প্রতীকী ছবি
এগারো অক্টোবর দু’হাজার আঠারো। পাড়ার দোকান থেকে ফিরে ঘরে ঢুকতেই জোর বৃষ্টি নেমেছিল। এমনিতেই ঠান্ডা নামবে-নামবে করছে। তাঁর খুব শীত করছিল। ছোট বৌমার কাছে গায়ে দেওয়ার একটা কিছু চাইলেন। লাগোয়া পাশের ঘর থেকে বৌমা আনতে গেলেন কাঁথা বা কম্বল। দু’চার মিনিট পরে ফিরে তিনি দেখলেন, মানুষটি আর নেই। বিছানায় তাঁর শরীর পড়ে রয়েছে। আর পাশে রয়েছে একটি ডায়েরি। আজ আর লেখা হল না।
দশ অক্টোবর শেষ লিখেছিলেন ডায়েরি। সেই টাটকা লেখা তাঁর চলে যাওয়ার পর যখন গিয়ে দেখলাম, একটা অদ্ভুত অনুভূতি ভিতরে কাজ করছিল। তাঁর ছেলেদের অনুরোধ করলাম, তিনি আরও যত ডায়েরি লিখেছেন, তা আমায় দেখাতে। তাঁরা খুঁজে বার করতে লাগলেন চলে যাওয়া বছরের পর বছর। রোজ দিনশেষে দিনহাটার সুশীলচন্দ্র সরকার ডায়েরি লিখতেন। আমি ডুবে যেতে লাগলাম সেসব লেখায়। যেন ফেলে আসা এক একটি দিন ফুটে উঠতে লাগল। একটা বিলুপ্ত শিল্প যেন আমার হাতের নাগালে।
খুব বেশি লেখা নয়। প্রথমে দিনের আবহাওয়ার কথা। তারপর তাঁকে ঘিরে থাকা মানুষজনের কথা। তারপর বহির্জগৎ— সমাজ, দেশ, পৃথিবী। অথচ, কোনও ভাবেই এক পাতার বেশি নয়। ডায়েরির পাতায় ওই তারিখের জন্য যতটা জায়গা বরাদ্দ, ততটুকুতেই তাঁর লেখা সীমাবদ্ধ। ঝকঝকে ইংরেজিতে লেখা। কোথাও আবেগের ঘেরাটোপ নেই। কেউ কখনও পড়বেন, এমন ভাবনাও হয়তো মনে আসেনি। অথচ, দিনের পর দিন, বছরের পর বছর মানুষটি ডায়েরি লিখে গিয়েছেন।
দিনহাটার বড় আটিয়াবাড়িতে থেকেই নিজেকে এক অসামান্য মহীরূহে পরিণত করেছিলেন সুশীলচন্দ্র সরকার। কিন্তু পুরোটাই নীরবে-নিভৃতে। কোনওদিন নিজেকে জাহির করেননি। দিনহাটা সোনীদেবী স্কুলের বিজ্ঞানের এই অসামান্য শিক্ষক এই স্কুলে ৩৭ বছর সার্বিক অর্থে মানুষ গড়ার কাজই করে গিয়েছেন। এখনকার শিক্ষকদের বেশির ভাগই হয়তো কল্পনাও করতে পারবেন না, কী ভাবে পদার্থবিদ্যার শিক্ষকটি সমান দক্ষতায় উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত সাবলীল ভাবে অঙ্ক, জীববিদ্যা ও রসায়নশাস্ত্রও পড়াতে পারতেন! আবার তাঁরই কী অসাধারণ দখল ইংরেজি ও বাংলা ভাষায়, ব্যাকরণ ও সাহিত্যে! তাঁর কত ছাত্রছাত্রী দেশবিদেশে ছড়িয়ে রয়েছেন, বিজ্ঞানী, শিক্ষক, চিকিৎসক, ইঞ্জিনিয়ার— আরও কত কত সফল পদে। কত গরিব পড়ুয়া তাঁর বাড়িতে থেকেই সুপ্রতিষ্ঠিত। আবার তাঁর চেহারার দিকে তাকালে মনে হত, একজন সাত্ত্বিক ধার্মিক মানুষ। কী নিষ্ঠায় গীতা পাঠ করতেন! যাঁরা সে পাঠ শুনেছেন, কোনওদিন ভুলতে পারবেন না। ছন্দে লিখেছেন গীতার বাণী। ধর্মে ডুবে থাকা মানুষটি মগ্ন থাকতেন বিজ্ঞানচর্চায়। নিয়মিত বিজ্ঞানের নানা বিষয়ে প্রবন্ধ-নিবন্ধ লিখেছেন।
১৯৯৪ সালে শিক্ষকতা থেকে অবসরের পর যে টাকা হাতে পেয়েছিলেন, তা থেকে এক লক্ষ টাকা স্কুলের মাধমিক, উচ্চমাধ্যমিকে বিজ্ঞান বিভাগের সেরা পড়ুয়াদের ফি বছর বৃত্তি দেওয়ার জন্য দান করেছিলেন।
ম্যাট্রিকে বোর্ডে স্ট্যান্ড করেছিলেন, আইএসসি’তেও দারুণ রেজাল্ট। কোচবিহারের ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে বিএসসি। তারপর বাংলাদেশের জামালপুর জেলার সরিষাবাড়ি আরামনগর হাইস্কুলে শিক্ষকতা। ১৯৫৭-এর রমজানের ছুটিতে দিনহাটায় এসে সোনীদেবী হাইস্কুলের সঙ্গে যোগাযোগ। আর ফেরা হল না ওপার বাংলায়। এক অনন্য শিক্ষক হিসেবে নিজেকে মেলে ধরলেন এখানেই।
তাঁর স্মৃতিকথায় সুশীলচন্দ্র সরকার লিখেছেন— ‘সে এক সময় ছিল, যখন জটিল অঙ্কের সমাধানে টিচার্স রুমের টেবিল যেমন চকের দাগে ভরে যেত, ইংলিশ গ্রামারের চর্চাও হত ঠিক তেমনই। আজ অধিকাংশ শিক্ষকদের মধ্যেই সে প্রবৃত্তি আর বড় একটা লক্ষ করা যায় না।’ সুশীলচন্দ্রদের দেখানো পথ ক্রমবিস্মৃত, টিচার্স রুম জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্র না হয়ে মুঠোফোনের চর্চাকেন্দ্র হয়ে উঠছে ক্রমশ!
