ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে কি কেবলমাত্র এক জন নাগরিক বলিয়া বিবেচনা করা সম্ভব? পিএম কেয়ার্স তহবিল লইয়া সুপ্রিম কোর্টের রায় সেই প্রশ্ন তুলিয়া দিল। পিএম কেয়ার্স-এর নামকরণে প্রধানমন্ত্রীর পদটি ব্যবহৃত হইলেও, তাহা বস্তুত একটি পাবলিক সার্ভিস ট্রাস্ট বা জনসেবা নিধি। অতএব সরকারি তহবিলের হিসাবরক্ষার নিয়মাবলি এবং স্বচ্ছতার শর্তাবলি তাহার জন্য প্রযোজ্য নহে। সরকারি সংস্থার দ্বারা পিএম কেয়ার্স-এর অডিট হইবে না, হইবে বেসরকারি সংস্থার দ্বারা। তাহার ফল সর্বসমক্ষে প্রকাশ করিতেও পরিচালকরা বাধ্য নহেন। তাই একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা সুপ্রিম কোর্টের নিকট আবেদন করিয়াছিল, পিএম কেয়ার্স তহবিলের টাকা জাতীয় বিপর্যয় ত্রাণ তহবিলে জমা করিবার নির্দেশ দেওয়া হউক। দ্বিতীয়টি আইনসিদ্ধ তহবিল, তাহার জমা-খরচ সরকারি হিসাব অধীক্ষক (সিএজি) দ্বারা পরীক্ষিত হয়। ইহাতে স্বচ্ছতা বজায় থাকিবে। ওই জনস্বার্থ মামলায় শীর্ষ আদালত রায় দিয়াছে, জনসেবা নিধির পরিচালকরা তাঁহাদের সংগৃহীত অর্থ লইয়া কী করিবেন, সেই বিষয়ে তাঁহারা স্বাধীন। তিন বিচারপতির বেঞ্চ স্পষ্ট করিয়াছে, পরিচালকরা সরকারি পদে অধিষ্ঠিত হইলেও পিএম কেয়ার্স-এর পরিচয়, তাহা জনসেবা নিধি। তাহা সরকারের অর্থ গ্রহণ করে নাই, ফলে সরকারি হিসাবরক্ষকের অধীনে তাহাকে আনিবার প্রয়োজনও নাই।
আইনের দৃষ্টিতে এই সিদ্ধান্ত যথাযথ, সন্দেহ নাই। কিন্তু গণতান্ত্রিক সমাজে কেবল আইন নহে, নৈতিকতার দিক হইতেও বিষয়টি বিবেচনা করা প্রয়োজন। পিএম কেয়ার্স তহবিলের প্রধান পরিচালক স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, তাঁহার পদটির নাম দিয়াই তহবিলের নামকরণ হইয়াছে। এমনকি তহবিলের ওয়েবসাইটে অশোকস্তম্ভও ব্যবহৃত। শীর্ষ আদালতের নিকট সেই তথ্য আলাদা করিয়া গুরুত্ব না-ও পাইতে পারে, কারণ সংস্থাটি গঠিত হইয়াছে জনসেবা নিধি আইনের অধীনে। কিন্তু জনসাধারণের নিকট কি তাহা গুরুত্বপূর্ণ নহে? তাঁহারা কি জনস্বার্থে দান করিবার সময় নরেন্দ্র মোদীকে কেবলই ‘ব্যক্তি’ ভাবিয়াছেন, যাঁহার সহিত অপরাপর নাগরিকের কোনও পার্থক্য নাই? করোনা অতিমারির কালে দেশে বহু সংগঠন তহবিল সংগ্রহ করিতে নামিয়াছে। পিএম কেয়ার্স তহবিল খুলিবার প্রথম দুই মাসের মধ্যেই সংগ্রহ দশ হাজার কোটি টাকা ছাড়াইয়াছিল। অর্থাৎ ইহার সভাপতি স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী এবং অপরাপর অছি ক্যাবিনেট মন্ত্রীরা, সেই তথ্য এই বিপুল অর্থসংগ্রহের সহিত সম্পর্কহীন নহে। আইনের বিচার যাহাই হউক, জনগণের বিচারে এই তহবিল সরকারি তহবিলের সমান অথবা অধিক মান্যতা পাইয়াছে। তাই জাতীয় বিপর্যয় ত্রাণ তহবিল হইতেও অধিক অর্থ পিএম কেয়ার্স-এ জমা পড়িয়াছে।
পিএম কেয়ার্স-এর হিসাব দেশের মানুষকে জানাইতে প্রধানমন্ত্রী আইনত বাধ্য না-ই হইলেন। কিন্তু নৈতিকতার দৃষ্টিতে সেই দায় তিনি এড়াইতে পারেন না। তিনি জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি, সরকারে সর্বোচ্চ ক্ষমতাশালী পদে আসীন। আর পাঁচ জন ব্যক্তির সহিত সমান করিয়া তাঁহাকে দেখিবেন দেশের নাগরিক, এমন দাবি অর্থহীন, অসম্ভব। তাঁহার উপর মানুষের ভরসা অধিক, অতএব তাঁহার নিকট হইতে মানুষও অধিক স্বচ্ছতা ও দায়বদ্ধতা প্রত্যাশা করেন। প্রধানমন্ত্রী স্বেচ্ছায় পিএম কেয়ার্স-এর সকল হিসাব জনসমক্ষে প্রকাশ করুন। ইতিপূর্বেই তাঁহার দফতর জানাইয়াছে, তথ্যের অধিকার আইনের আওতায় আসিবে না পিএম কেয়ার্স। এখন আদালতও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করিবার উদ্দেশ্যে নির্দেশ না দিবার সিদ্ধান্ত লইল। এমতাবস্থায় স্বচ্ছতা নির্ভর করিবে নিধির পরিচালকদের উপর। স্বেচ্ছায় নিয়মানুবর্তিতাই নৈতিকতা। স্বচ্ছ ভারতের প্রবক্তা প্রধানমন্ত্রী আপন আচরণের মাধ্যমে দৃষ্টান্ত স্থাপন করুন।