পুরুষসিংহ: নারী এবং নৃশংস হাঁ-মুখের সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলেছে। খাজুরাহোর মন্দিরে ভাস্কর্য
একটা মেয়ে যদি রাত্তির সাড়ে বারোটার সময় রাস্তায় ঘুরে বেড়ায়, তার দোষ নেই? আর মদ খেয়ে কয়েকটা ছেলে তাকে তাড়া করলে দোষটা তাদের হয়ে গেল? এর পর তো সুন্দরবনের জঙ্গলে তুমি শিস দিয়ে ঘুরবে আর বাঘে ধরলে বলবে বাঘের চরিত্র খারাপ! বিজেপির নেতা বলেছেন, হরিয়ানা কাণ্ডে মেয়েটি অত রাতে রাস্তায় কী করছিল? তার বাপ-মা’ই বা কেন তাকে রাতে রাস্তায় ঘুরতে দিয়েছিলেন? অত্যন্ত সংগত প্রশ্ন। হিটলার না-হয় ইহুদিদের সাবাড় করেছেন, ইহুদিরা কি তাদের কাজেকর্মে হিটলারকে প্ররোচিত করেনি? চণ্ডীগড়ের মেয়েটি কি জানত না, সমাজে থাকতে গেলে নিজের সম্মান বাঁচিয়ে, সরে-সরে, এড়িয়ে চলতে হয়? সে শেখেনি, বুকের সামনে একটা ফাইল নিয়ে চোখ নিচু করে পাড়ার লোফারদের রক পেরিয়ে যেতে হয়? সে অত রাতে গাড়ি হাঁকিয়ে ঘুরবে আর অন্য লোকের তার সঙ্গে টক্কর নেওয়ার লোভ জাগবে না? বিজেপি নেতাটিকে গাল চলছে, পলিটিশিয়ানদের গালি দিলে এখন ইমেজ ঝকঝকায়, কিন্তু ভারতের প্রকৃত মূল্যবোধগুলো এখন রাজনৈতিক নেতানেত্রীরাই স্পষ্ট বাক্যে, বেপরোয়া দাপটে প্রকাশ করে চলেছেন।
এই তো ক’বছর আগে পার্ক স্ট্রিটে গাড়িতে তুলে একটি মেয়েকে ধর্ষণ করা হয়েছিল, তখন তৃণমূলের এক পাণ্ডা রসিয়ে টিভি চ্যানেলে যা বলেছিলেন, জুস করলে দাঁড়ায়: সারা রাত্তির মদ খেয়ে আর ছেলেদের সঙ্গে বেলেল্লাপনা করে যে বেড়ায়, সে কী ধরনের মেয়ে? তার সঙ্গে অশালীন কাণ্ড হয়ে থাকলে তা কি সত্যিই বিরাট অপরাধ? সেই ব্যবহারের অনেকটাই কি মেয়েটিই সেধে ডেকে আনেনি? অন্য বহু নেতাও এই থিমে বেজেছেন, মেয়েদের মিনিস্কার্ট জিন্স মোবাইল ফেসবুক নিয়ে সুদৃঢ় আপত্তি শানিয়েছেন। খাপ পঞ্চায়েতগুলোও এই ক্ষেত্রে দুরন্ত ইতিবাচক শাস্তি দিয়েছে। সারা ক্ষণ অন্যকে আশকারা দেব, উত্তেজনা উসকে দেব, তার পর সে ঝাঁপিয়ে পড়লে চাড্ডি নারীবাদী লব্জ দিয়ে সাফাই গাইব, এ তো সততার অপমান।
সাধারণ লোকও হাই-ফাই মেয়েকে গাঁট্টা কষানোরই পক্ষে। যে মেয়ে ফকফক সিগারেট খেতে খেতে হাফপ্যান্ট পরে বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে ঢলাঢলি করে ভরা পাড়া দিয়ে হাঁটে, তাকে দেখলে সাচ্চা ভারতীয়রা স্বতঃস্ফূর্ত খ্যাঁক মেরে তেড়ে যায়। কারণ, নিজের সমীচীন-ধর্ম ভুলে, আধুনিক মেয়েদের যেন নম্রতার, লাজুকতার বিরুদ্ধে একটা জেহাদ এসেছে। যেন স্মার্টনেস মানে কর্কশ চলা-বলা, মাঝরাত অবধি পার্টি করে মদ গিলে টলতে টলতে ফেরা। বিপদ কিন্তু এদেরই হয়। যে মেয়েরা বিকেল পাঁচটার মধ্যে বাড়ি ফিরে