সোনীদেবী স্কুলে শিক্ষকজীবনের সূচনায় তিনি নবম শ্রেণির ক্লাসে অঙ্ক করাচ্ছিলেন। একটি ভাল ছাত্র বারবার থামিয়ে দিয়ে বলতে চাইছিল, এর চেয়ে নারায়ণস্যার অনেক ভাল বোঝান। এতটুকু রাগ না করে সুশীলচন্দ্র বলেছিলেন, ‘‘তোমাদের যখন আমায় এতই অপছন্দ, আমি না হয় অন্য ক্লাস নেব। নারায়ণবাবুই অঙ্কের ক্লাস নেবেন। আমি হেডমাস্টারমশাইকে রুটিন পাল্টাতে অনুরোধ করব।’ অন্য কেউ হলে হয়তো অভিমান বা রাগ করতেন। কিন্তু সুশীলচন্দ্রের ইচ্ছে জেগে উঠল নারায়ণবাবুর ঘনিষ্ঠ হয়ে নিজেকে আরও গড়ে তুলতে। লিখেছেন— ‘হলও ঘনিষ্ঠতা। দেখলাম, লোকটি একেবারেই সাধাসিধে। যেমন বাহির, তেমন ভিতর। পোশাক-আশাকে চাকচিক্য কোনওদিন ছিল না। ইস্ত্রি করা জামাকাপড় তাঁকে আমি পরতে দেখিনি। পাণ্ডিত্যের অভিমানও ছিল না তাঁর। অঙ্ক আটকে গেলে নারায়ণবাবুর শরণাপন্ন হলে অবলীলাক্রমে তিনি তা করে দিতেন। তাঁর কাছ থেকেই আমি অঙ্কচর্চার প্রেরণা পাই। এতে এক সময় উচ্চ মাধ্যমিকে অঙ্ক ক্লাস নিতেও ইতস্তত করিনি।’ কী নিবিড় সম্পর্ক! প্রবীণ আর নবীন এই দুই শিক্ষকের মধ্যে অঙ্ক নিয়ে তর্কও লাগত মাঝেমধ্যে। একবার সেই তর্কের সমাধানের জন্য কিংবদন্তি গণিতবিদ কেশবচন্দ্র নাগের শরণাপন্নও হয়েছিলেন দু’জন। এমন ছবি এখন সত্যিই দুর্লভ!
তাই জীবনপ্রান্তে এসে লিখেছেন— ‘শিক্ষকসমাজের প্রতি ছাত্রসমাজের আনুগত্য ও শ্রদ্ধা ক্রমক্ষীয়মাণ। এটা নিঃসন্দেহে উদ্বেগের কারণ। শ্রদ্ধা ছাড়া জ্ঞান অর্জন হয় না। আজকাল ছাত্রছাত্রীরা খুব বেশি মাত্রায় গৃহশিক্ষক-নির্ভর। কোনও বিষয়েই গভীর ভাবে চিন্তা করতে চায় না। এতে মৌলিক চিন্তাশক্তির উন্মেষ ও বিকাশ ঘটছে না।’ শিক্ষকেরাও কি নিজেদের শ্রদ্ধার পাত্র হিসেবে তুলে ধরতে পারছেন! সুশীলচন্দ্রদের চলে যাওয়া তাই বড় শূন্যতা তৈরি করে!
তাঁর ডায়েরি পড়ছিলাম এবং তাঁর জীবন নিয়ে অনেকের সঙ্গে কথা বলছিলাম একসময়। আর যেন বড্ড বেশি শূন্যতা নেমে আসছিল চারদিকে! এই মানুষগুলো চলে গিয়েও যদি থেকে যান, তা হলে হারিয়ে ফেলা অনেক মূল্যবোধ হারাতে হারাতেও কিছুটা টিকে থাকতে পারে!
(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)