Coronavirus

মহামারি না কি অনাহার, বেঁচে থাকার উত্তর খুঁজছেন কৃষকেরা

বিনামূল্যে রেশন ব্যবস্থার সঙ্গে সঙ্গে গরিব মানুষের হাতে টাকা তুলে দিতেই হবে। না হলে এই পরিস্থিতিতে আগামী মাসগুলিতে চাষে উৎসাহ হারাবেন কৃষকেরা। এখন চিন্তা, দেশের বিরাট সংখ্যক মানুষকে দারিদ্র্য আর আমপানের পর গ্রামীণ অর্থনীতির মুখ থুবড়ে পড়া মানুষকে অনাহারের পথে ঠেলে দেবে না তো?

Advertisement

শুভদীপ দাশগুপ্ত

শেষ আপডেট: ২৯ মে ২০২০ ০৪:১১
Share:

ছবি পিটিআই।

সারা বিশ্বের জনস্বাস্থ্য, সমাজ ও অর্থনীতি আজ চূড়ান্ত বিপর্যয়ের মুখোমুখি। কোভিড ১৯-এর ধাক্কায় অধিকাংশ দেশ প্রায় সম্পূর্ণ লকডাউনের রাস্তায় হাঁটতে বাধ্য হচ্ছে। অন্য দিকে, চিন্তায় ফেলছে মৃত্যুমিছিলের ভ্রুকুটির সামনে অর্থনীতির এই থমকে যাওয়া।

Advertisement

এখন চিন্তা, দেশের বিরাট সংখ্যক মানুষকে দারিদ্র্য আর আমপানের পর গ্রামীণ অর্থনীতির মুখ থুবড়ে পড়া মানুষকে অনাহারের পথে ঠেলে দেবে না তো? লকডাউনের দ্বিতীয় ধাপের পর থেকেই বেশ কিছু নয়া নির্দেশিকা জারি করেছে কেন্দ্রীয় প্রশাসন। যে সব এলাকা হটস্পটের আওতায় নেই, সেখানে কৃষিকাজ, নির্দিষ্ট কিছু মান্ডি থেকে কৃষিজ দ্রব্যের বিক্রিবাটায় অনুমতি দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়াও দুধ, দুগ্ধজাত দ্রব্য, পোলট্রি, চা, কফি, রবার চাষ ফের শুরু হবে বলে জানানো হয়েছে। অর্থাৎ, দেশের এই চরম সঙ্কট মুহূর্তে চিরকালের বঞ্চিত অবহেলিত গ্রামীণ কৃষি-অর্থনীতি, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ-সহ গ্রামীণ এলাকাভিত্তিক শিল্পই সরকারের কাছে ঘুরে দাঁড়ানোর একমাত্র রাস্তা হিসাবে সামনে আসছে।

আমরা প্রশ্ন দিয়ে কৃষিক্ষেত্রে কোভিড ১৯ ও লকডাউনের প্রভাব বোঝার চেষ্টা করতে পারি। এক, পৃথিবীতে, সর্বোপরি আমাদের দেশে কি তার মানুষদের খাওয়ানোর জন্য পর্যাপ্ত খাবার রয়েছে? দুই, সাশ্রয়ী মূল্যে কি বাজারে খাদ্যফসল পাওয়া যাচ্ছে? তিন, কৃষকেরা কোন কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে দাঁড়িয়ে লড়াই চালাচ্ছেন? এই প্রশ্নগুলোর মধ্যেই হয়তো আশু করণীয় সরকারি পদক্ষেপের সুস্পষ্ট ধারণা পেতে পারি।

Advertisement

বর্তমানে ভারতে ও অনেক দেশেই পর্যাপ্ত খাবারের মজুদ রয়েছে। ভারতের খাদ্যশস্যের উৎপাদন ২০১৯-২০২০ সালে প্রায় ২৩ কোটি টন হবে বলে অনুমান করা হচ্ছে। ২০২০ সালের ১ মার্চ, ভারতের খাদ্য কর্পোরেশন (এফসিআই)-এর সঙ্গে গম এবং ধানের মোট মজুদ ছিল ৭.৭৫ কোটি টন। একই ভাবে ডালশস্যের ক্ষেত্রে, ২০২০ সালের মার্চ মাসের মাঝামাঝি সময়ে ভারতে ২২.৫ লক্ষ টন মজুত ছিল। উভয় ক্ষেত্রেই রবিফসল ২০২০ সালের এপ্রিল মাস থেকে উঠেছে এবং পরিস্থিতি আরও আশাপ্রদ হবে বলে আশা করা হচ্ছিল। কিন্তু আমপান পরবর্তী সময়ে সেটাও কতটা সম্ভব, এর জন্য আলাদা করে অর্থনীতি বুঝতে হয় না। অন্য দিকে, যেহেতু আন্তর্দেশীয় বাণিজ্য এখন প্রতি দিন সঙ্কুচিত হচ্ছে এবং সরবরাহে বাধা যদি অব্যাহত থাকে, এই রকম একটি দীর্ঘায়িত লকডাউন অনেক দেশেই খাদ্য সুরক্ষা ব্যবস্থাকে চরম ক্ষতিগ্রস্ত করে তুলবে। যদি লকডাউন আরও বেশি দিন চলতে থাকে, তবে সারা দেশেই খাদ্য ঘাটতির মুখোমুখি হওয়ার আশঙ্কা থেকে যাচ্ছে।

পাশ্চাত্য বিশ্বে, অনেকটা আতঙ্কে ক্রয় এবং মজুত করার কারণে খাদ্যের দাম বাড়ছে। ভারতে খাবারের দাম এখনও বাড়েনি। লকডাউনের পরে খাদ্যদ্রব্যগুলির, বিশেষত, দরিদ্রদের মধ্যে খাদ্যসংগ্রহ তুলনামূলক কমেছে, যা ভারতীয় খাদ্যমূল্যকে কম রেখেছে। অর্থাৎ মহামারি পরবর্তী দারিদ্র, বেকারত্ব, ও উপযুক্ত বাজারিকরণের অভাবে খাবারের মূল্যস্ফীতি যেমন এখনও বাড়েনি তেমনই এই সময়ে একসঙ্গে ভূমিহীন, ছোট ও মাঝারি কৃষকদের তীব্র শ্রমঘাটতি, মাঠের ফসলে দাম হ্রাস এবং উৎপাদিত দ্রব্যের বাজারে পৌঁছানোর অভাবের পরিস্থিতি দেখা যাচ্ছে। কারা উপকৃত হচ্ছেন তা স্পষ্ট নয়। তবে কৃষক, শ্রমিক এবং দরিদ্রেরা দুশ্চিন্তায় আছেন।

সমস্যা হচ্ছে, চাহিদা এবং সরবরাহ উভয়ই একসঙ্গে পড়ে গেলে খাদ্যদ্রব্যের দাম কী ভাবে আচরণ করবে, সে সম্পর্কে সব সময়ে অনিশ্চয়তা থেকে যায়। ফসলের উৎপাদন, মজুত, পণ্য সরবরাহে সমস্যা এবং বিভিন্ন বাজারে জোগান— এই বিষয়গুলি আনাজ ও ফসলের মূল্যের যথেষ্ট পার্থক্য করে দেয়। তবে ২০২০ সালের মার্চ মাসে পশ্চিমের অর্থনীতিতে চাল ও গমের খুচরো দাম বাড়ছে। এর প্রধান কারণ— পরিবারগুলির দ্বারা আতঙ্ক ক্রয়, দেশগুলির দ্বারা রফতানি নিষেধাজ্ঞা এবং অব্যাহত সরবরাহ ব্যবস্থা ব্যাহত হওয়া। তবে পশ্চিমাদের মতো নয়, লকডাউনের পরে ভারতে খাদ্যের দাম বাড়েনি। সরবরাহ কমেছে, চাহিদাও কমেছে।

ফসল উৎপাদন, ঝাড়া ও বাজারিজাতকরণের যে ধারাবাহিক প্রক্রিয়া, তার সঙ্গে জড়িত রয়েছেন দেশের ৬০ শতাংশের বেশি কৃষিনির্ভর মানুষ। আজ তাঁদের অমানবিক দারিদ্রের পরিবেশে প্রতিনিয়ত লড়াই করা জীবন ক্রমশ কঠিন সমস্যার মুখে পড়ছে। এর পিছনে যে কারণগুলি উঠে আসছে, সেগুলি হল— (ক) সরকারি সংস্থাগুলির দ্বারা খাদ্যশস্য সংগ্রহ ব্যাহত হওয়ার কারণে ভারতজুড়ে ফসলের সংগ্রহ ও বিপণনে সঙ্কট রয়েছে। (খ) ব্যবসায়ীদের খামার থেকে ফসল সংগ্রহের ক্ষেত্রে বাধা। (গ) রবিফসল কাটাতে শ্রমিকের অভাব। (ঘ) ট্রাক চালকের অভাব। (ঙ) পণ্য পরিবহণে অবরোধ। (চ) কিষাণ মান্ডিগুলোর সীমাবদ্ধ কার্যক্রম। (ছ) খুচরো বাজারে শাটডাউন।

প্রবাসী শ্রমিকদের বাড়ি ফিরে যাওয়ায় রবিফসল কাটার কাজ কিছুটা ব্যাহত হচ্ছে এবং কৃষকেরা জমিতেই ফসল ফেলে রাখতে বাধ্য হচ্ছে। ফসল তোলা বা ঝাড়ার ক্ষেত্রে যন্ত্রের ব্যবহার করা গেলেও পশ্চিমবঙ্গের মতো অনেক রাজ্যেই ছোট-মাঝারি কৃষকদের মধ্যে এর সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। এ ছাড়া চালক/ অপারেটরের অভাব রয়েছে। বেশির ভাগ রাইস মিলগুলি পরিযায়ী শ্রমিকদের নিয়ে কাজ করে এবং তাদের নিজের বাড়িতে ফিরে আটকে যাওয়ার অর্থ এই মিলগুলির কৃষকদের কাছ থেকে ধান কেনার ও দৈনন্দিন কাজে খরচ ও সময় বেড়ে যাওয়া। দুধ প্রক্রিয়াজাতকরণ প্ল্যান্ট, কোল্ড স্টোরেজ ইউনিট এবং গুদামগুলিতেও প্রচুর শ্রমের ঘাটতি তৈরি হচ্ছে।

