বিলম্বের দায়

শিশুধর্ষণের ক্ষেত্রে বিচারের সময়সীমা নির্দিষ্ট হইয়াছে যৌননিগ্রহ হইতে শিশুসুরক্ষা (‘পকসো’) আইনেই।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৯ জুলাই ২০১৯ ০০:২২
Share:

প্রতীকী চিত্র।

সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিরা শিশুধর্ষণের বিচারে বিলম্ব লইয়া উদ্বেগ প্রকাশ করিলেন। চলতি বৎসরের প্রথম ছয় মাসে চব্বিশ হাজারেরও অধিক শিশুধর্ষণের অভিযোগ দায়ের হইয়াছে, কিন্তু কেবল সাড়ে ছয় হাজার মামলার বিচার শুরু হইয়াছে। অধিকাংশ মামলাই তদন্তাধীন, মাত্র চার শতাংশ মামলার রায় বাহির হইয়াছে। স্পষ্টতই শিশুধর্ষণ এবং শিশুদের উপর যৌননিগ্রহের প্রতি ‘শূন্য সহনশীলতা’ নীতির রূপায়ণ সহজ হইবে না। শিশুধর্ষণের সংখ্যা হ্রাস পাইবার ইঙ্গিত মিলে নাই, তাহার দ্রুত বিচারও এখন অধরা রহিয়া গিয়াছে। প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈ এবং বিচারপতি দীপক গুপ্ত এ বিষয়ে দেশের রাজধানীর দৃষ্টান্ত দিয়াছেন। এ বৎসর জুন মাস অবধি নয়াদিল্লিতে ৭২৯টি শিশুধর্ষণের ঘটনা ঘটিয়াছে, তাহার মাত্র ১৭০টি মামলার বিচার শুরু হইয়াছে, এবং কেবল দুইটির রায় বাহির হইয়াছে। রাজধানীতেই এই পরিস্থিতি হইলে বাকি দেশে কী অবস্থা হইতে পারে, সে বিষয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করিয়াছেন বিচারপতিরা। তাঁহাদের উদ্বেগ অমূলক নহে। সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক সমীক্ষা অনুসারে, দিল্লি ও পঞ্জাবে ফৌজদারি মামলার বিচারের গতি তুলনায় বেশি। ওড়িশা, বিহার, গুজরাত ও পশ্চিমবঙ্গে রায় মিলিতে সর্বাধিক বিলম্ব হয়। শিশুর যৌননিগ্রহের অভিযোগে নিষ্পত্তি কী করিয়া দ্রুত হইতে পারে, তাহার নানা উপায় শীর্ষ আদালতে আলোচিত হইয়াছে। বিবিধ জৈব ও রাসায়নিক সাক্ষ্যের পৃথক পরীক্ষাগার (‘ফরেন্সিক ল্যাবরেটরি’), শিশুনিগ্রহের মামলার পৃথক আদালত, শিশুনিগ্রহের মামলার জন্য নিবেদিত সরকারি আইনজীবী, প্রভৃতি সুপারিশ করিয়াছেন আইন বিশেষজ্ঞরা।

Advertisement

শিশুধর্ষণের ক্ষেত্রে বিচারের সময়সীমা নির্দিষ্ট হইয়াছে যৌননিগ্রহ হইতে শিশুসুরক্ষা (‘পকসো’) আইনেই। ওই আইনের নির্দেশ, মামলার রায় বাহির করিতে হইবে দুই মাসের মধ্যে। কিন্তু কোনও রাজ্য সেই লক্ষ্য পূরণ করিতে পারে নাই। অথচ সরকারের প্রবণতা আইনকে আরও কঠোর, শাস্তিকে আরও তীব্র করিয়া তুলিবার। এখন ফৌজদারি আইনে পরিবর্তন করিয়া শিশুকন্যা নিগ্রহের শাস্তি দশ বৎসরের কারাদণ্ড হইতে বিশ বৎসর করিবার চেষ্টা চলিতেছে। অথচ অপরাধবিজ্ঞানীদের মতে, শাস্তির তীব্রতার চাইতেও শাস্তি পাইবার নিশ্চয়তা অপরাধীকে নিরস্ত করিতে অধিক কার্যকর হয়। ভারতের বিবিধ আদালতে জমিয়া আছে সাড়ে তিন কোটি মামলা। পুলিশের তদন্ত এতই ছিদ্রবহুল, বিচার এমনই বিলম্বিত যে অপরাধী ফাঁকতালে ছাড়া পাইবার আশা করিতে সাহস পায়। একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের হিসাব, ২০১৬ সাল অবধি শিশুনিগ্রহের যত মামলা হইয়াছে, তাহার নিষ্পত্তি কেরলে হইবে ২০৩৯, গুজরাতে ২০৭১ সালে। এত দিন ধরিয়া আদালতে সাক্ষ্য দিবে নির্যাতিত, এই প্রত্যাশাই তো অন্যায়!

এই অমানবিক পরিস্থিতির সম্মুখে দাঁড়াইয়া কখনও মহিলাদের জন্য বিশেষ আদালত, কখনও শিশুদের জন্য বিশেষ আদালত তৈরি করিবার সুপারিশ করা হইতেছে। বিশেষ আদালত হইলে ভাল, কিন্তু তাহাতে সমস্যা মিটিবে না। প্রয়োজন নিম্ন আদালতগুলিকে তৎপর করিয়া তোলা। পুরাতন মামলা মিটাইয়া, তদন্ত ও বিচারে গতি আনিয়া বিচারব্যবস্থাকে পুনরুজ্জীবিত করিতে হইবে। সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক সমীক্ষা বলিতেছে, মামলা নিষ্পত্তির হার একশত শতাংশ করিতে হইলে নিম্ন আদালতে আরও ২২৭৯ বিচারক এবং হাইকোর্টগুলিতে আরও তিরানব্বই জন বিচারপতি প্রয়োজন। ইহার জন্য বাড়তি পদ সৃষ্টির প্রয়োজন নাই, কেবল শূন্য পদ পূরণের প্রয়োজন। অতএব প্রশ্ন, সরকার কেন সেই অত্যাবশ্যক কাজটিতে বিলম্ব করিতেছে? অপরাধীকে প্রশ্রয় দিবার, বিচারপ্রার্থীকে বিপন্ন করিবার দায় সরকারও এড়াইতে পারে না।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement