যুদ্ধের ঝুঁকি চিন নেবে কি

ভারত-চিন দীর্ঘ সীমান্তের বেশির ভাগটাই বিতর্কিত। একটা সময় ভারতের উত্তর-পশ্চিম ও উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের সীমান্ত-বিবাদ বিনিময়ের সূত্রে মীমাংসার সম্ভাবনা ছিল।

Advertisement

শিবাশিস চট্টোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১৩ জুলাই ২০১৭ ১১:৪৫
Share:

মুখোমুখি: উত্তর সিকিমে ক্রমশই উত্তপ্ত হয়ে ওঠা নাথু লা সীমান্তের কাছে ভারতীয় সেনা ও চিনা সেনার আদানপ্রদান। ছবি: এএফপি

সিকিম সীমান্তে ভারত-চিন সংঘাত এশিয়ার এই দুই মহাশক্তিধর রাষ্ট্রের অত্যন্ত জটিল দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে সংকটের মুখে এনে খাড়া করেছে। ডোকা লা-য় চিনের এই অতিসক্রিয়তা কেন? কূটনীতিবিদদের কারও কারও মতে, এর পিছনে তিনটি কারণ কাজ করছে। প্রথমত, চিন তার সামরিক ও অর্থনৈতিক প্রতিপত্তিকে কাজে লাগিয়ে এশিয়ার একমাত্র শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে বদ্ধপরিকর। ভারত এই বশ্যতা স্বীকার করে না বলেই চিন তাকে উপযুক্ত শিক্ষা দিতে উদ্যত। দ্বিতীয়ত, চিন এশিয়ায় স্বল্পমেয়াদি স্থায়িত্ব চায় না, কারণ তার অর্থনৈতিক উন্নয়নের নতুন পরিকল্পনা অনেকটাই ইউরোপকেন্দ্রিক। তৃতীয়ত, চিন-ভিত্তিক নতুন এশীয় ব্যবস্থা কোনও অর্থনৈতিক যোগসূত্রের আধার নয়, একটি সামরিক ও রাজনৈতিক বিন্যাস, যেখানে চিনের একাধিপত্য প্রতিষ্ঠাই একমাত্র লক্ষ্য।

Advertisement

ভারত-চিন দীর্ঘ সীমান্তের বেশির ভাগটাই বিতর্কিত। একটা সময় ভারতের উত্তর-পশ্চিম ও উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের সীমান্ত-বিবাদ বিনিময়ের সূত্রে মীমাংসার সম্ভাবনা ছিল। দীর্ঘদিন সে সম্ভাবনা বিনষ্ট হয়েছে। এখন সমগ্র সীমান্তকে নিয়ে সমাধানের পথ খোঁজা হচ্ছে। এই প্রক্রিয়ায় নানা অনিশ্চয়তা।

সীমান্ত নিয়ে চিন ও ভারতের মানসিকতা ও চিন্তার মধ্যে একটা মৌলিক পার্থক্য আছে। চিন ঔপনিবেশিক সীমান্তকে অবৈধ মনে করে। কিন্তু অতীতে অনেক বার চিন তার সুবিধে মতো ব্রিটিশ স্বাক্ষরিত সীমান্ত সংক্রান্ত নানা চুক্তিকে ব্যাখ্যা করেছে, প্রয়োজনে বদলেছেও। ভারতের অবস্থানও জটিল। ভারত ম্যাকমাহন লাইনকে বৈধতা দিলেও, স্থানবিশেষে অবস্থান পাল্টেছে। এখানে উল্লেখ্য, ইতিহাসের দ্বারস্থ হলেও, চিন ও ভারত কিন্তু তিব্বত, ভুটান ও সিকিমের প্রাচীন নথিপত্র ও প্রমাণকে প্রত্যাখ্যান করেছে। যে ডোকা লা ও চুম্বি উপত্যকাকে নিয়ে আজকের উত্তেজনা, তার একটা আঞ্চলিক ইতিহাস আছে, যা দুই যুযুধান রাষ্ট্রের পরিভাষায় অনুপস্থিত। প্রখ্যাত সাংবাদিক-লেখক প্রদীপ ফনজোবাম-এর লেখায় এই আঞ্চলিক ইতিহাসের নৈঃশব্দ্য বাঙ্ময় হয়ে উঠেছে। তাঁর মতে, এ অঞ্চলের সার্বভৌমত্ব নিয়ে নানা দাবি ক্রমে অতি-সরলীকৃত হয়ে এক সরলরেখার দ্বন্দ্বে পরিণত হয়েছে। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের হাত ধরে এই সরলীকরণের সূত্রপাত।