এসেছে, যে মেয়েরা দল বেঁধে কলেজ যাচ্ছে ও দল বেঁধে ফিরছে (এবং দলে ছেলে ঢুকতে দেয়নি), যারা চুপচাপ সন্ধে থেকে ঘরে বসে সিরিয়াল দেখছে, তাদের কি কেউ তাড়া করেছে? ধর্ষণ করেছে? নিজেকে রক্ষার কৌশলগুলো তুমি নিজে বুঝে নেবে না? কেউ তর্ক করছে, প্রশাসন কেন মেয়েদের রক্ষা করবে না? আরে, তুমি ডেলি ভারতীয় মূল্যবোধকে কলা দেখাবে, কিছুতে ঘরোয়া সুশীলা হবে না, আর বিপদে পড়লে অমনি ভারতীয় প্রশাসনের শরণ নেবে, এ তো দুমুখো-পনা! কেউ বলছে, ছেলেরা কেন নিজেদের সংযত করবে না? আত্মসংবরণের দায় কেন তাদের নেই? কী মুশকিল, এ তো ছেলেদের শরীরধর্ম। তার হরমোন নিঃসরণ তো তার হাতে নেই। কোনও ছেলেই ইচ্ছে করে ধর্ষণ করে না। আপ্রাণ চেষ্টা করে, না-করার। কিন্তু, ডায়েটিং-এর প্রতিজ্ঞা শেষ অবধি ক’জন রাখতে পারে? ক’জন সামনে রগরগে ফুচকা দেখেও মুখ নিচু করে তেত্তিরিশের নামতা জপতে পারে?
মেয়েরা কি ফুচকা? ভোগ্যবস্তু? সেক্স অবজেক্ট? আলবাত। ভোগ্যবস্তু বলেই তো তাদের নিয়ে রাশি রাশি গান, কোটি কোটি ক্যানভাসে ভাস্কর্যে তাদের নগ্নতা ডিটেল-সহ ঝলমল, সাহিত্যে ফিল্মে তাদের রূপের উন্মোচন, স্তব। কালিদাসেও তাই, পর্নোগ্রাফিতেও। সামান্য শিল্পবোধ থাকলেই বোঝা যায়, মেয়েরা ভোগ্য, তাই এক্সট্রা ছোঁকছোঁকের যোগ্য। এই যদি কোনও মেগা-নেতার দামি গাড়ি রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকে, আর কিছু গরিবগুর্বো হুড়ু়মদাড়ুম গাড়িটায় উঠে পড়তে চায়, আর তা না পেরে গাড়িটাকে ইট দিয়ে পিটিয়ে পিটিয়ে ভাঙে, কারণ গাড়ি ভোগ্যবস্তু এবং তাদের সেটা দেখে লোভ জেগেছে, তা হলে নেতা কি ইটবাজদের দোষ দেবেন? কক্ষনও না। তিনি জিভ কেটে বলবেন, ভুল তাঁরই, গাড়ি গ্যারেজে রেখে পায়ে হেঁটে যেতে হত।
সব বুঝেও বহু লোক আলজিভ কাঁপিয়ে চিৎকার করছে, মেয়েরা আর ছেলেরা সমান। আরে, সাম্য তো একটা অনুচিত ধারণা। এ কখনও হয়, বেদ-উপনিষদের ধ্বজাধারী হিন্দু, আর গো-হন্তারক মুসলিম সমান? টকটকে ফরসা উচ্চবর্ণীয় জমিদার, আর নর্দমা সাফ-করা কেলেকুচ্ছিত দলিত সমান? দুনিয়াকে দুদ্দাড়িয়ে অধিকার করা দিগ্বিজয়ী পুরুষ, আর ন্যাকা, লতানে, ২৪x৭ ধর্ষণের ভয়ে কাঁপতে থাকা নারী সমান? তা হলে তর্ক করে এও প্রমাণ করা যায় যে রামমোহন রায় ও তাঁর বাড়ির কেন্নো সমান। কারণ দুজনেরই প্রাণ আছে ও প্রাণের অধিকার আছে। সোজা কথা, মেয়েরা দেহে আনফিট, মনে কাঁদুনে, আর রূপের পুঁটুলি ভোগের রসগোল্লা, তাই তাদের নিরাপত্তার জন্যেই, সস্নেহ উদ্বেগে, ছলছল মমতায়, ছেলেরা তাদের ঘরের মধ্যে দামড়ে ঠুসে দিয়েছে। আর দিয়েছে বলেই এ দেশ এত জন অসামান্য সন্তান পেয়েছে। কারণ তাদের মায়েরা, সন্তানদের আয়ার ঘাড়ে ফেলে