Student

প্রশ্নপত্র হাতে নিয়েই অজ্ঞান

অন্য দিকে অভিযোগ উঠছে, মাধ্যমিকের খাতা দেখার নিয়মকানুন এতটাই শিথিল হয়েছে যে ফেল করাই কঠিন।

Advertisement

মনীষা বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৮ মার্চ ২০২০ ০০:০১
Share:

মাধ্যমিকের অঙ্ক পরীক্ষা। প্রশ্নপত্র হাতে নিয়েই এক জন পরীক্ষার্থী অজ্ঞান। তাকে নিয়ে হাসপাতালে ছুটলেন দিদিমণিরা। পরবর্তী তিন ঘণ্টায় পরীক্ষা দেওয়ার মতো অবস্থা আর তার হল না। পরীক্ষা চলাকালীন আরও দু’জন অসুস্থ। পরীক্ষার শেষে বেরোবার সময়ে আরও এক জন। এ বছরের এই ঘটনা ব্যতিক্রম নয়। ফি-বছরই ঘটে চলেছে এমন কাণ্ড। জল, ওষুধ, তোয়ালে নিয়ে তৈরি থাকেন শিক্ষিকারা। আগে অঙ্ক আর ইংরেজি ছিল ভয়ের দিন, এখন ভয়ের ভূত চেপেছে ইতিহাসের কাঁধেও। গণিত আর ইংরেজি পরীক্ষার আগের দিনগুলো ছুটি রাখা হয়, তবু ভয় কাটে না।

Advertisement

অন্য দিকে অভিযোগ উঠছে, মাধ্যমিকের খাতা দেখার নিয়মকানুন এতটাই শিথিল হয়েছে যে ফেল করাই কঠিন। ভুল বানান লিখলেও নম্বর কাটা যাবে না, সম্প্রতি এই নির্দেশ নিয়ে কত ব্যঙ্গাত্মক রচনা লেখা হল। পরীক্ষায় ঢালাও নম্বর দেওয়ার ফলে পড়াশোনার মান যে তলানিতে ঠেকেছে তা নিয়ে প্রায় সবাই একমত। শোনা যায়, পরীক্ষকেরাও ভুল উত্তরের সঙ্গে উপরমহলের নির্দেশ মতো নম্বরের দাক্ষিণ্য মেশাতে গিয়ে নাজেহাল। শিক্ষকমহলে এমন ঠাট্টাও চলে যে পরীক্ষক ফাঁকা খাতা বা ভুলে-ভরা খাতায় নিজেই নীল কালিতে লিখে, লাল কালিতে নম্বর দিয়ে, নিজের এবং বোর্ডের মুখ রক্ষা করবেন।

নম্বর পাওয়া যদি এত সহজই হয়, তা হলে তো শিক্ষা আনন্দময় হওয়ার কথা। স্কুলজীবনের পরিপূর্ণ স্বাদ নিয়ে ছেলেমেয়েরা হেসেখেলে পরীক্ষা দেবে, এমনটাই প্রত্যাশিত। শিক্ষার মানে ঘাটতির ‘সান্ত্বনা পুরস্কার,’ পড়াশোনায় ভীতি কমে আসা। কিন্তু বাস্তবে তা ঘটছে কই? নব্বই শতাংশ ছেলেমেয়ের মনে বাসা বেঁধেছে পরীক্ষাভীতি। বাজারচলতি নোটবই, সাজেশন, দইয়ের ফোঁটা, তাগা-তাবিজ, সব কিছুর পরেও প্রশ্ন দেখে কান্না! সেই কবিতাটা আজও সত্য, ‘‘ছাত্রজীবন ছিল সুখের জীবন, যদি না থাকিত এগজ়ামিনেশন।’’

Advertisement

কেন পরীক্ষা এমন বিভীষিকা হয়ে আসবে অগণিত শিশুমনে? এই সময়ে গোটা শিক্ষাব্যবস্থায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচ্য বিষয় হওয়া উচিত শিক্ষার মূল্যায়ন। যা আজ প্রহসনে পরিণত হয়েছে। যেমন অঙ্কের ক্ষেত্রে ধরেই নেওয়া হয়, অনেকেরই অঙ্কে ‘মাথা’ নেই। অভিভাবকেরাও এটা মেনে নিয়েছেন। কী পদ্ধতিতে মাথা তৈরি করা যায়, সেটা না ভেবে, জোর দেওয়া হয় পরীক্ষার আগে কিছু সূত্র ও উপপাদ্য মুখস্থ করানোর উপর। এমনকি কিছু কিছু গোটা অঙ্ক তার ধাপ সমেত স্মৃতিতে ধরে নিতে বলা হয়। বলা বাহুল্য, অবিকল সেই অঙ্ক পরীক্ষায় না এলে মূর্ছা যেতে হবে।

মূল্যায়নের বহু রকম কৌশল রয়েছে, তার মধ্যে একটি লিখিত পরীক্ষা। কিন্তু অভিভাবক, টিউশন মাস্টার এবং কখনও স্কুলশিক্ষক লিখিত পরীক্ষাকেই একমাত্র নির্ণায়ক পদ্ধতি হিসাবে ধরে নেন। ফলে ব্যাপারটা দাঁড়ায়, পরীক্ষা হল বহু কিছু মাথায় ভরে তিন ঘণ্টার মধ্যে তার দ্রুত উপস্থাপনের দক্ষতা। ‘মাল্টিপল চয়েস’-এর ক্ষেত্রে ততোধিক ক্ষিপ্রতায়, জেনে বা আন্দাজে, ঠিক উত্তরে টিক দেওয়ার ক্ষমতা। এখানে ছাত্রছাত্রীর বিষয়টি বোঝার ক্ষমতা যাচাই হল না। বিশ্লেষণ করার ক্ষমতাও তৈরি হল না। ‘বাবার হল আবার জ্বর সারিল ঔষধে’ এই বাক্যটির প্রতিটি শব্দের প্রথম অক্ষর দিয়ে যখন ছাত্রকে মুঘল সম্রাটদের নাম মনে রাখতে হয়, তখন বুঝতে হবে যে প্রত্যেক সম্রাটকে তাঁর নিজস্ব বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী পৃথক করে সে জেনেই উঠতে পারেনি। ফলে উত্তরকালে সহজেই সে ইতিহাস বিকৃতির শিকার হতে পারে।

অথচ শিক্ষার অধিকার আইন অনুযায়ী, অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত মূল্যায়নের পদ্ধতি কিন্তু অন্য রকম হওয়ার কথা। সেটা নিরবচ্ছিন্ন সার্বিক মূল্যায়ন। সে কারণেই হোক, বা ফেল করার ব্যবস্থা নেই বলেই হোক, উচ্চ প্রাথমিক পর্যন্ত পরীক্ষার ভয় দেখা যায় না। এই মূল্যায়নের একটি সূচক নির্দেশ করে সহযোগিতার দিকে। এটাই নম্বর-সর্বস্ব মাধ্যমিকে গিয়ে দাঁড়ায় কঠোর প্রতিযোগিতায়। এতটাই যে, মাধ্যমিকের ‘ভাল’ ছাত্রী উচ্চ মাধ্যমিকে খুঁজতে থাকে এমন স্কুল যেখানে পড়ানো না হলেও চলবে, কিন্তু প্রোজেক্টে সবাইকে ঢালাও নম্বর দেওয়া হবে। কে না জানে, ‘ফার্স্ট বয়দের দেশে’ নম্বরই শেষ কথা বলে। ‘শিক্ষার উদ্দেশ্য’ বলে যে ভাল ভাল কথা বইতে লেখা থাকে, কাজের বেলা সেগুলো জলাঞ্জলি দিয়ে আজকের মূল্যায়ন সেই নম্বরেই ঠেকছে। এই আকাশছোঁয়া নম্বর নিয়ে কলেজে পৌঁছে দেখা যায়, অনেকেই বিষয়ের ভারে হিমশিম খাচ্ছে, কারণ তার জানা বা বোঝার ভিত্তি তৈরি হয়নি।

সত্যিই কি এক বিষম সমাজে সকলকে সমান সুযোগ দিতে এই বোর্ড পরীক্ষা, যেখানে একযোগে দশ লক্ষ ছেলেমেয়ের একই পদ্ধতিতে মূল্যায়ন হয়? শ্রেণি ও জাতি-নির্বিশেষে ছেলেমেয়েরা শুধু রোল নম্বর হয়ে পরীক্ষা দেয়। কিন্তু ফলাফলের পর কৃতকার্যতার পরিসংখ্যানে দেখা যায়, নম্বরের অনুক্রমে তারাই পিছিয়ে থাকে, যাদের তেমন বাঘা কোচিং নেই, বাড়িতে সাহায্য নেই, পরীক্ষার আগের দিন যার বিয়ের পাকা কথা হয়। অঙ্ক আর ইংরেজি ক্লাস যাকে শুধু চোখ রাঙিয়েছে, যার জীবনের সঙ্গে মিলিয়ে এখনও কোনও পাঠ্যপুস্তক তৈরি হল না।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement