সব সমস্যার সমাধান এক রকম নহে। কিছু সমস্যা আছে যাহা মূল হইতে উৎপাটন করাই জরুরি। আবার কিছু সমস্যা আছে, যাহা মূল হইতে টানিয়া তুলিয়া ফেলিলে ঝামেলা বাড়ে বই কমে না। শিশুদের হোমওয়ার্ক সংক্রান্ত সমস্যা এই দুই গোত্রের মধ্যে ঠিক কোনটিতে পড়ে, সমাধানে কোমর বাঁধিয়া নামিবার আগে তাহা নির্ণয় করাটা জরুরি। বহু দিন ধরিয়া এই বিতর্ক চলিতেছে, বহু বার পক্ষ-বিপক্ষের সংঘর্ষ বাঁধিয়াছে। সম্প্রতি মাদ্রাজ হাইকোর্টের রায়ের ফলে আবার প্রসঙ্গটি উঠিয়া আসিল। কোর্টের নির্দেশ, প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির পড়ুয়াদের জন্য বিদ্যালয় যেন কোনও হোমওয়ার্ক না দেয়। মাননীয় বিচারপতিরা এমনও বলিয়াছেন, যে সব বিদ্যালয় এই নির্দেশ মানিবে না, তাহাদের অনুমোদন যেন বাতিল করিয়া দেওয়া হয়। এত কঠোর আদেশ শুনিয়া কিছুটা আশ্চর্যই হইতে হয়। বিদ্যালয় কী ভাবে ছাত্রছাত্রীদের পড়াইবে, কতটুকু হোমওয়ার্ক দিবে, এই তদারকি কি রাষ্ট্রের কাজ? বিদ্যালয় স্তরের পঠনপাঠন বিষয়ে বিচারবিভাগ ও শাসনবিভাগের এমন প্রত্যক্ষ ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়া সমাজের পক্ষে স্বাস্থ্যকর কি না, মহামান্য আদালতের নিকট নাগরিকরা সেই প্রশ্নটি তুলিতে পারেন বইকি। অধিক হোমওয়ার্ক সুতরাং অধিক বইপত্র বহন সুতরাং শিশুদের স্বাস্থ্যহানি— এই যুক্তি বহুচর্চিত। কিন্তু সে ক্ষেত্রে সরাসরি স্কুলব্যাগের ওজন নিয়ন্ত্রণই কি শ্রেয় নহে?
হোমওয়ার্ক সত্যই অদরকারি বা ক্ষতিকারক কি না, তাহা কিন্তু এখনও রীতিমতো তর্কসাপেক্ষ। পশ্চিমবঙ্গে রাজ্য সরকারি বিদ্যালয় পাঠ্যক্রম কমিটি এক বাক্যে বলিয়াছে, হোমওয়ার্ক যে অতীব মন্দ বস্তু, সেই বিষয়ে তাহারা নিশ্চিত, ২০১২ সাল হইতে তাহারা হোমওয়ার্ক-উচ্ছেদে প্রবৃত্ত। কিন্তু ঘটনা হইল, কোনও বড় মাপের সমীক্ষা বা পর্যালোচনা ছাড়াই, তথ্যপ্রমাণের অনুপস্থিতিতেই, এত বড় সিদ্ধান্তে পৌঁছনো হইয়াছে। অন্যান্য দেশে এই সংক্রান্ত যে সব সমীক্ষা ও গবেষণা হইয়াছে, তাহা কিন্তু জানায় হোমওয়ার্কের উপকার অপকার দুইই আছে। ক্লাস ওয়ানে দশ মিনিট, টু-তে কুড়ি মিনিট, এই রীতিতে হোমওয়ার্কের সময় রাখিলে ছাত্রছাত্রীরা বিশেষ উপকৃত হয় বলিয়া কিছু সমীক্ষার অভিমত। এক মার্কিন গবেষকের উক্তি: হোমওয়ার্ক আসলে ডায়েটারি সাপ্লিমেন্ট-এর মতো, কম খাইলে কাজ হয় না, বেশি খাইলে ক্ষতি হয়, আর ঠিক পরিমাণে খাইলে স্বাস্থ্যের উন্নতি হয়।
অর্থাৎ ইহা পরিমিতিবোধের প্রশ্ন। সুতরাং, কাণ্ডজ্ঞানেরও। শিশু শ্রেণিকক্ষে কতখানি শিখিল, তাহার নিজের কাছেও পরিষ্কার হয় নিজ দায়িত্বে ‘ওয়ার্ক’ করিতে পারিলে। সামান্য দশ-পনেরো মিনিটের ‘টাস্ক’-এর মাধ্যমেও সেই লক্ষ্য সাধন করা সম্ভব। ‘টাস্ক’কে চিত্তাকর্ষক করিয়া তোলাও খুবই সম্ভব। সুবিবেচক শিক্ষক হোমওয়ার্ককে বেদনাদায়ক না করিয়া আনন্দদায়ক করিতেই পারেন। সেই সব দিকে আদৌ মন না দিয়া এক বাক্যে হোমওয়ার্ক উঠাইয়া দিবার মধ্যে একটি ‘সহজিয়া’ নীতি আছে, যাহাকে রাজনীতিও বলা চলে। শিক্ষাব্যবস্থার যথাযথ সংস্কারের বদলে সহজিয়া-নীতিতে তাহাকে বাঁধিলে নিজেদেরও কাজ কমিয়া যায়, জনসাধারণও প্রসন্ন হইয়া পিঠ চাপড়ানি দেয়। ইহা সংস্কারকদের আত্মশ্লাঘার পক্ষে ভাল হইতে পারে, শিক্ষা নামক সাধনার পক্ষে হয়তো ততটা নয়।