যদিও কৃষিজ পণ্য প্রয়োজনীয় হিসাবে বর্তমান লকডাউনের সময়ে ছাড়ের আওতায়। তা সত্ত্বেও দেশ জূড়ে সরবরাহ খুবই সমস্যার মধ্যে গিয়েছে এবং আগামী দিনে কতটা উন্নতি হবে, সে উদ্বেগ থেকে যাচ্ছে। চালকেরা বাড়ি চলে যাওয়ায় ট্রাকের সঙ্কট রয়েছে। ট্রাকের ঘাটতির কারণে বন্দর বা বাইরের রাজ্যগুলি থেকে পণ্য আমদানিও অনেক কম হচ্ছে। এ ছাড়া সময় ও খরচও বেশি হচ্ছে। ভিন্ রাজ্য থেকে প্রয়োজনীয় পোলট্রি ফিড, ওষুধ ও গো-খাদ্য পর্যাপ্ত আসছে না। অধিকাংশ ছোট ছোট পোলট্রি ফার্ম আপাতত বন্ধ হয়ে আছে। ফলে, খোলা বাজারে মাংসের দাম বাড়ছে ক্রমাগত। লেয়ারিং ফার্মে এখনও অনেকটাই অন্য রাজ্যের প্রতি নির্ভরশীল। তাই ডিমের দাম ক্রমশই চড়া হবে। অন্য দিকে, গণ-পরিবহণ ব্যবস্থা বন্ধ থাকায় বাইরের বাজারে সবজি-আনাজ নিয়ে যাওয়া যাচ্ছে না। একরের পর একর জমিতে চাষ হওয়া আনাজ কেনার লোক নেই।

স্থানীয় মানুষ স্থানীয় বাজার থেকে যেটুকু কিনছেন, তা অতি সামান্য। বেশির ভাগ কিষাণ মান্ডি জনবসতি থেকে অনেক দূরে বা অকার্যকর অবস্থায় পড়ে রয়েছে। সরবরাহের এই বাধাগুলির কারণে চাষিদের মাঠেই দাম হ্রাস পাচ্ছে।

লকডাউনের দু’মাস পেরিয়ে গিয়েছে। একশো দিনের কাজ এতদিন বন্ধ ছিল। গ্রামের মানুষদের হাতে টাকা নেই। সরকারের কাছে এবার স্বাস্থ্য পরিকাঠামো ছাড়াও কৃষি-সহ ক্ষুদ্র ও মাঝারি কর্মক্ষেত্রগুলিকে নিয়ে আপৎকালীন পরিকল্পনা ও দিশা খোঁজা ভীষণ প্রয়োজনীয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। লকডাউন সফল করতে হলে বিনামূল্যে রেশন ব্যবস্থার সঙ্গে সঙ্গে গরিব মানুষের হাতে টাকা তুলে দিতেই হবে। না হলে এই কঠিন পরিস্থিতি বেশি দিন স্থায়ী হলে আগামী মাসগুলিতে চাষে উৎসাহ হারাবেন কৃষকেরা। সামান্য জমি, পুঁজিও সামান্য, সেই সঞ্চিত টাকা ব্যবসা কিংবা চাষবাসে লগ্নি না করে দৈনিক গুজরানের জন্য অথবা অসময়ের জন্য তুলে রাখাই শ্রেয় বলে মনে করবেন তাঁরা। হাতে জমানো টাকা চাষে ব্যবহার করলে তা যে লাভজনক হয়ে ফিরে আসবে, এমন নিশ্চয়তা না পেলে চাষের এলাকা অনেকটাই কমে যাবে। বাজারও চড়া হতে থাকবে। তাই আগামী বোরো ধানে সরকার থেকে বেশি ক্রয়মুল্য একান্তই প্রয়োজনীয়। এবং তার সঙ্গেই একদম গ্রামীণ স্তর থেকে সংগ্রহ ব্যবস্থাকে সতর্কতার সঙ্গে পরিচালনা জরুরি। তা না হলে ভর্তুকি বা ঠিক দাম কৃষকের কাছে পৌঁছবে না। এই সঙ্কটময় পরিস্থিতিতে মহামারি ঠেকানোর পাশাপাশি খাদ্য উৎপাদন, ফসল সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও বাজার নিয়ন্ত্রণ এই চারটি ধাপ আগামী কিছু মাস প্রশাসনের কাছে সবচেয়ে কঠিন পদক্ষেপ রূপে নির্ধারিত হতে চলেছে। এর প্রতিটি ধাপে সরকারকে থাকতে হবে কৃষকের পাশে।

সহকারি অধ্যপক, বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement