শিল্পী: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য
প্রতি দিন খবরের কাগজের পাতা ওল্টালে ভারতের যে চিত্রটা আমরা পাই তা হল সর্বব্যাপী দুর্নীতি, মহিলাদের উপর পুরুষের যথেচ্ছাচার তথা খাদ্যাভ্যাস বা পোশাকের উপর ধর্মীয় ভেকধারী কিছু গোষ্ঠীর বেনজির নজরদারি। এরই মধ্যে কখনও কখনও হতাশার মেঘকে ছিন্ন করে কিছু মুহূর্ত আসে যেগুলি একটি নতুন ভোরের আশা জাগায়। সম্প্রতি ‘কে এস্ পুট্টাস্বামী বনাম ভারত সরকার (ইউনিয়ন অব ইন্ডিয়া)’ মামলায় মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট যে সর্বসম্মত রায়ে ভারতের প্রত্যেক নাগরিকের ব্যক্তিপরিসরের অধিকার বা রাইট টু প্রিভেসি-কে মৌলিক অধিকারের স্বীকৃতি দিয়েছে, সেটি এমনই একটি উজ্জ্বল মুহূর্ত। এই রায়ের সারমর্ম শুধু ব্যক্তিগত গোপনীয়তার অধিকারে সীমাবদ্ধ নয়, এটি প্রত্যেক ভারতবাসীর স্বাধিকারের সনদ, সরকারি তথা অন্য কোনও রকম অযাচিত হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে ঢালের মতো। ভারতকে একটি মুক্ত ও প্রগতিশীল সমাজ হিসেবে তুলে ধরার ক্ষেত্রে এই রায়ের মূল্য অপরিসীম।
সর্বোচ্চ আদালতের নয় জন বিচারপতি একমত হয়ে রায় দিলেন যে, নাগরিকের ব্যক্তিপরিসরের অধিকার তার ব্যক্তিস্বাধীনতারই বহিঃপ্রকাশ। এই অধিকার ভারতীয় সংবিধানের চেয়েও প্রাচীন। সংবিধান কেবলমাত্র স্বীকৃতি দেয় এটিকে। সেই অর্থে এই অধিকার অন্যান্য ব্যক্তিগত অধিকারের থেকেও মৌলিক। গোপনীয়তার অভাব থাকলে, না মুক্ত-চিন্তা করা যাবে, না যাবে খোলা মনে কথা বলা। আবার এই গোপনীয়তার জোরেই ইচ্ছেমত ধর্ম অবলম্বন, ধর্ম ত্যাগ বা ধর্ম পরিবর্তন করা যাবে। অর্থাৎ আদালতের মতে এটি যত না ব্যক্তিপরিসর রক্ষার অধিকার, তার চেয়েও বেশি এটি আত্মসম্মানের সঙ্গে বাঁচার তথা ব্যক্তিগত স্বাধীনতার অধিকার।
অন্যান্য অধিকারের মতো, বিচারপতিরা বললেন, এই ব্যক্তিপরিসরের অধিকারও কিন্তু শর্তহীন অধিকার নয়। সরকার জনসাধারণের কল্যাণের জন্য এই অধিকারে রাশ টানতে পারে, যদিও সেই আইনকে নিরপেক্ষ, ন্যায়সংগত ও যুক্তিগ্রাহ্য হতে হবে। এই প্রসঙ্গে মাননীয় বিচারপতি চন্দ্রচূড় সহ সংখ্যাগরিষ্ঠ বেঞ্চ-সদস্যরা মত প্রকাশ করেছেন যে, বিশেষ কিছু সরকারি দায়িত্ব সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার জন্য ব্যক্তিগত তথ্যের প্রয়োজন হতে পারে। এর মধ্যে অন্তর্গত দেশের সুরক্ষা-সংক্রান্ত পদক্ষেপ, দণ্ডনীয় অপরাধের তদন্ত, রাজকর আদায়, কল্যাণমূলক কর্মসূচির রূপায়ণ, ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। পুলিশি তদন্তের সূত্রে সন্দেহভাজন অপরাধীর নাম, ঠিকানা এবং আরও কিছু অত্যাবশ্যক তথ্য এবং তার চলাফেরার উপর নজর থাকা যে স্বাভাবিক, সেই বিষয়ে দ্বিমতের অবকাশ নেই। আবার জনকল্যাণমুখী প্রকল্পে অনুদান বিতরণের সময় গ্রাহকের সম্পূর্ণ তথ্যের প্রয়োজন, যাতে একই গ্রাহক মাত্র এক বারই সেই অনুদান পায়। কিন্তু যদি এই আইনগুলির মাধ্যমে সরকার প্রয়োজনের চেয়ে বেশি তথ্য সংগ্রহ করে বা সরকারি কর্তব্য পালনের অজুহাতে অকারণ তথ্য সংগ্রহ বা বিতরণ করে, তা হলে সেই আইনের অংশবিশেষ অসাংবিধানিক ঘোষিত হতেই পারে।
মূলত যে চারটি ক্ষেত্রে এই রায়ের প্রভাব উল্লেখযোগ্য হতে পারে সেগুলির মধ্যে প্রথম ও প্রধান হল ইন্টারনেটের ব্যবহার। আমরা যারা প্রতিনিয়ত এই সংযোগ-মাধ্যমটি ব্যবহার করি, তারা বিভিন্ন ওয়েবসাইট ও অ্যাপ-সমূহের তথ্য সংগ্রহের রীতি-রেওয়াজের সঙ্গে পরিচিত। এখনকার দুনিয়াকে বলা হয় ‘বিগ ডেটা’র দুনিয়া, যেখানে ইন্টারনেট-ব্যবহারকারীরা প্রতি মুহূর্তে কিছু ব্যক্তিগত তথ্য অসংখ্য ওয়েবসাইটকে বুঝে-শুনেই জানিয়ে দেয়। সোশ্যাল মিডিয়ার অন্যতম যে ফেসবুক, সে আমাদের বন্ধুর তালিকা, ছবি, পছন্দের রেস্তোরাঁ বা বেড়ানোর জায়গার তালিকা এবং আরও এই রকম ব্যক্তিগত অনেক তথ্যই আমাদের সম্মতি নিয়ে নথিবদ্ধ করে রাখে। অসংখ্য ব্যবহারকারীর থেকে সংগৃহীত তথ্য নিয়ে এই সামাজিক মাধ্যমটি তৈরি করে এক বিরাট তথ্যভাণ্ডার, যার সাহায্যে গড়ে ওঠে এক প্রকার কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্স)। এই কৃত্রিম বুদ্ধি হয়তো বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আমাদের অনুকূলেই ব্যবহৃত হয়। যেমন পুরনো বন্ধুর সঙ্গে যোগাযোগ হওয়া বা পছন্দমত জিনিস কিনতে সাহায্য করা। কিন্তু এটাও সত্যি যে, যে তথ্য আমাদের সুবিধার জন্য ব্যবহার করা যায়, সেই একই তথ্য আমাদের ব্যক্তিগত জীবনে বা সম্পর্কে অপরিসীম ক্ষতিও করতে পারে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এক কুমারী মহিলার ব্যক্তিগত তথ্য-ভিত্তিক এক কম্পিউটার প্রোগ্রামের মাধ্যমে তাঁর বাবা জানতে পারেন যে তাঁর কন্যা গর্ভবতী। ব্যক্তিস্বাধীনতা লঙ্ঘনের এ এক চরম দৃষ্টান্ত। এই জটিল প্রেক্ষিতে, সুপ্রিম কোর্ট কেন্দ্রীয় সরকার দ্বারা তথ্যের সুরক্ষার জন্য গঠিত অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি বি এন শ্রীকৃষ্ণের নেতৃত্বাধীন কমিটিকে নির্দেশ দিয়েছে একটি নতুন তথ্য সুরক্ষা আইন প্রণয়নের রূপরেখা নির্দিষ্ট করতে। এই আইন মুখ্যত বেসরকারি সংস্থাগুলির তথ্য সংগ্রহ ও ব্যবহারের পদ্ধতিকে কোর্টের রায়ের সংগতিসূচক করবে যাতে নাগরিকের যা একান্ত ব্যক্তিগত পরিসর, তা যেন কোনও মতেই লঙ্ঘিত না হয়। আমাদের ইন্টারনেট সার্ফ করার অধিকার এবং দিক্নির্দেশ এখন শ্রীযুক্ত শ্রীকৃষ্ণের হাতে।
দ্বিতীয় যে ক্ষেত্রে এই রায়টির প্রভাব পড়তে পারে সেটি হল আধার প্রকল্প, যদিও এই প্রভাব হবে সীমিত। আদালত মেনে নিয়েছে যে নাগরিকদের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক প্রকল্পে সরকারি সাহায্য দেওয়ায় যেন অসামঞ্জস্য বা অব্যবস্থা না হয়, বিশেষত, একই নাগরিক যেন দু’বার একই অনুদান না পায়। এটি রাজ্যের এক প্রাথমিক দায়িত্ব। এইখানে আধারের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু সরকারি ফরমানের ফলে, আধারের প্রসার এখন আরও বহু ক্ষেত্রে ছড়িয়ে পড়েছে। বিবাহ নথিবদ্ধ করার জন্য আধার, গৃহ-কল্যাণ কেন্দ্রে যোগব্যায়ামের জন্য আধার, জয়েন্ট এন্ট্রান্স পরীক্ষায় বসার জন্য আধার, এই রকম ক্ষেত্রে নির্দেশের পুনর্বিবেচনা করার অবকাশ আছে। তবে খুব সম্ভবত এই রায়ের কোনও ঘোরতর প্রভাব মূল আধার প্রকল্পটির উপর পড়বে না।
