বহু বছর আগে একটা গল্প পড়েছিলাম। এক মা তাঁর খুকুর নিষ্পাপ সরলতায় মুগ্ধ। খুকুকে জীবনের জটিলতার ছোঁয়াচ থেকে যথাসম্ভব দূরে রাখারই চেষ্টা করেন মা। বাইরের বাচ্চাদের সঙ্গে বেশি মিশতেও দেন না; পাছে তারা খুকুকে অবাঞ্ছিত কথা শেখায়। এক দিন একটি আত্মীয় মেয়ে তাদের বাড়িতে আসে, যে কিনা খুব ‘পাকা’। মা তটস্থ, পাছে সে খুকুকে পাকিয়ে দেয়! দুশ্চিন্তায় এক সময় মা চুপিচুপি ওদের কথা শুনতে আসেন। সবিস্ময় বুঝতে পারেন, জীবনের কোনও জ্ঞানই খুকুর অজানা নয়। সঙ্গিনীকে খুকু জানাচ্ছে যে বড়দের কথা থেকে সে সবই জেনে গিয়েছে। কিন্তু বেচারি মায়ের ওপর তার ‘মায়া’ হয়। তাই ‘ন্যাকামি’ করে সে সরল শিশু সেজে থাকে।
বাস্তবেও অনেক মা-বাবার এই ধরনের মোহভঙ্গ ঘটে। যে সন্তানের সব মনটা আমার আয়ত্তে আছে ভাবছি, হঠাৎ বুঝি, তাকে আমি চিনি না। কখনও তা ঘটে পরিবারের ভিতরেই সন্তানের আচরণে, স্কুলের বা প্রতিবেশীর অভিযোগে, কখনও সন্তানের সমাজবিরোধী কাজের খবরে, কখনও বা ভয়াবহ ভাবে তার আত্মহত্যার চেষ্টায়। এই ধরনের ঘটনা শুনলে অন্যরা ভাবে মা-বাবার তরফেই কোনও ত্রুটি ছিল, এমনকী মনোবিজ্ঞানীরাও তাঁদের দ্বারস্থ হওয়া মা-বাবাদের অনেক সময় বকুনি দেন সন্তানের মনের খবর না রাখার জন্য। কেউ আবার এর দায় বেশি করে চাপান কর্মরতা মায়ের উপরে। ফলে তাঁদের মানসিক চাপও বহু গুণ বেড়ে যায়। কোনও কোনও ক্ষেত্রে এই অবহেলা সত্য হলেও বহু সময়েই কিন্তু এ দায় শুধু দায় চাপানোই। বিষয়টির ব্যাখ্যা বা সমাধান এত সহজ নয়। অনেক সময় বাবা-মায়ের অবহেলা নয়, অতিরিক্ত মনোযোগই শিশুটিকে মনস্তাত্ত্বিকের চেম্বারে হাজির করে।
প্রায়ই শুনি আজকাল শিশুদের শৈশব হারিয়ে যাচ্ছে। ছোটবেলা বললেই আমাদের মনে ফুটে ওঠে এক আনন্দময় খেলার জগৎ, যেখানে বাস্তবের দায় নেই, সময়ের সীমারেখা নেই, কল্পনা যেখানে মুক্ত, পারস্পরিক বন্ধুত্ব যেখানে এমন স্বচ্ছন্দ যে আজ আড়ি কাল ভাব করাই চলে। প্রকৃতি স্বাভাবিক ভাবেই শিশুর মনকে এমন করে তৈরি করেছে যাতে সে খেলার মধ্য দিয়ে এই স্বাধীন আনন্দকে উপভোগ করতে পারে। কিন্তু এর মূল্য শুধু আনন্দেই শেষ নয়। এই আনন্দই শিশুর জীবনের লক্ষ্য ও সৃষ্টিশীলতা তৈরির মহড়া।
