মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও রাজ্যপাল জগদীপ ধনখড়।
রাজ্যপাল এবং রাজ্য সরকারের মধ্যে সম্পর্কের তিক্ততা যে দিকে গড়াচ্ছে, তা খুব মামুলি বিষয় বলে মনে হচ্ছে না। জগদীপ ধনখড়ের কার্যকলাপ ও কথাবার্তা থেকে ক’দিনের মধ্যেই পরিষ্কার যে, তিনি সরাসরি মাঠে নেমে খেলতে চান। আর সত্যিই যদি রাজভবন ‘খেলোয়াড়’ হয়ে ওঠে, নানা কারণে তার ফল সুদূরপ্রসারী হতে পারে। মনে রাখা ভাল, খুব কিছু অদলবদল না হলে আগামী বিধানসভা নির্বাচন এবং নতুন সরকার গঠন সবই হবে এই রাজ্যপালের কার্যকালে।
সাধারণত, কোনও বড় মতবিরোধেও রাজভবন সচরাচর প্রকাশ্যে কোমর বেঁধে রাস্তায় নামে না। বড়জোর দু’একটি বিবৃতি দিয়ে রাজ্যপাল নিজের অবস্থানটুকু জানান। তার পরে ভিতরে ভিতরে ছুরি শানালেও বাইরে দার্শনিক উদাসীনতা প্রকাশ করে বিষয়টিকে লোকচক্ষে ধামাচাপা দিতে চেষ্টা করেন। তাঁর পদের পক্ষে এটাই গ্রাহ্য।
অনেকেরই মনে আছে, ২০০৭ সালে নন্দীগ্রামে পুলিশের নির্বিচার গুলিচালনা এবং তার কয়েক মাস পরে সিপিএমের ‘পুনর্দখল’ অভিযানের রক্তক্ষয়ী পরিণাম, দু’টি ঘটনাতেই অত্যন্ত কড়া ভাষায় বিবৃতি দিয়েছিলেন তখনকার রাজ্যপাল গোপালকৃষ্ণ গাঁধী। মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য তাঁর বিরুদ্ধে পাল্টা মুখও খুলেছিলেন। কিন্তু দু’জনের কেউই শেষ পর্যন্ত সংযমের লক্ষ্মণরেখা অতিক্রম করেননি।
সদ্য আসা জগদীপ ধনখড় সেই রকম কোনও প্রচলিত পথে হাঁটতে আগ্রহী বলে মনে হয় না। প্রায় বিরল নজির সৃষ্টি করে তিনি সাংবাদিকদের ডেকে সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলাও শুরু করে দিয়েছেন। এই লক্ষণ খুব ‘শুভ’ নয়।
সত্যি বলতে কি, কলকাতার রাজভবনের উদ্দেশে ধনখড়ের যাত্রা শুরুই হয়েছে কিছুটা অপ্রচলিত পথ ধরে। সাধারণ প্রথা অনুযায়ী কোনও রাজ্যে কাউকে রাজ্যপাল করে পাঠানোর সময় তাঁর নাম ঘোষণার আগে মুখ্যমন্ত্রীকে তা জানানো হয়। সব সময় যে সেই নাম সংশ্লিষ্ট মুখ্যমন্ত্রীর পছন্দ হবে, তার মানে নেই। এ সব নিয়ে বহু বিরোধের উদাহরণও আছে। তবু প্রচলিত সৌজন্য হল, আগে মুখ্যমন্ত্রীকে জানিয়ে তার পরে নাম ঘোষণা করা।
ধনখড়ের ক্ষেত্রে দিল্লি সেই শিষ্টাচার মানেনি। রাজ্যপালের নিয়োগের কথা জানাতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে যখন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের ফোন যায়, তার আগেই সাংবাদিকদের কাছ থেকে মমতা সব
জেনে গিয়েছিলেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে তিনি সে কথা শুনিয়েও দেন!
কে এই জগদীপ ধনখড়, সে সম্পর্কেও খুব স্পষ্ট কোনও ধারণা ছিল না মমতার। কয়েক দশক লোকসভার সদস্য এবং একাধিক বার কেন্দ্রে মন্ত্রী থাকার সুবাদে পুরনো অনেকের সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত জানাশোনা থাকলেও ধনখড়ের সঙ্গে ছিল না। যদিও ধনখড় মুখ্যমন্ত্রীকে বলেছেন, মাথায় লাঠি খেয়ে মমতা যখন হাসপাতালে ছিলেন, তখন তিনি তাঁকে দেখতে গিয়েছিলেন।
তবে প্রথা রক্ষা হল কি না, বা ব্যক্তিগত চেনা-পরিচয় ছিল কি না, সে সব এখন গৌণ। যে জিনিসটি সবচেয়ে বেশি নজরে পড়ছে, তা হল নবাগত রাজ্যপালের ক্রিয়াকলাপ। তিনি দায়িত্ব নিয়েছেন ঠিক দু’মাস। আর এরই মধ্যে রাজনৈতিক বিতর্কের কেন্দ্রে তাঁর নাম।
রাজ্যপালদের সঙ্গে সরকারের সংঘাতের ঘটনা এই রাজ্যে বেনজির নয়। তা বলে, রাজভবনে পা-দেওয়ামাত্র রাজ্যপাল রাজনীতির বিতর্কে জড়িয়ে পড়বেন এবং সরকারের সঙ্গে সম্পর্কের ‘অবনতি’ ঘটবে, এটা অভূতপূর্ব।
ধনখড়ের সঙ্গে সরকারের সম্পর্ক ঘোলাতে শুরু করেছে তিনি আসার পনেরো দিনের মধ্যেই! এটিও প্রচলিত ধারার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ বলা চলে না।
রাজ্যপালেরা কেন্দ্রের ‘এজেন্ট’— তা এখন প্রায় স্বতঃসিদ্ধ তত্ত্ব। কেন্দ্রে যদি ‘বন্ধু’ সরকার থাকে, তা হলে রাজ্যপালের সঙ্গে রাজ্য সরকারের সম্পর্ক সহসা চিড় খায় না। কোনও কোনও রাজ্যপাল অবশ্য স্বভাবশান্ত, নির্বিরোধ। তাঁদের নিয়েও সমস্যা বিশেষ হয় না। আবার এটাও ঠিক যে, অনেক ক্ষেত্রে নিজেদের ক্ষমতার গণ্ডিতে থেকেও রাজ্যপালেরা রাজনৈতিক আক্রমণের শিকার হন।
যেমন, বামফ্রন্ট আমলে হয়েছিল অনন্তপ্রসাদ শর্মার ক্ষেত্রে। বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য হিসেবে রাজ্যপাল শর্মা তিন জনের প্যানেল থেকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদে সন্তোষ ভট্টাচার্যকে বেছে নিয়েছিলেন তাঁর অধিকারের সঠিক প্রয়োগ করেই। কিন্তু সিপিএমের রাজনীতি সন্তোষবাবুকে তো বটেই, শর্মাকেও ক্ষতবিক্ষত করেছিল। জ্যোতি বসুর সরকার তাঁকে ‘বয়কট’ করার সিদ্ধান্ত নেয়। ‘বাংলা ছাড়ো, গদি ছাড়ো’ শুনতে শুনতে তিনি এর পরে বেশি দিন রাজভবনে থাকতে পারেননি।
তারও আগে প্রথম যুক্তফ্রন্টের আমলে অজয় মুখোপাধ্যায়-জ্যোতিবাবুদের সরকার ভেঙে দেওয়ার অভিযোগ ওঠে তৎকালীন রাজ্যপাল ধর্ম বীরের বিরুদ্ধে। এই রাজ্যে কোনও রাজ্যপালের বিরুদ্ধে এত তীব্র আন্দোলন সম্ভবত আর হয়নি। ধর্ম বীর ‘অ্যাক্টিভ’ হয়ে সরকারকে তার চাহিদামতো সময়ে বিধানসভায় গরিষ্ঠতা প্রমাণের সুযোগ দেননি। তড়িঘড়ি অন্য সরকার বসিয়ে দেন। রাজ্যপাল কাজটি ঠিক করেছিলেন কি না, সেটা সাংবিধানিক চর্চার বিষয়। এ ক্ষেত্রে রাজ্যপালের ভূমিকা সে দিন রাজ্য-রাজনীতির ময়দানে প্রত্যক্ষ প্ররোচকের কাজ করেছিল। রাজনীতির গতিপথও তাতে বদলে গিয়েছিল।
এই রকম কতিপয় ঘটনা বাদ দিলে এখানে রাজ্যপালের সঙ্গে রাজ্যের সংঘাত কখনও খুব বড় আকার নেয়নি। খোঁচাখুঁচিতেই সীমিত থেকেছে। এমনকি, সদ্য প্রাক্তন রাজ্যপাল কেশরীনাথ ত্রিপাঠি ঘোষিত ভাবে সঙ্ঘ পরিবারের লোক হলেও একটি সীমারেখা উভয় পক্ষই মেনে চলেছেন।
রাজনীতিতে জগদীপ ধনখড়ও পুরনো মুখ। তিনি রাজস্থানে প্রথমে জনতা দল করেছেন।
পরে কংগ্রেসে যান। সেখান থেকে ২০০৩ সালে যোগ দেন বিজেপিতে। এখন তিনি গেরুয়া শিবিরের ঘনিষ্ঠজন। অতএব, বহু ঘাটে নৌকা বাঁধার অভিজ্ঞতা তাঁর আছে।
তাই বিজেপির পক্ষে রাজনৈতিক ভাবে ‘সংবেদনশীল’ পশ্চিমবঙ্গে সেই ধনখড়কে রাজ্যপাল করে পাঠানোর পিছনে কোথাও কোনও ‘ভাবনা’ কাজ করছে না, ভাবলে হয়তো ভুল হবে। বিশেষত এমন এক সময়ে, যখন পরবর্তী বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি রাজ্য-জয়ের স্বপ্ন দেখছে!
পদে বসেই ধনখড়ও ‘অ্যাক্টিভ’ হয়ে কাজ শুরু করেছেন। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে যা হল, তা আপাত ভাবে আকস্মিক ঘটনা এবং অবশ্যই অনভিপ্রেত। তবে নানা কারণে এর অভিঘাত অনেক বেশি। জের আরও চলবে। কিন্তু তার আগে থেকেই নতুন রাজ্যপালের বিবিধ কাজ নবান্নের
‘অপছন্দ’-এর কারণ হয়েছে। তাই ৩০ জুলাই যে রাজ্যপাল শপথ নিয়েছেন, তাঁর সম্পর্কে ১৯ সেপ্টেম্বর দুপুরে মুখ্যমন্ত্রী মমতা সরাসরি কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে অনুযোগ পর্যন্ত জানিয়ে আসেন। ঘটনাচক্রে এর কিছু ক্ষণ পরেই ঘটে যাদবপুর-কাণ্ড।
সরকার ও রাজ্যপালের মধ্যে এই সব বিসংবাদের উচিত-অনুচিত, ঠিক-ভুল বিচারে যাব না। তবে বলতেই হবে, ধনখড়কে এই রাজ্যে পাঠানোর পিছনে কোনও অঙ্ক থাকলে তার উত্তর মিলতে শুরু করেছে। রাজ্যপাল ইতিমধ্যেই রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সম্পর্কে খোলাখুলি সমালোচনা করেছেন। রাজ্যের ‘উদ্যোগহীনতা’ (লিউকওয়র্ম কন্ডিশন) নিয়ে কড়া মন্তব্য করেছেন। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভে পড়া কেন্দ্রীয় মন্ত্রীকে ‘উদ্ধার’ করতে পুলিশ না-পাঠানোর জন্য উপাচার্যকে পত্রপাঠ সরিয়ে দিতে চেয়েছেন এবং নিজেই সেখানে ছুটে গিয়ে পুলিশ ঢোকানোর হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। শুধু এবিভিপি নামধারী পাল্টা বিক্ষোভকারীদের তাণ্ডব নিয়ে রাজ্যপাল একটি বাক্যও বলেননি। ‘সক্রিয়তা’ বইকি!
ধনখড় দাবি করেছেন, তাঁর কাজ সোজাসাপ্টা, লুকোছাপা কিছু নেই। বস্তুত তাঁর কাছে কে দেখা করতে যাচ্ছেন, কী কথা হচ্ছে, রাজভবন রোজ সে সবও জানিয়ে দেয়। এত খোলামেলা পদ্ধতি ছিল না।
কিন্তু যাদবপুরের ঘটনার পরে বিজেপি তথা সঙ্ঘ পরিবারের চার নেতার সঙ্গে রাজ্যপালের বৈঠকের কথা রাজভবন আজও প্রকাশ্যে জানায়নি। কেন? প্রশ্নটা থেকে গেল।