স্বামী বিবেকানন্দ।
প্রতিটি যুগের এক জন যুগকবি থাকেন, আর এক জন যুগনায়ক— বলতেন স্কুলবেলার এক মাস্টারমশাই। এক জন হৃদয়ের দায়িত্ব নেন, অন্য জন হাত আর মাথার। উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধের বাংলা তথা ভারতে সেই দু’জন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও স্বামী বিবেকানন্দ, বলতে বলতে চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠত তাঁর। সমসাময়িক এই দুই মহামনা যে বাঙালি অস্তিত্বকে তুমুল প্রভাবিত করে একেবারে তার হৃদয়াসনে গিয়ে বসেছেন, অস্বীকারের উপায় আছে?
স্বামী বিবেকানন্দের প্রত্যক্ষ সংস্পর্শে আসা সকলেই বলেছেন, তাঁর ব্যক্তিত্ব ও চরিত্রের একটা ধার ছিল। ইংরেজিতে ‘ক্যারিশমা’ শব্দটা কাছাকাছি আসতে পারে। মহাপুরুষেরা অষ্টপ্রহর বাণী দেন না, কিন্তু বিবেকানন্দের সহজ সাধারণ কথাবার্তাও এমন তেজীয়ান, তার শ্রুতিপ্রভাব অনস্বীকার্য। খুব আবেগী ছিলেন তিনি, পরাধীন দেশ বা কুসংস্কারে ডুবে থাকা জাতিকে নিয়ে বলতে গেলে তাঁর মধ্যে কতটা ‘প্যাশন’ কাজ করত, মুদ্রিত অক্ষরে থেকে-যাওয়া তাঁর বক্তৃতা ও চিঠিপত্র সাক্ষী। আবার স্রেফ আবেগ নয়, তথ্য-তত্ত্ব-যুক্তির পেশকারিও ছিল। তিনি সন্ন্যাসী, কিন্তু বেপরোয়া। বিদেশে রাখঢাক না করেই শ্বেতাঙ্গদের সামাজিক ও ধর্মীয় দমনপীড়ন নিয়ে সাহেব-শ্রোতাদের কথা শুনিয়েছেন, ভারতের মাটিতে দাঁড়িয়ে আনখশির ব্রাহ্মণ্যবাদী সমাজকে ধুইয়ে দিয়েছেন— নিপাত যাও, মুছে যাও, দূর হয়ে যাও। আদৌ মনীষীসুলভ সুভাষিত নয়, কিন্তু কাজের জিনিস। পড়লে রক্ত ঝনঝনায়। বাঙালি বিপ্লবীরা কেন তাঁর বই সঙ্গে রাখতেন, অনুমান করা যায়।
কথা হচ্ছে, বাঙালির কাছে তাবৎ মনীষীবাক্য শৈশব থেকেই পৌঁছয় মূলত খণ্ডিত, বিচ্ছিন্ন ভাবে— স্কুলের দেওয়ালে, উৎসব-অনুষ্ঠানে প্ল্যাকার্ড-ব্যানারে। বিবেক-বাণীও ব্যতিক্রম নয়। যিনি বিবেকানন্দ পড়েননি, তিনিও স্মৃতি থেকে বলে দেবেন ‘বহুরূপে সম্মুখে তোমার...’ বা ‘ওঠো, জাগো, লক্ষ্যে না পৌঁছনো পর্যন্ত থেমো না’, ‘হে ভারত, ভুলিয়ো না’ ইত্যাদি। রবীন্দ্রনাথের মতো না হলেও যথেষ্ট বৃহদ্বপু ‘বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা’কে ধরে ধরে না পড়ে, এক মুঠো এটা, আধখামচা ওটা উদ্ধৃত করার বিপদ আছে। প্রেক্ষিত না বোঝার বিপদ। উনিশ থেকে বিশ শতকের পথে পা রাখা একটা দেশের নাড়ির স্পন্দনকে একুশ শতকের পাল্টে যাওয়া মাপকাঠিতে দুম করে বিচার করতে বসার বিপদ। সে সম্পর্কে সতর্ক না থাকলে বিবেকানন্দ-মূল্যায়ন শ্রীরামকৃষ্ণের গল্পের সেই ‘অন্ধের হস্তিদর্শন’ হয়ে ওঠার সম্ভাবনা বাড়ে।
