আমেরিকার বিদেশ সচিব রেক্স টিলারসন। ছবি: এএফপি।
কঠোরতর হচ্ছে বার্তাটা। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ করতেই হবে পাকিস্তানকে— এ যাবৎ বার্তাটা ছিল এই রকম। এ বার তা অনেকটা বদলে গেল। নিজেদের ভূখণ্ডে জঙ্গি পরিকাঠামো যদি না ভাঙে পাকিস্তান, তা হলে সে পরিকাঠামো অক্ষুণ্ণ থেকে যাবে, এমনটা যেন ইসলামাবাদ না ভাবে— সংযত ভঙ্গিতে অত্যন্ত কঠোর সতর্কবার্তা ওয়াশিংটনের। আমেরিকা তার লক্ষ্যপূরণ করবেই, কৌশল বদলে কী ভাবে লক্ষ্যে পৌঁছতে হয়, সে বিষয়ে আমেরিকা অবগত— হুঁশিয়ারি অনেকটা এমনই।
পাকিস্তানি ভূখণ্ডে সন্ত্রাসবাদ বা জঙ্গি পরিকাঠামোর অবাধ বাড়বাড়ন্তের বিরুদ্ধে ভারত যেমন সরব, আমেরিকাও তেমনই। পাকিস্তানের সঙ্গে সুদীর্ঘ মিত্রতার ইতিহাস রয়েছে যে দেশের, সেই আমেরিকাই গত কয়েক বছর ধরে সন্ত্রাস প্রসঙ্গে ক্রমশ সুর চড়াচ্ছে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে। প্রথমে প্রকাশ্যে নিন্দা, তার পরে সহায়তার বহর ছেঁটে ফেলা, অবশেষে অনুদান আটকে দেওয়া— ধাপে ধাপে পাকিস্তানের সঙ্গে অসহযোগিতা বাড়িয়েছে আমেরিকা। বার বার স্পষ্ট করে জানানো হয়েছে, সন্ত্রাসে মদত দেওয়া বন্ধ হলেই সহযোগিতা ফিরবে আগের যুগে। কিন্তু মার্কিন হুঁশিয়ারিতে বা ক্রমবর্ধমান অসহযোগিতায় যে কাজ হয়নি, তা গোটা বিশ্বের কাছেই স্পষ্ট। আমেরিকার বিদেশ সচিব রেক্স টিলারসনের পাকিস্তান সফর কিন্তু এই টানাপড়েনের পথে একটা নতুন মাইলফলক হয়ে উঠল। পাকিস্তান সফর সেরে ভারতে পা রেখেই টিলারসন জানিয়েছিলেন, সন্ত্রাস প্রশ্নে পাকিস্তানকে অত্যন্ত কঠোর বার্তা দিয়ে এসেছেন তিনি। তবে কতটা কঠোর সে বার্তা, গোড়ায় ঠাহর হয়নি ঠিক মতো। টিলারসন নিজের দেশে ফেরার পথে জেনিভায় যা জানিয়েছেন এবং তার পরে মার্কিন বিদেশ দফতর টিলারসনের পাক সফর সংক্রান্ত যে তথ্য প্রকাশ্যে এনেছে, তাতে একে মাইলফলক বলতেই হচ্ছে।
পাকিস্তানকে সন্ত্রাস প্রশ্নে কড়া বার্তা আগেও দিয়েছে আমেরিকা। কিন্তু রেক্স টিলারসন এবং তাঁর দফতর এ বারের বার্তা সম্পর্কে যা জানাচ্ছেন, সেই বার্তাই যদি দিয়ে থাকেন পাকিস্তানকে, তা হলে এ কথা মানতেই হবে যে, আমেরিকার কাছ থেকে এত কঠোর হুঁশিয়ারি আগে কখনও শুনতে হয়নি পাকিস্তানকে।
আরও পড়ুন
টিলারসন কি তবে মধ্যস্থতা চাইছেন
মার্কিন বিদেশ সচিব পাকিস্তানকে যে বার্তা দিয়েছেন, তাতে ভারতের বক্তব্যই মান্যতা পেয়েছে। সন্ত্রাস প্রসঙ্গে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতের যা কিছু অভিযোগ, সে সবই স্বীকৃতি পাচ্ছে আমেরিকার অবস্থানে। এতে নয়াদিল্লির স্বস্তিবোধ করার যথেষ্ট অবকাশ যে রয়েছে, সে কথা মানতেই হবে। আন্তর্জাতিক মহলের সামনে পাকিস্তানের মুখোশটা যে ভারত খসিয়ে দিতে পেরেছে, তাও অবশ্যই নয়াদিল্লির সাফল্যই। কিন্তু ভারতের পশ্চিমের প্রতিবেশীকে সুদূর পশ্চিম থেকে আসা মিত্র দেশ কঠোর সতর্কবার্তা দিয়ে গেল বলে নয়াদিল্লির আহ্লাদিত হওয়ার কিছু নেই। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে ভারতের লড়াই আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাচ্ছে, এ নিশ্চয়ই গরিমার বিষয়। কিন্তু শুধুমাত্র পশ্চিমী বিশ্বের ভরসায় এ লড়াই যে লড়া যাবে না, সে কথাও নয়াদিল্লিকে বুঝে নিতে হবে। ভারতের ভূকৌশলগত অবস্থান এমনই যে, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সম্পূর্ণ সাফল্য পেতে প্রতিবেশী দেশগুলিকেও সঙ্গে নিয়ে চলতে হবে ভারতকে। আমেরিকা যতটা উচ্চকিত ভাবে পাক সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সরব, ভারতের বৃহৎ প্রতিবেশী চিনের কণ্ঠস্বর সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে ততটা উচ্চকিত নয়। সন্ত্রাস প্রশ্নে চিন ইতিমধ্যেই পাকিস্তানকে প্রকারান্তরে সতর্কবার্তা দিয়েছে, সে কথা ঠিক। কিন্তু পাক ভূখণ্ড থেকে জঙ্গি পরিকাঠামো নির্মূল করাই যদি ভারতের লক্ষ্য হয়, তা হলে আরও সক্রিয় এক চিনকে প্রয়োজন ভারতের। সে কথা মাথায় রেখে এই লড়াইতে চিনকেও পুরোদস্তুর সামিল করার চেষ্টা ভারতকে চালিয়ে যেতে হবে। তাতে আমেরিকা নির্ভরতা যেমন কমবে, তেমনই আঞ্চলিক ভারসাম্যও বজায় রাখা যাবে।