তৃতীয়ত, বিচারপতি চেলমেশ্বর বিশেষ ভাবে লিখেছেন যে, নাগরিক কী খাবে অথবা কী পোশাক পরবে, সেটা হুকুমের দ্বারা নির্ধারিত হবে না। বিচারপতি বোব্ডেও লিখেছেন যে কেবল বাড়ির মধ্যে নয়, বাইরেও যেন এই গোপনীয়তা বজায় থাকে— এমনটাই সংবিধানের আদেশ। এই দুটি চিন্তাকে মিলিতভাবে দেখলে, সর্বোচ্চ প্রভাব পড়বে তিনটি ক্ষেত্রে। প্রথম, কিছু রাজ্য সরকারের গোমাংস নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্তে, কারণ খাদ্যাভ্যাস নাগরিকের স্বাধীন ইচ্ছা। দ্বিতীয়, সুপ্রিম কোর্টের যে রায় অনুসারে সমকামিতাকে দণ্ডবিধির ৩৭৭ ধারার জেরে দণ্ডনীয় অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়েছিল, সেই রায়ও এখন প্রশ্নের মুখে। ধনঞ্জয় চন্দ্রচূড় বলেছেন যে সংখ্যায় নগণ্য হলেও প্রতিটি মানুষের যৌন পছন্দ তাঁর গোপনীয়তার একেবারে মূলে। এই ক্ষেত্রে সরকারের কোনও বাধা থাকতে পারবে না। তৃতীয়, অধুনা প্রধান বিচারপতি দীপক মিশ্র প্রেক্ষাগৃহে জাতীয় সংগীত বাজাবার ও বাধ্যতামূলক ভাবে উঠে দাঁড়ানোর যে নির্দেশ দিয়েছেন, তাকে বাস্তবে রূপায়িত করা নিঃসন্দেহে ব্যাহত হবে, কারণ এটি ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের উপর আঘাত। প্রিভেসি রায়ের সারমর্ম এক উদার ভারতের সূচনা। জ্ঞান যেখানে মুক্ত এবং জাতীয়তাবাদের প্রাচীর দিয়ে সীমিত নয়।
শেষে বলি, গোপনীয়তাকে মৌলিক অধিকার রূপে স্বীকৃতি দেওয়া যতটা উদার ভারতের সূচনার আশা জাগায়, ততটাই খুলে দিতে পারে এক অন্ধকার জগতের দরজা। অত্যধিক গোপনীয়তার অধিকার পুরুষকে দিতে পারে ঘরের মধ্যে নারীকে অত্যাচারের লাইসেন্স। দুর্নীতিগ্রস্ত নেতাকে দিতে পারে দুর্নীতি চাপা দেওয়ার সুযোগ, সরকারকে দিতে পারে সংবাদমাধ্যমকে দাবিয়ে রাখার অজুহাত।
ভবিষ্যতের ঘটনাপ্রবাহ এবং সেই প্রেক্ষাপটে এখনকার বিচারপতিদের উত্তরসূরিদের আইনি সিদ্ধান্ত অনুসারে এই প্রিভেসি-তত্ত্বের ব্যাখ্যা অবশ্যই সময়ের সঙ্গে বিবর্তিত হবে। একই সঙ্গে তথ্য সুরক্ষা আইন (ডেটা প্রোটেকশন ল) নির্ধারণ করবে যে, ইন্টারনেট-ভিত্তিক দৈনন্দিন কাজে যথা মতামত প্রকাশ করায় (টুইটার বা ফেসবুক), ই-মেল, আড্ডা মারায়, বা অ্যাপের সাহায্যে কেনাকাটা করায় আমাদের ব্যক্তিগত তথ্যের কতখানি আমাদের আয়ত্তে থাকবে।
আশা রাখি, এই রায় ভারতকে নিয়ে যাবে এমন এক জায়গায় যেখানে সমাজ নাগরিককে যোগ্য মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করতে পারবে, প্রত্যেক ভারতবাসী বলতে পারবে: আমরা প্রকৃতই স্বাধীন।
বিধি সেন্টার ফর লিগাল পলিসি-র রিসার্চ ডিরেক্টর। সুপ্রিম কোর্টে ব্যক্তিপরিসরের অধিকার সংক্রান্ত মামলায় হরিয়ানা রাজ্য এবং ট্রাই-এর পক্ষে সওয়াল করেছেন। তথ্য সুরক্ষা বিষয়ক শ্রীকৃষ্ণ কমিটি-র সদস্য। মতামত ব্যক্তিগত