পার্সোনাল ইজ় পলিটিক্যাল।’ বিরল আচার্যরা স্বচ্ছন্দে নারীবাদী আন্দোলনের এই স্লোগানটি ব্যবহার করিতে পারেন। রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক ছাড়িবার সময় তিনি জানাইয়া গেলেন, মেয়াদ শেষ হইবার পূর্বেই ‘ব্যক্তিগত কারণে’ পদত্যাগ করিতেছেন। ইতিপূর্বে উর্জিত পটেলও ‘ব্যক্তিগত কারণে’ চাকুরি ছাড়িয়াছেন। অরবিন্দ সুব্রহ্মণ্যন বা অরবিন্দ পানাগড়িয়া— তাঁহাদের কারণও ‘ব্যক্তিগত’ ছিল। রঘুরাম রাজনের ক্ষেত্রে অবশ্য সরকার মেয়াদ বাড়াইতে অস্বীকার করিয়াছিল। এই ‘ব্যক্তিগত কারণ’টি এমনই রাজনৈতিক বা, আরও স্পষ্ট করিয়া বলিলে, রাজনীতিসঞ্জাত— যে তাহার মধ্যে ব্যক্তিগত কারণের সন্ধান করা অবান্তর। রাজনের ন্যায় স্পষ্টবাক, এবং বহু ক্ষেত্রে নরেন্দ্র মোদীর নীতির বিরোধী, অর্থনীতিবিদই হউক বা অরবিন্দ সুব্রহ্মণ্যনের ন্যায় তুলনায় নীরব অর্থশাস্ত্রী, কাহারও পক্ষেই এই সরকারের সহিত কাজ করা সম্ভব হয় নাই। রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কেও নহে, নর্থ ব্লকেও নহে। কেন, তাহার কারণ কেবল অনুমান করাই চলিতে পারে।
কেহ বলিতেই পারেন, আন্তর্জাতিক স্তরে স্বীকৃত অর্থশাস্ত্রীদের পক্ষে ‘মোদীনমিকস’ হজম করা কঠিন হইয়াছে, আবার মোদী ও তাঁহার পারিষদবর্গের পক্ষে মুশকিল হইয়াছে অর্থনীতির তত্ত্বের সত্যগুলিকে মানিয়া লওয়া। বিজেপির মেজো-সেজো নেতারা যখন রাজন বা সুব্রহ্মণ্যনের সমালোচনা করিয়া বলিয়াছেন যে তাঁহারা যে হেতু বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয় বা প্রতিষ্ঠানের সহিত যুক্ত, অতএব তাঁহারা ভারতের প্রতি দায়বদ্ধ নহেন, অর্থনীতির শীর্ষপদে কোনও ‘দায়বদ্ধ’ বিশেষজ্ঞ প্রয়োজন— নরেন্দ্র মোদী কখনও তাহার প্রতিবাদ করেন নাই। কখনও বলেন নাই, বিশেষজ্ঞদের অর্থনীতির প্রতি বিশ্বস্ত থাকা বেশি জরুরি। বরং, তিনিই হার্ভার্ডের সহিত ‘হার্ড ওয়ার্কের’ হাস্যকর তুলনা টানিয়াছেন। কেহ অনুমান করিতেই পারেন, অর্থনীতির জ্ঞানের তুলনায় রাজনৈতিক আনুগত্য এই আমলে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ যোগ্যতা। এই যোগ্যতামান ধার্য রাখিলে সত্যকারের অর্থশাস্ত্রবিদের পক্ষে এই কাজ করা অসম্ভব।
রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কে এখন স্বামীনাথন গুরুমূর্তি আর শক্তিকান্ত দাসের অধিষ্ঠান। মুখ্য অর্থনৈতিক উপদেষ্টাও সোশ্যাল মিডিয়ায় নরেন্দ্র মোদীর সুরে সুর মিলাইতে ব্যস্ত। অতএব, অনুমান করা চলে, অর্থনীতির বিরুদ্ধে জেহাদের প্রথম ধাপটি সুসম্পন্ন হইয়াছে— ‘হার্ভার্ড’ পরাভূত। পরবর্তী প্রশ্ন, এই জয়ে ভারতীয় অর্থনীতির গায়ে কতখানি আঁচড় পড়িবে। মোদীনমিকস-এর মাহাত্ম্যে অর্থনীতির অবস্থা কতখানি শোচনীয়, এই মুহূর্তে তাহা সর্বজনবিদিত। কিন্তু, রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের উপর রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ কায়েমের আরও একটি বড় বিপদ আছে। দেশের মনিটারি পলিসি বা আর্থিক নীতি নিয়ন্ত্রণের ভারটি স্বশাসিত রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের উপর ন্যস্ত হইবার অর্থ, রাজস্ব নীতিতে সরকার যদিও বা জনমোহনের পথে হাঁটে, তবুও সামগ্রিক ভাবে অর্থনীতির উপর রাশ থাকিবে। রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কও যদি নয়াদিল্লির অঙ্গুলিহেলনে চলিতে আরম্ভ করে, তবে ভারসাম্য বজায়ের আর কোনও উপায় থাকিবে না। সত্য যে ব্যাঙ্কের উপর রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা এই জমানাতেই প্রথম হয় নাই। দিল্লি-মুম্বইয়ের দড়ি-টানাটানি আগেও ছিল। গোটা দুনিয়াতেই কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক আর সরকারের সম্পর্ক এই সুরে বাঁধা। কিন্তু, এই জমানায় যাহা নূতন, তাহা হইল, টানাটানির চোটে দড়িটি ছিঁড়িয়াছে। সম্ভবত রাজনৈতিক চাপ সামলাইতে না পারিয়াই উর্জিত পটেল, বিরল আচার্যরা বিদায় লইতেছেন। ব্যাঙ্কের উপর নিয়ন্ত্রণ কায়েম করিতে পারিলে যেমন ব্যাঙ্কের নগদ ভাণ্ডারটি হাতে আসিবে, তেমনই সুদের হার নিয়ন্ত্রণ করা চলিবে রাজনৈতিক সুবিধা অনুসারে। তাহাতে রাজনীতির লাভ হইবে কি না, সে প্রশ্ন গৌণ— ভারতীয় অর্থনীতির যে সর্বনাশ হইবে, তাহা কার্যত সংশয়াতীত।
এবার শুধু খবর পড়া নয়, খবর দেখাও। সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের YouTube Channel - এ।