হাজার কোটির ব্যবসা দ্বিতীয় সপ্তাহান্ত ফুরনোর আগেই। ইংরেজি নয়, হিন্দি নয়, একটি তেলুগু ছবি। তার দৌলতেই এই বাংলার সদর-মফস্সলে ধুঁকতে থাকা সাবেকি হলগুলোর সামনে বহু কাল পরে হাউসফুল বোর্ড। হলমালিকরা দেওয়াল লিখনটা পড়তে ভুল করেননি। সে কারণেই ‘বাহুবলী’কে একটা দক্ষিণী ছবি হিসেবে না দেখে, এমনকী বাংলা-হিন্দি ছবিকেও সরিয়ে রেখে, তাকে সাগ্রহে জায়গা ছেড়ে দিয়েছেন।
ঘটনাটিকে একটি বিচ্ছিন্ন দৃষ্টান্ত ভাবলে ভুল হবে। বরং অনেক কাল বাদে ‘বাহুবলী’ যে ভাবে সিনেমা হলগুলোকে অক্সিজেন দিয়ে গেল, তার অন্তর্নিহিত তাৎপর্যটা বোঝার চেষ্টা করা দরকার। এবং সে ক্ষেত্রে বাংলার উদাহরণটাই সবচেয়ে বেশি প্রণিধানযোগ্য। কারণ, বেশ কিছু দিন ধরেই বাংলা ছবির বাজার, বাংলায় ছবির বাজার নিয়ে আলোচনায় সাবেক সিনেমা হলগুলোর দুর্দশার প্রসঙ্গটা বারে বারে উঠে আসছে। টেলিভিশন এবং ডিজিটাল মিডিয়ার বাড়বাড়ন্ত সারা পৃথিবী জুড়েই বড় পরদার ব্যবসায় থাবা বসিয়েছে। পাইরেসি সর্বত্রই সিনেমা ব্যবসায়ীদের মাথাব্যথা। এই সার্বিক সংকটটাই আবার বাংলায় আরও বেশি করে আছড়ে পড়েছে, কারণ এখানে এমনিতেই বাজার ছোট এবং সে বাজারও ক্রমশ ক্ষয়িষ্ণু। আর পাঁচটা রাজ্যের তুলনায় বাংলায় সিনেমা হলের সংখ্যা কমে যাওয়া, যে ক’টা হল এখনও টিকে আছে তাতে দর্শক সমাগম না হওয়া, হলগুলোর ভাঙাচোরা অবস্থা, মাল্টিপ্লেক্সের সংখ্যা যথেষ্ট না বাড়া, মাল্টিপ্লেক্সে টিকিটের দামও একটা বড় অংশের হাতের বাইরে চলে যাওয়া— এবম্বিধ কথাবার্তা কিছু দিন ধরেই নানা পরিসরে আলোচিত হচ্ছে।
সিনেমা ব্যবসার সার্বিক সংকট আর বাংলার দুর্গতি কিন্তু পরস্পর-বিচ্ছিন্ন নয়। চাহিদা থাকলে জোগান বাড়বেই। দর্শক যদি বেশি করে হলমুখী হন, সিনেমা হলের শনির দশা আপসেই কাটতে থাকবে। ‘বাহুবলী’ সেটাই করে দেখিয়েছে। আর সেখানেই জন্ম নিচ্ছে দুশ্চিন্তা। অন্য এক দুশ্চিন্তা।
গ্রামে-গঞ্জে-শহরে-মফস্সলে এই যে সবাই ঊর্ধ্বশ্বাসে ‘বাহুবলী’ দেখতে দৌড়চ্ছেন, যে সব হল এত দিন মাছি তাড়াচ্ছিল সেগুলোও কী রকম ভরভরন্ত হয়ে উঠছে, এর পিছনে ম্যাজিকটা কী? কারণ, ‘বাহুবলী’ একটা চোখধাঁধানো জাঁকালো অতিকায় বাজারি মহাকাব্য, যেটা দর্শককে বোঝাতে পেরেছে এ জিনিস হলে গিয়ে না দেখলে মজা নেই! এমন বায়োস্কোপ আমি বানিয়েছি, যা স্মার্টফোন কি ল্যাপটপ বা টিভির পরদায় আঁটে না। অতএব দর্শক বাবাজীবন, নড়েচড়ে হলে পৌঁছও, নইলে কী হারাইবে তাহা তুমি জানো না!