আজকের দিনে শিশুদের আর বড়দের জগতের মধ্যে স্থানগত নৈকট্য বাড়ছে। কিন্তু তাতে মানসিক নৈকট্য বাড়বেই এমন নিশ্চয়তা নেই। আগে খেলার মাঠ সুলভ ছিল, তাই শিশুদের প্রতিটি মুহূর্ত বড়দের সঙ্গে ভাগ করতে হত না। ছোটদের আর বড়দের জগতের মধ্যে শারীরিক দরকারের বাইরে যোগাযোগ হত নিছক ভালবাসার কিংবা সীমিত সময়ের শিক্ষার জন্য। তার বাইরে অনেকটা বেহিসেবি পরিসর থাকত। এখন পরিবার ছোট, বাসস্থানও। সন্তান একটি, বড়জোর দুটি। ফলে ছোট্ট জায়গায় শিশুর উপরেই মা-বাবার মনোযোগ নিবিষ্ট থাকে। তাতেও কিন্তু মা বাবারা ছেলেমেয়েদের মনের নাগাল পাচ্ছেন, তা নয়। বরং, কঠিনতর সমস্যা নিয়ে হাজির হয়েছে ইন্টারনেটের নেশা।
আজকাল অভিভাবকেরা ‘সচেতন’। সন্তানের মনের খোঁজ রাখার চেষ্টা তাঁরা করেন। তার দৈনন্দিন রুটিন, খেলাধুলোকে নিজেদের বোধবুদ্ধি অনুসারে সুন্দর ভাবে সাজানোর চেষ্টাও করেন। স্কুলে কী হল খোঁজ করেন, পড়াশোনায় সাহায্য করেন, টিউশনের ব্যবস্থা করেন। পাঠ্য বিষয়ের বাইরে তাকে নাচ, গান ক্রিকেট শেখান, যাতে শিশুর সৃষ্টিশীলতা বাড়ে।
তার পরেও গোলমালটা কোথায়? এক অর্থে অভিভাবকরা তাঁদের করণীয় কাজগুলি তো করছেনই। অথচ ফলটা হচ্ছে অনেক ক্ষেত্রে উলটো। কারিকুলার আর এক্সট্রাকারিকুলারের সাঁড়াশি চাপে শিশুটি হাঁসফাঁস, মায়েরা গলদঘর্ম, বাবারা হতাশ। এ ছবি বহু ক্ষেত্রে চেনা। বাবা-মায়েরা কেন এই এক্সট্রাকারিকুলার শিক্ষার উপরে এত জোর দেন? এর সবটাই তাঁদের সামাজিক সম্মানের ইচ্ছা বললে বাবা-মায়ের শুভকামনাকে ছোট করে দেখা হয়। আসলে তাঁরা চান সন্তানের জন্য পাঠ্যের অতিরিক্ত একটা জানলা খুলে দিতে, যেখানে সে সৃষ্টিশীলতার আনন্দের খোঁজ পাবে।
অথচ, সৃষ্টিশীলতা কি বাড়ছে? সৃষ্টিশীলতার অন্যতম প্রধান লক্ষণ হল বহুমুখী চিন্তা, অর্থাৎ ছকভাঙা ভাবনা। সারা পৃথিবীতেই শিশুদের সৃষ্টিশীলতা বাড়াবার জন্য বাবা-মা ও স্কুলগুলি এখন সচেষ্ট। আজকাল শিশু, বিশেষত কিশোরদের সামনে নানা ধরনের আত্মপ্রকাশ ও প্রতিযোগিতার সুযোগ। অন্য দিকে শিশুদের মস্তিষ্কের বৃদ্ধির ধরনটিও এমন যে ১২-১৩ বছর বয়স থকেই তার সৃষ্টিশীলতা সব থেকে বেশি ডালপালা মেলার কথা। অথচ আন্তর্জাতিক সমীক্ষা দেখাচ্ছে যে তিন-চার বছরের শিশুদের মধ্যে বয়সোপযোগী ছকভাঙা ভাবনার ক্ষমতা যেখানে ৯০ শতাংশের বেশি, সেখানে বয়ঃসন্ধিতে তা এসে ঠেকছে ১০ শতাংশে। এই আপাতবিরোধিতার ব্যাখ্যা হতে পারে, যদি আমরা মেনে নিই যে, আমাদের সমাজ ও শিক্ষাব্যবস্থার ধারণার মধ্যে একটা বড়সড় গোঁজামিল আছে।
নিশ্চিত উত্তর আমরা জানি না, কিন্তু শিশুদের শৈশব মুছে ফেলা এর একটা সম্ভাব্য কারণ হতে পারে। প্রকৃতির সহজ স্পর্শের বাইরে দু’কামরার ফ্ল্যটের মধ্যে শৈশবের আর পূর্ণবয়স্কের নিরন্তর ঠোকাঠুকি লেগেই চলেছে। কিন্তু অভিভাবকরা, বস্তুত বিজ্ঞানী ও মনস্তাত্ত্বিকরা ঠিক ভাবে জানেন না শিশুদের সৃষ্টিশীলতাকে রূপ দেওয়ার জন্য ঠিক কী ভাবে পথনির্দেশ করতে হবে। অথচ এই অজ্ঞতাকে স্বীকার করতে আমাদের ভয়। যেন এ কেবল রাজাকে উলঙ্গ বলা নয়, নিজেদেরও উলঙ্গ বলে স্বীকার করার তুল্য।