বিবেকানন্দের মূল তত্ত্বটা কিন্তু কঠিন নয় মোটেই। তিনি ‘শিক্ষা’কে বলেন মানুষের ভিতরে আগে থেকেই থাকা পূর্ণত্বের প্রকাশ, ওই একই লব্জে ‘ধর্ম’কে বলেন মানুষের ভিতরে আগে থেকেই থাকা দেবত্বের প্রকাশ। দেবত্ব-টেবত্ব শুনলে কেউ বিচলিত হয়, কেউ সন্দিহান। এই ধন্দে পড়ে যে শব্দবন্ধটা মনোযোগ এড়িয়ে যায় তা হল ‘ভিতরে আগে থেকেই থাকা’। মানে আসল কথা, যা থাকার তা মানুষের মধ্যেই আছে। অযুত সম্ভাবনা— কিন্তু অজানা। মানুষ নিজেই জানে না সে কী। এই ‘কী’টাই অন্য রূপে ‘অমৃতস্য পুত্রাঃ’, ‘আত্মা’, ‘চৈতন্য’। তাতে উপনিষদের, বেদান্তের রণন আছে, কিন্তু হিন্দুধর্ম বা অন্য কোনও ধর্মেরই একচ্ছত্র হস্তক্ষেপ নেই। তার নির্যাসটুকু হল, তুমি যখন তোমার ভিতরেই থাকা ‘পোটেনশিয়াল’কে জানবে, এবং তাকে ‘কাইনেটিক’ করবে, হেউঢেউ পড়ে যাবে। পূর্ণতা শিশুর মধ্যেই আছে, শিক্ষক কেবল তাকে জাগিয়ে পথে এগিয়ে দিলেন— সেটা শিক্ষা। তোমার ধারণা তুমি ছাপোষা মানুষ এক, আদতে তুমি যে বিরাট বিস্ফোরণে ফেটে পড়ার ক্ষমতা রাখো, সেটা বুঝতে পারাই ধর্ম। তা হলে প্রার্থনাস্থান, দেববিগ্রহ, শাস্ত্র, আচার কোথায় যাবে, যাদের কিনা ধর্ম বলে বুঝি, মানি? বিবেকানন্দের উত্তর: ওগুলো গৌণ। আসল কথা, গোড়ার কথা ওই সম্ভাবনা আর তার বিকাশ।
তত্ত্ব যখন প্রয়োগের মাটিতে আসবে, তখন? বিবেকানন্দের বেদান্ত আদ্যন্ত ‘প্র্যাকটিকাল’। শুধু নিজেরই সমস্ত সম্ভাবনার পূর্ণ বিকাশ চূড়ান্ত স্বার্থপরতা। তুমি নিজে বুঝলে, অন্যকে বোঝাবে না? নিজে উঠলে, অন্যকে ওঠাবে না? তাঁর তত্ত্বে তিনি তাই আদরে ঠাঁই দেন দু’জনকে— ত্যাগ ও সেবা। কী ত্যাগ? আমার প্রয়োজনের অতিরিক্ত যা কিছুই, তাকে ত্যাগ। তা দিয়েই সেবা। শক্তিমান যে, সে চাইলেই পিটিয়ে দিতে পারে দুর্বলকে। তার বদলে সে শক্তিটুকু দিয়ে দুর্বলকে রক্ষা করবে। সেটাই সেবা। ধনবানের অতিরেক পৌঁছক নির্ধনের কাছে, শিক্ষিতের ব্রত হোক অন্যকেও শিক্ষিত করে তোলা। কর্ম এত দিন বিযুক্ত হয়ে ছিল ধর্মজীবন থেকে। বেদান্তের তত্ত্ব পড়ে ছিল বনে গিরিগুহায়। সেই স্বার্থপর নিভৃতি থেকে তার মুক্তি হল লোককল্যাণে।
এই বিবেকানন্দের শিক্ষা, এই তাঁর ধর্ম। ভুল ব্যাখ্যায় খণ্ডিত তাঁকে আত্মসাৎ করা যেতে পারে, আত্মস্থ করা যাবে না মোটেই।