প্রশ্ন উঠতেই পারে, এ তো ভাল কথা! জীর্ণ শীর্ণ বড় পরদা আজ অনেক দিন বাদে মাথা তুলে বলছে, দেখো হে! আমি ফুরিয়ে যাইনি! এতে আনন্দের বদলে দুশ্চিন্তার কথা কেন?
দুশ্চিন্তা আছে। এবং খুব বেশি করেই আছে। সেটা বড় মাছ ছোট মাছকে গিলে খাওয়ার দুশ্চিন্তা। বড় বাজার এসে ছোট বাজারকে হটিয়ে দেওয়ার দুশ্চিন্তা। বাংলা ছবির সাপেক্ষে হলিউড-বলিউডের সঙ্গে দক্ষিণী ছবিও যে এ বার নতুন প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠল, সেই দুশ্চিন্তা। এবং এ সব কিছুর উপরে সিনেমা এবং বড় পরদার ভবিষ্যৎ গতিবিধি নিয়ে গভীর দুশ্চিন্তা।
একটু বিশদ করা যাক। একটা ‘বাহুবলী’ কি একটা ‘দঙ্গল’ কি একটা ‘সুলতান’-এর হাত ধরে যদি বড় পরদা তার সুদিন ফিরে পায়, তাতে এমনিতে আপত্তির কিছু নেই। কিন্তু ক্রমশ যদি দেখা যায়, একটা নির্দিষ্ট ধরনের সিনেমাই বড় পরদায় সাফল্য পাওয়ার চাবিকাঠি হয়ে উঠছে, সেটা সামগ্রিক ভাবে চলচ্চিত্র-কলার পক্ষে খুব ভাল কথা নয়। ‘বাহুবলী’র ঝড়ে বাংলা ছবি শো পাচ্ছে না, এমন একটা অভিযোগ ইতিমধ্যেই উঠেছে। শুধু ‘বাহুবলী’ কেন, বড় বাজেটের যে কোনও হিন্দি ছবি মুক্তির সময়েও এমনটা আকছার ঘটে। হলমালিকরা বলবেন, লোকে যে ছবি দেখবে আমরা তো সেই ছবিই চালাব। পরিবেশকরা বলবেন, যে ছবি টাকা দেবে, সেই ছবিই তো বেশি করে ছাড়ব!
খুব সত্যি কথা। অকাট্য যুক্তি। এবং সেই যুক্তির সামনেই ফিরে আসছে একটি অতি পুরনো কথা। চলচ্চিত্রের বটগাছেরা যা অতীতে বার বার বলে গিয়েছেন— ‘দর্শকরাই সবচেয়ে বড় পাঁচিল’! দর্শকরাই যদি ঠিক করে নেন, হলে যাওয়ার সময়, শ্রম এবং পয়সাটুকু তাঁরা কেবল ‘বাহুবলী’-জাতীয় ছবির জন্যই রেখে দেবেন, বাকি সব মোবাইল বা ল্যাপটপে বা টিভিতে দেখে নিলেই চলবে, তাতে যে ক্ষতিটা হবে সেটা অতি গভীর। সিনেমার দৃশ্যভাষাই তখন ক্রমশ সংকুচিত হতে থাকবে। অন্য ধরনের ছবি বড় পরদায় দেখতে পাওয়ার পথ আরও রুদ্ধ হতে থাকবে। দর্শক সত্যিই জানতে পাবেন না, তাঁরা কী হারাইলেন! কারণ, নানা ধরনের ছবি দেখার চোখটাই তাঁদের তৈরি হবে না।
একটা ছবিকে ছবির মতো করে রসাস্বাদন করতে হলে যে বড় পরদাতেই দেখতে হয়, এই বোধটাই ইদানীং অনেকাংশে পিছু হটতে শুরু করেছে। কেব্ল টিভি, স্মার্টফোন, সোশ্যাল মিডিয়ার বিস্ফোরণ সবচেয়ে আগে গিলে খেয়েছে নিবিষ্টতার অভ্যাসকে। অখণ্ড মনোযোগ শব্দবন্ধটি এক্ষণে সোনার পাথরবাটি। চিত্রপরিচালকদের প্রধান মাথাব্যথা হয়ে দাঁড়াচ্ছে, কী উপায়ে দু’টি ঘণ্টা দর্শকের চোখকে যেন তেন প্রকারেণ পরদায় টেনে রাখা যায়। গল্পে মুহুর্মুহু চমক আর মোচড় আমদানি করো, জগঝম্প আবহসংগীত বাজাতে থাকো, দ্রুত কাট-নির্ভর সম্পাদনায় যাও, সংলাপে যত্রতত্র পাঞ্চলাইন গোঁজো, যত পারো ক্লোজ আপ দেখাও... তার মধ্যেও দর্শক এক চোখ পর্দায় রেখে, অন্য চোখে ফেসবুকে আপডেট দিতে থাকবেন...