কিন্তু প্রকৃতির ওপর খোদকারি করতে না পারা কি সত্যিই এত লজ্জার? বরং শিক্ষার সেই বহু পুরনো সংজ্ঞাটিই হয়তো ঠিক। শিশু একটি চারাগাছ যাকে আমরা রক্ষা করব, কিন্তু সে বাড়বে তার নিজের মতোই। আমার ঘর সাজানোর ইচ্ছে অনুসারে চারাগাছের বৃদ্ধির পথ বেঁধে দিলে তাকে বনসাই বানানো যায়, শিকড়গুলিকে বার বার ছেঁটে দিলে সে ছোট্ট টবেও ফলন্ত হয়ে ওঠে, কিন্তু সে ফল প্রায়শ খাবার যোগ্য নয়। সে গৃহকোণের সাজ, আকাশচারী শাখাপল্লবের সৌন্দর্য় নয়। শিশুকে পথনির্দেশ করছি আমরা মা-বাবারা বা পেশাদাররা যারা অনেকে হয়তো নিজেদের জীবনটাকে নিজেদের পছন্দমত গড়ে তুলতে পারিনি। তাই এক অর্থে অন্ধ পথ দেখাচ্ছে আর এক জনকে, যার চক্ষু আছে কি না ভাবতেই আমরা রাজি নই। এর মূলে আছে আমাদের উদ্বেগ, আর ফলত সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা। একটু অন্তর্মুখী হলেই মা-বাবারা এই উদ্বেগকে চিনতে পারেন, এর কুফলও বুঝতে পারেন। কিন্তু অনিশ্চিতির বিকল্পকে স্বীকার করতে পারেন না।
আমার সন্তানকে আমিই ঠিক পথ দেখাব— এই অহংকারের বদলে যদি আমরা প্রকৃতির পথ দেখানোর ওপর নির্ভর করতে পারতাম, কী ভালই না হত। শিশুকে তো নাচগানের নির্দিষ্ট পদ্ধতি শেখানোর থেকে বেশি দরকার পথ খুঁজতে শেখানো, যাকে শিক্ষাবিজ্ঞানের ভাষায় বলে শিখতে শেখা। শিখতে শেখা মানে মনকে এমন ভাবে উন্মুক্ত করা যাতে জীবনের অভিজ্ঞতাগুলোকে শিশু নানা ভাবে ব্যবহার করার সাহস পায়। জীবনকে নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা করার এই সাহসটুকু উপদেশ দিয়ে শেখানো যায় না। শিশুর দরকার জীবনের সহজ পথ চলার অধিকার, যার অন্য নাম শৈশব উপভোগের অভিজ্ঞতা। অন্য শিশুদের সঙ্গে মেলামেশার স্বাধীনতা, প্রকৃতির কাছাকাছি স্বচ্ছন্দ বিচরণ, প্রকৃতিকে লক্ষ করা আর অকাজের অবসর, এর প্রধান উপকরণ। সমস্যা হল, অনেক বড়দের কাছেও অসবসরের মানে টিভি দেখা বা চ্যাট করা। শিশুরা বড়দেরই অনুকরণ করে। স্বাধীনতা দিতে আমরা ভয় পাই। বাস্তব বিপদের কিছু ভয় তো আছেই, কিন্তু আরও একটা কারণ হল, আমরাই নির্ধারণ করে দিতে চাই কী করলে বা ভাবলে সন্তানের ভাল হবে, যেখানে নিজেদের ভালটাই নিখুঁত ভাবে খুঁজে পাইনি।
কখনও কখনও এই দিশাহারা মা-বাবা আর শৈশবহারা শিশুদের দেখতে দেখতে মনে হয়েছে আমরা এই প্রজন্মের কাছে একটা মস্ত অপরাধ করে ফেলছি না তো?