বহুদিন আগে শোনা একটা গান— “একখানা ইট যদি পাওয়া যেত, নোংরা মুখটা করতাম থেঁতো, ভাবতে ভাবতে এগোলেন যিনি, তিনিও মানুষ”।
এটা ছিল গণপিটুনি নিয়ে একটা গান। আজকে সেই গানটার কথা মনে পড়ছে। শুক্রবার সকালে তেলঙ্গানা পুলিশ ‘ঘটনার পুনঃনির্মাণ’ করার উদ্দেশ্যে ৪ অভিযুক্তকে নিয়ে যায়। শোনা যাচ্ছে যে, তার পর ওই অভিযুক্তেরা পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। তখন তেলঙ্গানা পুলিশ তাদের গুলি করে মারে। এটা একটা ঘটনা। এর পিছনে আরও কিছু ঘটনা আছে। বিভিন্ন মিডিয়ার মাধ্যমে যা ক্রমশ সামনে আসছে। বেশ কিছু মানুষ ওই জায়গায় গিয়ে পুলিশের নামে জয়ধ্বনি দিচ্ছেন বা কেউ কেউ পুষ্পবৃষ্টিও করছেন।
মহম্মদ আরিফ (২৬), জল্লু শিবা (২০), জল্লু নবীন (২০) এবং চেন্নাকেশবুলু (২০)— এরা সবাই এখন মৃত। তারা সবাই আমার আপনার মতো মানুষই ছিল। হ্যাঁ, আমার-আপনার মতো মানুষরাই ধর্ষণ, গণধর্ষণ, এবং এমনকি মানুষকে জ্বালিয়ে দেওয়ার মতো কাজ করতে পারে। যে মানুষেরা সে দিন ওই মহিলাকে ধর্ষণ করেছিল, তারাও যেমন মানুষ, যে মানুষেরা আজকে এই ‘এনকাউন্টারে’ মেরে ফেলাটাকে সমর্থন করছেন, তাঁরাও মানুষ। আসলে প্রত্যেকটি মানুষের মধ্যে বেশ কিছু প্রবৃত্তি থাকে, সেগুলিকে উস্কে দেওয়া যায় তখনই, যখন সমাজের অসুবিধাগুলি যা বিদ্যমান সেগুলোর বিরুদ্ধে ক্ষোভ থাকে, কিন্তু কিছু করা যায় না। তখন এই ধর্ষণের মতো ঘটনায় আমরা যাঁরা মৃত্যুদণ্ড চাই, তাঁরাও কিন্তু মানুষ। কিন্তু আমরা এক বারও কি ভেবে দেখি যে, এর মধ্যে দিয়ে কী সমাধান সূত্র বেরোবে?
প্রথমত, ব্যক্তিগত ভাবে মনে করি, এই হায়দরাবাদের তরুণীকে ধর্ষণ করে পুড়িয়ে মারার ঘটনার পর সারা দেশ জুড়ে যে ক্ষোভের বাতাবরণ তৈরি হয়েছিল, সেটাকে সাত তাড়াতাড়ি ধামাচাপা দেওয়ার জন্যই এটা করানো হয়েছে। এবং সেটা খুব ঠাণ্ডা মাথায় কেউ করিয়েছে। সারা দেশে ঠিক যে ভাবে আজ থেকে সাত বছর আগে দিল্লির রাস্তায় মেয়েটিকে গণধর্ষণ করা হয়েছিল, তখনও সারা দেশ এ রকমই উত্তাল হয়েছিল। এই ভাবেই গর্জে উঠেছিল দেশ। কিন্তু তখন যাঁরা কেন্দ্রের শাসন ক্ষমতায় ছিলেন, তাঁরা কিন্তু এ রকম কোনও পদ্ধতির কথা ভাবেনি। কিন্তু আজকের শাসক খুব ভাল করে জানে কোনও আন্দোলন কতদূর যেতে পারে। তাই তাঁরা কোনও সুযোগ নিতে রাজি নয়।