Advertisement

চুম্বি উপত্যকা ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলির সঙ্গে বাকি দেশের যোগাযোগের একমাত্র অতি-ক্ষীণ রাস্তার বুকে ছুরির মতো বিঁধে আছে। এই অঞ্চলকে নিয়ে ভারতের স্পর্শকাতরতা স্বাভাবিক। অন্য দিকে, তিব্বতে চিনের শাসন প্রশ্নাতীত ভাবে প্রতিষ্ঠিত। তিব্বত-ভুটান বা তিব্বত-সিকিম সীমান্তকে চিন নিজের সীমান্তে পরিণত করেছে। ভারত তার বিরোধিতা করলে চিন স্বভাবতই সন্দিহান হয়ে ওঠে। যে সম্পর্কে পারস্পরিক বিশ্বাস সীমিত, এ ধরনের অনমনীয় মনোভাব সেখানে অনায়াসে বৈরিতা সৃষ্টি করে।

ভারত-চিন সম্পর্কের শৈত্য শুধু সীমান্ত-বিতর্কের বিষয় নয়। আন্তর্জাতিক রাজনীতির জটিল আবর্তে তথা এশিয়া মহাদেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রেক্ষিতে এদের সম্পর্কের ওঠানামা চলছে। ১৯৭৬ থেকে চিনের লাগাতার অর্থনৈতিক বৃদ্ধি সে দেশের সামর্থ্যকে বিপুল ভাবে বাড়িয়েছে। অগণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা ও ক্ষমতার কঠোর পরিকাঠামো এই শক্তির ভাণ্ডারকে নতুন মাত্রা দিয়েছে। স্বাভাবিক ভাবেই, চিনের বিদেশ নীতিতে আত্মম্ভরিতা ও নিজের প্রতি মাত্রাতিরিক্ত আস্থা ফুটে উঠেছে বার বার। এর ফলে ভারত, জাপান, ভিয়েতনাম, ফিলিপিনস প্রভৃতি দেশের সঙ্গে চিনের সম্পর্কের অবনতি হয়েছে।

দক্ষিণ চিন সাগরে চিন আক্রমণাত্মক হয়েছে, ভারত মহাসাগরে সে দেশের অবস্থান লক্ষণীয় ভাবে বেড়েছে। স্বভাবতই জাপান, ভিয়েতনাম, দক্ষিণ কোরিয়ার মতো দেশের সঙ্গে মিলে ভারত চিনের শক্তিকে প্রতিহত করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। অন্য দিকে, পাকিস্তানের সঙ্গে সামরিক ও অর্থনৈতিক বন্ধন বহু গুণ মজবুত করে চিন ভারতের নিরাপত্তার সামনে বড় চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে। চিন-পাকিস্তান জোট ভারতের প্রভাবকে দক্ষিণ এশিয়ায় সীমাবদ্ধ রাখার এক কৌশল। চিন ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যান্য রাষ্ট্রের সঙ্গে সখ্য গড়ে তুলেছে, যা ভারতের পক্ষে চিন্তার বিষয়। চিনের বিপুল অর্থনৈতিক সম্ভার এই সম্পর্কগুলোর ধারক ও বাহক। কিন্তু বহু চিন-বিশেষজ্ঞের মতে, বেশির ভাগ প্রতিবেশী রাষ্ট্রই নানা উপায়ে বেজিংকে প্রতিহত করতে আগ্রহী। ভারতের পূর্ব এশিয়া সংক্রান্ত বিদেশ নীতি পরিকল্পনায় চিনের বিরুদ্ধে শক্তিসাম্য গড়ে তোলা তাই এখন মুখ্য উদ্দেশ্যে পরিণত হয়েছে।