ড্যাংডেঙিয়ে অফিস করতে বেরিয়ে পড়েনি। সন্ধেয় বাড়ি ফিরে ছেলেকে দুটো প্রতীকী চুমকুড়ি দিয়ে ফের রাতে ফুর্তি করতে হুউউস মারেনি। তারা সারা দিন বাড়িতে থেকে, প্রাণ দিয়ে বাচ্চা মানুষ করেছে। এই দায়িত্ব পেয়ে রোমে রোমে অনুভব করেছে, তারা মায়ের জাত। অকল্পনীয় মহান দেশ এই ভারত, যা কতকগুলো ভোগ্যবস্তুকে অলৌকিক সম্মান দিয়েছে, বেদি গড়ে তার ওপরে তাদের প্রতিষ্ঠা করেছে। মেয়েরা অবশ্যই স্বামীর সঙ্গে রাত্রিবিলাসে অনাগ্রহী হলে তাদের কিলিয়ে কাঁটাল পাকানো হবে, কিন্তু তার পরেই ফের তাদের ঘেঁটি ধরে বেদিতে চড়িয়ে দেওয়া হবে। কারণ বাচ্চার ভিজে কাঁথা পরিষ্কার করবে দেবীর জাত, মায়ের জাত। তাই পুরুষরা যদি বা বখে যেতে পারে, নারীদের বখে যেতে দেওয়া যায় না। কারণ, তারা সন্তান গড়ে তুলবে। সমাজের সেরা মূল্যবোধগুলো ভাবী নাগরিকদের মধ্যে বুনে দেবে। সন্তান যদি দেখে, মা মাঝরাতে বাড়ি ফিরছে অন্য কাকুর গলা জড়িয়ে, কী শিখবে? মা দুপদুপ করে চললে, চটুল গানের সঙ্গে কাঁকাল দুলিয়ে নাচলে, সে কোন সুকুমার বৃত্তি আয়ত্ত করবে?
মেয়েদের প্রতি এই অশেষ শ্রদ্ধার জন্যই তাদের কাছে ভারতের পুরুষেরা মহাকাব্যিক আত্মনিয়ন্ত্রণ, আত্মশৃঙ্খলা দাবি করে। শিক্ষক যেমন মদ খেয়ে ক্লাসে পড়াতে পারেন না, নারীও তেমন নিজের আনন্দকে অগ্রাধিকার দিয়ে জীবন যাপন করতে পারে না। তাকে নিজেকে বঞ্চিত করে যেতে হবে ক্রমাগত, যাতে এক কণা পাপ, এক ছটাক কালিও তার চরিত্রে না লাগতে পারে। সন্তান যেই দেখবে, নিরন্তর আত্মত্যাগের মধ্যে দিয়ে মা মাসি মামি কাকি হয়ে উঠছেন শুদ্ধ ও স্বেচ্ছা-অবরুদ্ধ, তাঁরা স্বাধীনতার আলোর দিকে মথের মতো ফড়ফড়িয়ে ধাবিত হচ্ছেন না, তখনই তার মাথা এঁদের প্রতি শ্রদ্ধায় নুয়ে আসবে। স্বাধীনতা দিয়ে কী হবে? রাস্তায় বেরিয়ে কী হবে? বিপদ বাড়বে। তার চেয়ে নিজের ঘরে, নিজের সংসারে, চার দেওয়ালের মধ্যে, স্বামী সন্তান নিয়ে, অনেক মর্যাদা শান্তি ও নিরাপত্তায় বাঁচা যাবে। দেশের গার্জেনরা এই ভারতই গড়ে তুলতে চান। শান্তির নীড়। তাতে কেন ধরবে চিড়?
মনে রাখতে হবে, নূতন ভারতকে হয়ে উঠতে হবে প্রাচীন ভারত। কারণ সেই ভারতেই ছিল পক্ষীরাজ ঘোড়া, লস্যির ঝরনা, পোকাহীন তপোবন। নতুন ভারতে সংস্কৃত উদাত্ত মন্ত্রোচ্চারণ রণিবে, অবশ্য মোবাইলে অন্য ভাষায় চুটকি। দাড়িওলা ঋষি মিনিটে দুশো কপালভাতি করবেন, অবশ্য রিয়েলিটি শো-র জাজও হবেন। একটু-আধটু চেঞ্জ করে অ-দূষিত যবন-রহিত পবিত্র পুরাকালকে ফিরিয়ে আনার দায়িত্ব নিয়েছেন ভারতীয় কত্তাকুল। তাই সে দেশে মেয়েরা স্মাইলিমুখে হাঁটু গেড়ে বসে থাকবে। হাঁটু অপারেশন করতে হলে জিএসটি মকুব করে দেওয়া হবে। মিটে গেল।