ভয়টা অন্য জায়গায়। এই যে রাষ্ট্রশক্তির সমর্থনে গলা ফাটানো বা গণপিটুনি দিয়ে মারার সময়ে যে হিংস্র উল্লাস চোখে পড়ছে, সেটাই ভয়ের। বাস্তবটা কিন্তু হিন্দি সিনেমা নয়, যে এক জন পুলিশ অফিসার দুষ্টের দমন এবং শিষ্টের পালন করছেন। বাস্তব এটাই যে, আমাদের দেশের হিন্দি সিনেমার হিরো ফুটপাথে গাড়ি তুলে দিয়ে কিছু ঘুমন্ত পথশিশুকে মেরে ফেললে শাস্তি হয় তাঁর ড্রাইভারের। বাস্তবটা কিন্তু এটাই যে, এক জন বিধায়কের ছেলে এক জন মহিলাকে ধর্ষণ করে পুলিশকে পয়সা দিয়ে অন্য এক জনকে ‘অভিযুক্ত’ বানিয়ে তাঁকে গুলি করিয়ে মেরে দিতে পারে। বাস্তব কিন্তু এটা যে, বাবা রাম-রহিমেরা, চিন্ময়ানন্দ বা নিত্যানন্দেরা বহাল তবিয়তে ধর্ষণ করে বিদেশ চলে গিয়ে দেশ কিনে ফেলতে পারেন। বাস্তব এটাও যে, যাঁরা এই ঘটনাকে ‘ভুয়ো সংঘর্ষ’ বলছেন, তাঁদেরকেও ধর্ষণ করারই হুমকি দেওয়া হচ্ছে।
ধর্ষণ এক সংস্কৃতি। ধর্ষণকারীদের মেরে ফেলে কিংবা ফাঁসি দিলে যদি এই সমস্যার সমাধান হত, তা হলে তো ভারতে ধর্ষণ শব্দটাই আর হয়তো আজকে উচ্চারিত হত না। দেখা যাবে যে যাঁরা এই চোখের বদলে চোখের রাজনীতি বা নীতিতে বিশ্বাস করছেন— তাঁরা কি সব ক্ষেত্রেই এই একই রকম ভাবছেন? হয়তো না। যেখানে ছোঁয়া যায় না, সেখানে কিন্তু তাঁরা নিশ্চুপই থাকছেন। তা হলে কি এই ক্ষেত্রে তাঁরা নির্দিষ্ট লক্ষ্যপূরণ করলেন?
যেখানেই কথা বলা যাচ্ছে সেখানেই এক কথা— তা হলে কি ধর্ষণ করলেও পার পেয়ে যাবে? কিন্তু তাঁদেরকে যখন উদাহরণ হিসাবে দেখানো হচ্ছে যে, শুধুমাত্র রাজনৈতিক বা সামাজিক প্রতিপত্তি থাকলে এ দেশে অপরাধ করে পার পেয়ে যাওয়ার প্রবণতা যথেষ্ট বেশি, তখন কিন্তু তাঁরা উত্তর দিতে পারছেন না। তাঁরা বলছেন যে, এই তো সাংসদেরা সংসদে দাঁড়িয়ে ধর্ষণকারীদের ফাঁসির দাবি করছেন। তা হলে সাধারণ মানুষ ফাঁসি চাইলে দোষের কোথায়? এই তো দেশের মুখ উজ্জ্বল করা খেলোয়াড় এবং অভিনেতা-অভিনেত্রীরা গুলি করে মারাকে সমর্থন জানিয়েছেন, তা হলে সমস্যা কোথায়?