এই পটভূমিকায় চিনকে কেন্দ্র করে ভারতের উদ্বেগটাকে বুঝতে হবে। এখানে চারটি বিষয় তাৎপর্যপূর্ণ। প্রথমত, চিন ভারতকে তার প্রতিস্পর্ধী মনে করলেও তাকে মান্যতা দিতে নারাজ। তাই চিন পারমাণবিক সরবরাহ গোষ্ঠী (এনএসজি) নামক প্রতিষ্ঠানে ভারতের অন্তর্ভুক্তির তীব্র বিরোধী। চিন যেখানে ভারতকে পারমাণবিক চুক্তি বহির্ভূত শক্তি হিসেবে দেখে ও নিজের পূর্ণ তথা ন্যায্য অংশীদারিকে বৈধতার একমাত্র মুদ্রা মনে করে, সেখানে ভারতের দাবির ভিত্তি হল পারমাণবিক প্রযুক্তির বিস্তার রোধে তার দায়িত্বশীলতা।

দ্বিতীয়ত, চিনের ‘এক বেল্ট এক পথ’ ও ‘নব্য রেশম পথ’ (নিউ সিল্ক রুট)-এর বিশাল কর্মকাণ্ড ভারতের সামনে আর একটি চ্যালেঞ্জ। এই পরিকল্পনার অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক আকর্ষণ অনস্বীকার্য, কিন্তু এই প্রকল্পের মধ্যে ভারত প্রত্যক্ষ করে চিনের সামরিক প্রভাব বিস্তার ও কৌশলের নতুন এক পন্থা। ভারতের আপত্তির মূলে আছে চিনের সর্বগ্রাসী মনোভাব।

তৃতীয়ত, ভারত-চিন সম্পর্ক আমেরিকাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়। বারাক ওবামা ও তাঁর বিদেশ মন্ত্রী হিলারি ক্লিন্টন যে ‘এশিয়ান পিভট’ অর্থাৎ মার্কিন বিদেশ নীতিতে এশিয়ার গুরুত্ব বৃদ্ধির ধারণা সামনে এনেছিলেন, ডোনাল্ড ট্রাম্পের জমানায় তাকে আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। উত্তর কোরিয়া নিয়ে চিন-মার্কিন পারদ চড়লেও, সামগ্রিক ভাবে এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলে নয়া সামরিক জোট গড়ে চিনকে দমিয়ে রাখার পরিকল্পনা আপাতত হিমঘরে। অর্থাৎ ভারতের সামনে চিনের সঙ্গে টক্কর দেওয়ার পথ সীমিত বলেই মনে হচ্ছে। অতীতে ভারত চিনকে এশিয়া তথা বিশ্বের নানা যৌথ প্রকল্পে শামিল করে সহযোগিতার পথ খুঁজেছে। পাশাপাশি, নিজেদের সামরিক ও অর্থনৈতিক শক্তিবৃদ্ধি করে চিনকে প্রতিহত করতে চেয়েছে। বর্তমান সংকটের সময়েও এই দ্বিফলা নীতি ভারতের সেরা বাজি। ভারতের সঙ্গে যুদ্ধ বাধলে, বিপুল ক্ষয়ক্ষতি ছাড়া, চিনের সুনাম বিনষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি। নেতৃত্বের নেশায় বিভোর চিন কি এই ঝুঁকি নেবে?

সবচেয়ে বড় প্রশ্ন, চিনের উত্থানের ফলে কি শক্তিধর রাষ্ট্রের অর্থ ও পরিভাষা বদলাতে চলেছে? চিন কি অন্য ধরনের মহাশক্তি রূপে আত্মপ্রকাশ করছে? হু চিনথাও-এর আমলে ভাবা গিয়েছিল, চিনের অতিসক্রিয় বিদেশ নীতির মূলে কার্যকর সে দেশের বিরামহীন উন্নয়নের তাগিদ। কিন্তু শি চিনফিং-এর সময় চিনের সমৃদ্ধি অন্য রাষ্ট্রের সঙ্গে প্রগাঢ় অর্থনৈতিক সম্পর্কের নিরিখে নির্মিত। এর এক দিকে এশিয়ার সামগ্রিক উন্নয়নের অঙ্গীকার, অন্য দিকে সেই সামগ্রিকতার প্রয়োজনে ভিন্ন রাষ্ট্রে দখলদারির প্রবণতা। সীমান্ত-সংকট হয়তো দুই এশীয় মহাশক্তির মধ্যে যুদ্ধ ডেকে আনবে না। কিন্তু দুই দেশের ভিন্নমুখী রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও পরিস্থিতিজাত বাধ্যবাধকতা এদের সম্পর্কের তিক্ততাকে বাড়িয়ে তুলবে, এমন সম্ভাবনা আছেই।

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের শিক্ষক

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement