Tapas Paul

নায়ক হয়ে থাকতে পারেননি, তবু জড়িয়ে কিশোরবেলায়

নামী পরিচালকদের সঙ্গেই বোধহয় তাপস বেশি ভাল অভিনয় করতেন, সে তরুণ মজুমদারের ‘দাদার কীর্তি’ হোক বা বুদ্ধদেবের ‘উত্তরা’। অভিনেতা তাপসের স্মৃতিচারণ করলেন প্রদীপ্ত ভট্টাচার্য

Advertisement
প্রদীপ্ত ভট্টাচার্য শেষ আপডেট: ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ০১:৪৮
Share:

তাপস পাল।

আমরা যারা আশি বা নব্বইয়ের দশকে গ্রামে-মফস্সলে বড় হয়েছি, তাদের কাছে তাপস পাল নামটা ছোটবেলাকার সব মায়া-মাখানো স্মৃতি মাথায় এনে দেয়। সেই সময়টা থেকে শুধু তাপস নন— মহুয়া রায়চৌধুরী, দেবশ্রী রায়, প্রসেনজিৎ, চিরঞ্জিত, অভিষেক চক্রবর্তী, শতাব্দী রায় (গ্রামবাংলায় এঁরা সাংঘাতিক জনপ্রিয় ছিলেন) এবং আরও অনেকের কথা, অনেক কিছুর কথা মাথার মধ্যে ভিড় করে আসতে থাকে।

Advertisement

সে দিনকার সে সব ছবিতে মহম্মদ আজিজ, আশা ভোঁসলের গান থাকত। দেওয়ালে দু’রঙা পোস্টার পড়ত। তাতে লেখা থাকত, ‘নাচে-গানে-অ্যাকশানে সম্পূর্ণ রঙিন সুপারহিট বাংলা সিনেমা’। রিকশায় চোঙা মাইক নিয়ে আমাদের পাড়ার পিন্টুদা অ্যানাউন্স করতে-করতে যেতেন।

আমার দেখা তাপস পালের প্রথম ছবি ‘দাদার কীর্তি’ নয়, ‘পারাবত প্রিয়া’। সেই সময়ে যদ্দুর মনে পড়ছে, শনিবার দুপুরে আর রবিবার সন্ধেবেলায় দূরদর্শনে বাংলা ছবি দেখানো হত। বেশির ভাগ বাড়িতেই বড়-বড় ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট টিভি থাকত। কারও-কারও টিভির পর্দার উপরে একটা আলাদা নীল প্লাস্টিকের স্ক্রিন দেওয়া থাকত। আমাদের বাড়ির টিভিটার উপরেও একটা স্ক্রিন ছিল। তবে সেটা নীল নয়, মাঝখানটায় একটু কমলা আর চার কোণে চারটে রঙ। মধ্যবিত্তের ‘কালার’ টিভি। তাপস পালকে আমি ওই অদ্ভুত রঙেই প্রথম দেখি।

Advertisement

‘পারাবত প্রিয়া’র কথা মনে পড়ছে, কারণ সে দিন বহরমপুর এবং সংলগ্ন অঞ্চলে কোনও কারণে ১৪৪ ধারা জারি হয়েছিল এবং টিভিতে সিনেমা দেখা বন্ধ করে আমরা সবাই ছাদে উঠেছিলাম কল্পনা সিনেমা হলের মোড় দিয়ে সারি-সারি মিলিটারি গাড়ি যাওয়া দেখতে। আমি বোধহয় ক্লাস থ্রি বা ফোরে পড়তাম তখন। পরের দিকে, ক্লাস নাইন-টেন অবধি একা বা বন্ধুরা মিলে হলে সিনেমা দেখতে যাওয়ার অনুমতি ছিল না। সব ছবিই দেখতাম টিভি বা ভিডিয়োয়। ভিডিয়ো বলতে তখন ভিসিআর, ভিসিপি মেশিনে দেখা। ভিএইচএস ক্যাসেট ভাড়া করা হত, সঙ্গে সত্যিকারের কালার টিভিও। তাতেই একে একে ‘দাদার কীর্তি’, ‘সাহেব’, ‘ভালোবাসা ভালোবাসা’, ‘বলিদান’, ‘অনুরাগের ছোঁয়া’ দেখে ফেললাম। ছোটবেলায় ‘সাহেব’ খুব দাগ কেটেছিল মনে। সেই সময়ে এটা বোঝার মতো বয়স ছিল না যে মূলধারার বাংলা ছবিতে নতুন একটা পর্ব শুরু হয়ে গিয়েছে মূলত তাপস পাল এবং তাঁর কয়েক জন সহ-অভিনেতাকে কেন্দ্রে রেখেই। সে কলকাতা-কেন্দ্রিক শহুরে দর্শকের ভাল লাগুক বা না লাগুক।

তখন একটা চল ছিল, ভিডিয়ো হলে গিয়ে সিনেমা দেখার। তেহট্টে নদীর ধারে এ রকম একটা ভিডিয়ো হল তৈরি হয়েছিল। বহরমপুরেও দু’খানা ভিডিয়ো হল ছিল। টিকিটের দাম অনেক কম হত আর মাটিতে বসে বিড়ি টানতে-টানতে সিনেমা দেখার সুখ ছিল। এ রকম আরও বহু ভিডিয়ো হল পশ্চিমবঙ্গের আনাচে-কানাচে গড়ে উঠেছিল যেখানে এ বেলা একটা ছবি, ও বেলা আর একটা ছবি দেখানো হত। অনেকটা আজকের সিনেমা হলগুলোর মতো।

এ ছাড়াও ছিল বিভিন্ন অনুষ্ঠানে (‌সে বিয়ে হোক বা সরস্বতী পুজো) সিনেমা দেখানোর বন্দোবস্ত। এ রকম সব অনুষ্ঠানে গিয়ে দেখে ফেলেছি ‘গুরুদক্ষিণা’, ‘বিধির বিধান’, ‘আপন আমার আপন’। খুবই ভিড় হত সেই সব শো-এ। আট থেকে আশি নারী-পুরুষ নির্বিশেষে ভিড় জমাতেন। সিনেমা দেখার-আগে পরে প্রচণ্ড উত্তেজিত থাকতেন সবাই। ছবি দেখা মাত্র স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিক্রিয়া হত তাঁদের। সে দুঃখ হোক বা আনন্দ। শুধু একটু বড়দের সিনগুলোয় আমাদের বলা হত মাটির দিকে তাকিয়ে থাকতে। সে রকম দৃশ্য শুরু হলেই কোনও এক জন বয়স্ক লোক বলে উঠতেন— ‘এই মাটিতে তাকা’। আমরা সবাই মাটির দিকে তাকিয়ে থাকতাম। আবার সেই দৃশ্য শেষ হয়ে গেলে তিনি বলতেন—‘শেষ হয়ে গিয়েছে’। আমরা আবার পর্দার দিকে তাকাতাম। যদিও শব্দ শুনে-শুনে দৃশ্যগুলো কিছু-কিছু কল্পনা করে নিতাম!

অনেকে প্রসেনজিৎ বা চিরঞ্জিতকে বেশি পছন্দ করতেন। তাঁরা তাপস পালকে অত পছন্দ করতেন না। তাঁরা তাপস পালকে বলতেন ‘ঢ্যাপস পাল’, কেউ আবার বলতেন ‘পাপোস তাল’। যদিও সব অভিনেতাদের নিয়েই এই ধরনের রঙ্গ-রসিকতা চলত। তবে দিদিমা-মাসিমারা তাপসকেই একটু বেশি পছন্দ করতেন মনে হয়।

‘বেদের মেয়ে জোসনা’ ছবিটা হলে চলেছিল অনেক দিন। তাতে ছিলেন চিরঞ্জিৎ। সুপার ডুপার হিট হয়েছিল সেই সিনেমা। তার পরেই এল তাপস পালের ‘রূপবান’— রূপকথাভিত্তিক ছবি। সিনেমা হলে গিয়েই দেখেছিলাম সেই সিনেমা। সেই ছবিটাও ভাল চলেছিল। এখন মনে হয়, সে কালে সিনেমা হলে গিয়ে সিনেমা দেখাটার মধ্যেই একটা রূপকথা-রূপকথা ব্যাপার ছিল। এমন একটা ম্যাজিক ছিল যা আমাদের মোহিত করে রাখত।

সে সব সেলুলয়েডের ছবি। কোনও দৃশ্যে একটু লাল টিন্ট বেশি, কোনওটায় আবার নীল টিন্ট। অডিয়ো জাম্প বা জার্ক থাকত। এখনকার ছবির তূলনায় টেকনিক্যালি অত্যন্ত দুর্বল। কিন্তু ম্যাজিকটা ছিল ষোলো আনা। সাধারণ লোকের কথাবার্তায় সিনেমার হিরো-হিরোইনদের কথা বা সংলাপ উঠে আসত। কথায়-কথায় হয়তো কেউ বললেন, ‘ও রে আমার উত্তমকুমার রে!’ অন্য জন পাল্টা দিলেন, ‘তুই মনে হচ্ছে তাপস পাল?’

পরে কলকাতায় সিনেমা নিয়ে পড়াশোনা করতে এসে বিভিন্ন ধরনের ছবি দেখা শুরু করলাম। এদেশি ছবি, বিদেশি ছবি। ঋত্বিক ঘটক, সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেনদের ছবি অন্য ভাবে দেখতে শুরু করলাম। সেই সময়েই দেখলাম বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের ‘উত্তরা’, তার পর ‘মন্দ মেয়ের উপাখ্যান’। তাপস ছিলেন। ওঁর ছবি সেই আমার শেষ দেখা। নামী পরিচালকদের সঙ্গেই বোধহয় তাপস বেশি ভাল অভিনয় করতেন, সে তরুণ মজুমদারের ‘দাদার কীর্তি’ হোক বা বুদ্ধদেবের ‘উত্তরা’।

ক’দিন আগে তেহট্টে গিয়েছিলাম। দত্তপাড়ার মোড়ে একটা ধুলো-পড়া দেওয়ালের গায়ে অস্পষ্ট খোদাই করে লেখা ‘এই রাস্তাটি মাননীয় সাংসদ শ্রী তাপস পাল কর্তৃক’ ইত্যাদি ইত্যাদি। তার পরেই ফেসবুকে তাপস পালের একটি সাম্প্রতিক ছবি চোখে পড়ে। চেহারাটা দেখে খারাপ লেগেছিল। আরও খারাপ লেগেছিল চৌমুহায় তাঁর সেই অতীব জঘন্য বক্তৃতা। হিরো হয়ে আমাদের কাছে এসেছিলেন। হিরো হয়ে থাকতে পারলেন না। আমাদের বা অনেকেরই ছোটবেলার বেশ খানিকটা অংশ জুড়ে ছিলেন এই সব হিরো-হিরোইন। এই সব সিনেমা। তাপস পাল কত ভাল বা খারাপ অভিনেতা বা রাজনীতিবিদ ছিলেন, সে সব সবাই জানেন। এটুকু বলতে পারি, অভিনেতা তাপস পালের সময়টা ছিল আমাদের কৈশোরকাল। কিশোরবেলা কি কেউ ভোলে, ভুলতে পারে?

চলচ্চিত্র পরিচালক ও সম্পাদক

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement