার খরচ নগদে মেটাতে পারলে বিশেষ ছাড় মেলে। নগদে খরচ করতে পারেন কিন্তু ধনীরাই। এবং, গত ত্রিশ বছরে লাগামছাড়া বেসরকারিকরণের ফলে বেশির ভাগ কাজই এখন চুক্তিভিত্তিক। চুক্তিতে কাজ মেলে বছরে বড় জোর মাসদশেকের জন্য। অনেকেরই নুন আনতে পান্তা ফুরোয়, দেনায় ডুবে থাকেন তাঁরা। পেনশনের সংস্থান অধিকাংশের আয়ত্তের বাইরে। ওইসিডি-ভুক্ত দেশগুলির মধ্যে চিলিতেই আর্থিক বৈষম্য সর্বাধিক। (‘জিনি গুণাঙ্ক’ ৪৬-এর বেশি।)

আসলে, লাগাতার বেসরকারিকরণ হয়তো চিলির অর্থনীতিতে, উৎপাদন ব্যবস্থায়, পরিষেবা ক্ষেত্রে ‘দক্ষতা’ বাড়িয়েছে, আর্থিক বিকাশের হারও, কিন্তু পাল্লা দিয়ে বেড়েছে বৈষম্যও। বেসরকারি সংস্থার মূল উদ্দেশ্য মুনাফা বৃদ্ধি। অতএব জিনিসের দাম বেড়েছে, পরিষেবার খরচ বেড়েছে, ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান বেড়েছে সাংঘাতিক। সমাজে দু’টি চরম শ্রেণি তৈরি হয়েছে। নব্য-উদার অর্থনীতি যত দিন সাফল্য ও সামগ্রিক সমৃদ্ধি এনেছে, সমাজের ক্রমবর্ধমান আঁধার সে ভাবে চোখে পড়েনি। কিন্তু চিলির আর্থিক সাফল্য মূলত প্রাকৃতিক সম্পদের বিপণনকে কেন্দ্র করে। তা বিশ্ববাজারে যখন চড়া দামে বিকিয়েছে, দিব্যি চলেছে দেশ। সেই বাজারে মন্দার টানে যখন প্রাকৃতিক সম্পদের দাম পড়েছে, চিলির অর্থনীতির জৌলুসও হারাতে শুরু করেছে। দেশে অনেকেই যে হেতু নিজেদের খরচে পেনশন বা বিমার মতো সামাজিক সুরক্ষার বন্দোবস্ত করে উঠতে পারেননি, নতুন পরিস্থিতিতে তাঁদের আর্থিক সঙ্কট প্রকট হয়েছে। বস্তুত, চিলির সমৃদ্ধিকে কখনও দেশের সরকার সুষম ভাবে বণ্টনের চেষ্টা করেনি। এই সমৃদ্ধি কিছু মানুষকে ধনী থেকে আরও ধনী করে তুলেছে। বর্তমান প্রেসিডেন্ট সেবাস্তিয়ান পিনিয়েরা এই ধনকুবেরদের অন্যতম। অধিকাংশ মানুষ, মধ্যবিত্তেরা যে তিমিরে, সেই তিমিরেই।

এই আন্দোলনের গোড়ার দিকে সরকার নানা বক্রোক্তি করে। পরামর্শ দেয়: কিছু খরচ বাড়ায় এত হইচই কিসের! ফুলের দাম তো কম! প্রিয়জনকে বেশি করে ফুল দিয়ে খুশি করা যায়! কিংবা, ভোরের দিকে বা বেশি রাতে তো মেট্রোর ভাড়া কম! সকাল সকাল কাজে বেরিয়ে রাত করে ফিরলেই হয়! এতে কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে পড়েছে। শুধু ছাত্র নয়, এক সপ্তাহের মধ্যে লাখে লাখে শিক্ষক, চাকরিজীবী, মা-মাসি-দিদিমা বাসনকোসন, ঘটি-বাটি সাংসারিক জিনিসপত্র নিয়ে প্রতিবাদে সেগুলি বাজিয়ে রাস্তায় নেমে পড়েছেন। নেমেছেন শিল্পী-কলাকুশলীরাও, কেউ কেউ গিটার হাতে। কিন্তু তাঁদের কপালে জুটেছে পুলিশের লাঠি, কাঁদানে গ্যাস। কার্ফু জারি হয়েছে। সেনা নেমেছে। ইতিমধ্যেই জনা কুড়ি মানুষ নিহত, গ্রেফতার কয়েক হাজার। দমনপীড়ন আন্দোলনকে দমাতে পারেনি, বরং তা ছড়িয়েছে অন্যান্য শহরে। মাপুচে জনজাতীয়রা প্রতিবাদে মুখর হয়েছেন। আন্দোলনে শামিল হয়েছেন তামার খনির শ্রমিকরা। মন্ত্রিসভায় ব্যাপক রদবদল করেও প্রেসিডেন্ট নিস্তার পাননি। বিদেশি সংবাদমাধ্যমকে তিনি জানিয়েছেন, পদত্যাগ তিনি করবেন না। দেশের মানুষ কিন্তু চাইছে তাঁর পদত্যাগ। চাইছে নতুন সংবিধান। শেষ পর্যন্ত সরকার নতুন সংবিধানের আশ্বাস দিয়েছে, কিন্তু প্রতিবাদীরা আইনসভার তৈরি শাসনতন্ত্রে আর সন্তুষ্ট নন। তাঁদের দাবি: জনমতের ভিত্তিতে জনসাধারণের জন্য নতুন সংবিধান— এক নতুন সামাজিক চুক্তি, যা সামাজিক ন্যায় সুনিশ্চিত করবে। সরকারকে বাতিল করতে হয়েছে অ্যাপেক এবং আসন্ন আন্তর্জাতিক পরিবেশ সম্মেলন।

এই ‘নেতৃত্বহীন’ সামাজিক আন্দোলনের মূলে আছে আর্থ-রাজনৈতিক অসঙ্গতি। এবং চরম আর্থিক বৈষম্যের মোকাবিলায় মানুষের কথা শুনতে নির্বাচিত রাজনৈতিক নেতৃত্বের অনাগ্রহ। শুধু চিলি নয়, আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল, পেরু, ইকুয়েডর, ভেনেজুয়েলা বা বলিভিয়া— লাতিন আমেরিকা জুড়ে জন-অসন্তোষ প্রকট। বস্তুত, পৃথিবীর নানা প্রান্তে এখন জীবিকার দাবিতে, আর্থিক নিরাপত্তা ও সামাজিক সুরক্ষার প্রশ্নে, গণতান্ত্রিক অধিকারের সন্ধানে নতুন সামাজিক লড়াই শুরু হয়েছে। ম্লান হতে থাকা বিশ্বায়নের এই মুহূর্তে ক্রমবর্ধমান আর্থিক বৈষম্যের দিকে নজর না দিলে, নতুন এই অসন্তোষের কথা না শুনলে নির্বাচিত শাসকেরাও যে শাসনের বৈধতা হারাতে পারেন, তেমন সঙ্কেত স্পষ্টতর। এই জনজাগরণ সার্বিক সামাজিক সুরক্ষার দাবিতে সামাজিক আন্দোলন। ভারতের মতো দেশেও এমন চাপা অসন্তোষ জন্ম নিচ্ছে কি? উত্তরের সন্ধান বোধ হয় জরুরি।

লেখক রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে অধ্যাপনারত

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement