বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনাক্রম বলিয়া দিল, আগল ভাঙিয়াছে। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে পুলিশ ডাকিয়া ফেলা এখন ‘স্বাভাবিক’। ইহাই মোদী-জমানার কৃতিত্ব। ছাত্রীদের হস্টেলে পুরুষ পুলিশ ঢুকিয়া প়ড়িল কি না, অথবা ঘটনার পর মুখ্যমন্ত্রী রিপোর্ট তলব করিলেন কি না, কোনও অফিসারকে সরাইয়া দেওয়া হইল কি না, সব প্রশ্নই তুলনায় গৌণ। ক্যাম্পাসে ছাত্ররা কোনও কারণে বিক্ষোভ দেখাইলে কর্তৃপক্ষ তাহার মোকাবিলায় পুলিশ ডাকিতে পারেন, ইহাই প্রধানতম সত্য। অভিজিৎ চক্রবর্তী নিশ্চয় প্রীত হইবেন। যাদবপুরে তিনি যাহা করিয়াছিলেন, এখন তাহাই মডেল হইয়া উঠিতেছে। ক্যাম্পাসের পরিসরটি যে সমাজের অন্য যে কোনও পরিসর হইতে পৃথক, এবং সেই পরিসরে পুলিশ বা জেলাশাসক নহেন, উপাচার্যেরই সর্বোচ্চ ক্ষমতাবান হওয়া বিধেয়, তাহা কোনও আইনে লেখা নাই। কিন্তু, এই অলিখিত নিয়মটিই মান্য ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অথবা কলেজের অধ্যক্ষ জানিতেন, ছাত্রদের শাসন করিবার অধিকার তাঁহার, বাহিরের শাসন হইতে রক্ষা করিবার দায়িত্বও তাঁহার। পুলিশও জানিত, তাহাদের গাড়ি এবং উর্দি ক্যাম্পাসের গেট পার করিবে না। মোদী জমানার সাফল্য, তাঁহারা এই ব্যবস্থাটিকে ভাঙিয়া দিতে পারিয়াছেন। এখন আর ক্যাম্পাসে পুলিশ ডাকিতে কেহ দ্বিধা করেন না। পুলিশও ছাত্রদের পিটাইয়া শায়েস্তা করিয়া দেয়। নরেন্দ্র মোদীরা জিতিতেছেন। ‘ক্যাম্পাস’ নামক পরিসরটি ক্রমেই তাহার তাৎপর্য হারাইতেছে।
আগলটি কেন ভাঙিল, সেই কারণ সন্ধান করিতে নাগপুরের অভ্যন্তরে খোঁজ লওয়া প্রয়োজন। নাগপুরের পাঠশালায় প্রশ্নের অবকাশ নাই। সেখানে গুরু যাহা বলেন, ছাত্ররা বিনা প্রশ্নে, বিনা আপত্তিতে তাহাই শিখিয়া লহে। অতএব, যাঁহারা নাগপুরের পাঠশালায় প্রশিক্ষিত, তাঁহারা ছাত্রদের প্রশ্নে অভ্যস্ত নহেন। যে কোনও প্রশ্নই তাঁহাদের চক্ষে বিদ্রোহের শামিল। এবং, বিদ্রোহকে দমন করিবার একটিমাত্র পন্থাই তাঁহাদের জানা। বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসরে ছাত্ররা প্রশ্ন তুলিলে, অতএব, তাঁহারা সেই বিদ্রোহ দমনের পথেই হাঁটিয়াছেন। জেএনইউ-এর ক্যাম্পাসে পুলিশ ঢুকিয়াছিল, দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসরে গেরুয়াবাহিনী দাপাইয়া বেড়াইয়াছে। বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ে যে অজুহাতে পুলিশ ঢুকিয়া পড়িল, সেখানে বৃহত্তর রাজনীতিরও কোনও প্রশ্ন ছিল না। ক্যাম্পাসের ভিতরে তিন বীরপুঙ্গব এক ছাত্রীর সহিত অসভ্যতা করিয়াছে, এবং অভিযোগ পাইয়া কর্তৃপক্ষ ছাত্রীটিকেই প্রশ্ন করিয়াছেন, এই অভিযোগে ছাত্রছাত্রীরা বিক্ষোভ দেখাইতেছিল। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সেই বিক্ষোভও সামাল দিতে পারেন নাই। ছাত্রদের প্রশ্নের কোনও সন্তোষজনক উত্তর খুঁজিয়া পাওয়া দূরে থাকুক, তাঁহারা ছাত্রদের সহিত আলোচনার পরিসরে আসিবার চেষ্টা করেন নাই। তাঁহারা পুলিশ ডাকিয়াছেন। কারণ, তাঁহারা শিখিয়া লইয়াছেন, ক্যাম্পাসে পুলিশ ডাকিয়া আনাই নিয়ম। এবং, পুলিশও নির্বিচারে মারিয়াছে। কারণ, পুলিশও জানে, ছাত্রদের উপর চড়াও হওয়ায় কোনও বাধা নাই। আশার আলো একটিই। জেএনইউ এবং দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদের নির্বাচনের ফলাফল। ছাত্রদের যে পিটাইয়া চুপ করানো যায় না, এই কথাটি কর্তারা বুঝিলে ভাল করিবেন।