আসলে সমস্যা এখানেই। এক জন খেলোয়াড় বা রুপোলি পর্দার অভিনেতা-অভিনেত্রীরা যদি এই ধরনের অরাজকতাকে সমর্থন করে বসেন, তা হলে কোথাও এই কাজগুলি মান্যতা পেয়ে যায়। আমাদের সমাজ এই ভাবেই ভেবে অভ্যস্ত। কিন্তু যখন সংসদের ভিতর থেকেও এই আওয়াজের প্রতিধ্বনি শোনা যায়, তখন বোঝা যায়— গণতন্ত্র তার প্রায় শেষ সীমায় এসে দাঁড়িয়েছে। যখন সাংসদেরা সংসদে দাঁড়িয়ে ধর্ষণকারীদের গণপিটুনি দেওয়ার নিদান দেন, তখন কি মনে হয় না যে এই সাংসদেরা যে সংবিধানকে মান্যতা দিয়ে শপথ নিয়েছিলেন সেই সংবিধানকেই ‘পদদলিত’ করা হল? যখন দেশের মন্ত্রীরা প্রকাশ্যে বলেন যে, এটা অধমের সঙ্গে উত্তমের লড়াইয়ে উত্তমের জয় হল, যখন কেউ কেউ বলেন অন্য রাজ্যের পুলিশের এই ঘটনা থেকে অনুপ্রাণিত হওয়া উচিত, তখন ভয় হয়।
যখন মানুষ ওই হায়দরাবাদের পুলিশের উদ্দেশ্যে পুষ্পবৃষ্টি করছেন বা রাস্তাঘাটে কোনও নির্দিষ্ট দলের পক্ষ থেকে মিষ্টি বিতরণের ছবি আসে সংবাদপত্রের পাতায়, তখন হয়তো ওই সাংসদদের রাজনৈতিক যুক্তিকেই খানিকের জন্য সত্যি বলে মনে হয়। কিন্তু তখনও কি এটা মনে হয় না— এই যে মানুষের মধ্যে এই জমাট বাঁধা রাগ-ক্ষোভ, তাকে ঠিক পথে চালনার বদলে এই নেতা-মন্ত্রী বা সমাজের প্রতিপত্তি পাওয়া মানুষ জন এই হিংস্রতাকে আরও উস্কে দেওয়ার চেষ্টা করছেন? গত কয়েক বছরে যে ভাবে শত্রু খোঁজার মধ্যে দিয়ে অসংখ্য গণপিটুনির ঘটনা ঘটেছে, তখন কি এটা মনে হওয়া খুব অস্বাভাবিক যে মানুষের সুপ্ত রিপুগুলো কোথাও একটা জাগ্রত হয়ে গিয়েছে। এবং সেগুলো আপাতত নিয়ন্ত্রণের বাইরে।
অন্য দিকে, কী ভাবে আইন ব্যবস্থার উপরে মানুষের আস্থা ফেরানো যায়, তার দায়িত্বও কিন্তু সর্বোচ্চ আদালতের উপরেই বর্তায়। না হলে আমাদের মতো শ্রেণিবিভক্ত সমাজে মানুষের ক্ষোভকে খুব সহজেই অন্য দিকে চালিত করা যায়। বিশেষত, যেখানে অভিযুক্তের তালিকায় যারা আছে, তারা সমাজের শ্রেণিবৈষম্যের মাপকাঠিতে একেবারে নীচের তলায়। গরিব মানুষ, যাঁদের কোনও মতামত নেই, যাঁরা সমাজে শ্রম দেন কিন্তু চিরকাল ‘ওরা’ হয়েই থেকে যান। কোনও দিন সমাজের কেউকেটা হয়ে উঠতে পারেন না।
কেউ কেউ বলছেন— ‘‘আপনার বাড়িতে তো এই ঘটনা ঘটেনি, তাই আপনি এই এত বড় বড় তত্ত্বকথা বলতে পারছেন।’’ তাঁকে যদি রেণুকার কথাগুলো উল্টে শোনানো যায়, তখন উনি কী বলবেন জানার খুব ইচ্ছে রইল। রেণুকা হলেন যে চার অভিযুক্ত এনকাউন্টারে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গিয়েছে, তাদেরই এক জনের অন্তসত্ত্বা স্ত্রী। তিনি বলছেন— ‘‘আমাকেও ওই জায়গায় নিয়ে চলুন, নিয়ে গুলি করে মেরে ফেলুন, আমার স্বামী সত্যি দোষী ছিল না।’’
কে দোষী, কে নির্দোষ— সেই প্রমাণ কিন্তু পাওয়া গেল না। অন্য দিকে, ভুয়ো সংঘর্ষে ভুল মানুষকে, নিরীহ গ্রামবাসীদের মারার উদাহরণও কিন্তু আমাদের রাষ্ট্রে রয়েছে। শেষে একটাই প্রশ্ন— চোখের বদলে চোখ, এই দৃষ্টিভঙ্গি, সারা পৃথিবীকেই এক দিন অন্ধ বানিয়ে দেবে না তো?
লেখক: কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস্তুকার ও সমাজকর্মী