আধুনিকতার শবদেহে পা গেঁথে দাঁড়ানো দুনিয়া স্পেকট্যাক্ল-এর দুনিয়া। দর্শক প্রতি পলকে স্পেকট্যাক্ল দেখতে চায়, নিজে স্পেকট্যাক্ল হতে চায়। এই চক্করে স্পেকট্যাক্ল-এর যে বাজারি সংজ্ঞা প্রতিনিয়ত নির্ধারিত হতে হতে চলেছে, বিপদটা সেখানেই লুকিয়ে। এক ধরনের স্পেকট্যাক্ল-ই আসলে স্পেকট্যাক্ল, বাকিরা তুশ্চু, এমন একটা অশনি সংকেত যেন টের পাওয়া যাচ্ছে। কাটাপ্পার টক্করটা স্পেকট্যাক্ল, অতএব বড় পরদা। আরা-র আনারকলিকে মোবাইলে দেখে নিলেই চলবে, এ রকমটাই ভাবতে অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছি আমরা। সেটা সিনেমা ব্যবসায়ীরাও দিব্যি জানেন। ফলে একটা ‘হারামখোর’ বা একটা ‘মুক্তি ভবন’ আর ভাল হলে ভাল শো পাচ্ছে না।
এমতাবস্থায় যুগোপযোগী চিত্রভাষা যে রাস্তা নেওয়ার, সে রাস্তাই নিয়েছে। বাণিজ্যসফল ছবির সাম্প্রতিক প্রবণতার দিকে নজর দিলে কমবেশি চারটি ধারা চোখে পড়ে। এক, বড় বাজেটের বড় ছবি। বড় তারকা, বড় আড়ম্বর, বড় ক্যানভাস। দুই, থ্রিলারের বাড়বাড়ন্ত। গতি আর সাসপেন্সের খেলা। তিন, সিনেমা যেখানে টেলিভিশনের বড় ভাই। ছোট পরদার সিরিয়াল-দর্শক বড় পরদায় বৈঠকখানার আমেজ পেয়ে হেসেকেঁদে খুশ। চার, ইউটিউবে ছোট ছবির রমরমা। মোবাইল-ট্যাবের মাপ বুঝে বানানো টুকরো গল্প, মিনিট পনেরোর মামলা।
আবারও বলা যাক, নতুন যুগের নতুন ছবি নতুন কায়দায় তৈরি হওয়াতে দুঃখের কিছু নেই। কিন্তু ছোট গল্পের বাজার ভাল বলে উপন্যাস লেখা হবে না আর উপন্যাসের তাকে হ্যারি পটার এসে গেছে বলে টং লিং থাকবে না— এমনটা হলে দুঃখের কথা, দুশ্চিন্তার কথা বইকী! বাহুও থাক, বলও থাক। শুধু বোধটুকুকে একেবারে বাতিলের খাতায় ফেলে না দিলেই হল!