অনুজ শর্মা। —ফাইল চিত্র
সূত্র ধরিয়াই রহস্য উন্মোচিত হইয়া থাকে। আশ্চর্য, মাঞ্জা সুতার রহস্যটি, আক্ষরিক অর্থেই সূত্র থাকা সত্ত্বেও, পুলিশের অধরা থাকিয়া যাইতেছে। নগরপাল অনুজ শর্মা নির্দেশ দিয়াছিলেন, এই বিপজ্জনক সুতার ব্যবহার বন্ধ করিতে হইবে। মা উড়ালপুলের উপর এই সুতায় বাইক-আরোহীদের আহত হওয়ার ঘটনাকে যদি সূচক হিসাবে ধরা হয়, তবে বোঝা সম্ভব, নগরপালের আদেশে পুলিশ বিশেষ গা করে নাই। উড়ালপুলের উপর সুতার টানে মৃত্যু নাচিতেছে। অভিজ্ঞদের মতে, ইহা স্বাভাবিক মাঞ্জা সুতা নহে— বিশেষ ধারসম্পন্ন সুতা। তাহাকে ছিন্ন করা দুষ্কর। ফলে, উড়ালপুলের উপর অপেক্ষাকৃত দ্রুত গতিতে ধাবমান বাইক-আরোহীদের নিকট তাহা সাক্ষাৎ মৃত্যু-পরোয়ানা। তরবারির ক্ষিপ্রতায় অঙ্গচ্ছেদ করিতে সক্ষম এই সুতা। কাণ্ডজ্ঞান বলিবে, এই ধরনের সুতার ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা প্রয়োজন। উড়ালপুলের নিকটে তো বটেই, সর্বত্র। কারণ, অন্যের জীবন লইয়া খেলিবার অধিকার কাহাকেও দেওয়া যায় না। এ-হেন সুতা কে বেচিতেছে, তাহা ধরা খুব কঠিন হইবার কথা নহে। এবং, তাহা কে ব্যবহার করিতেছে, ধরা নিতান্তই সহজ। আড়ালে থাকিয়া ঘুড়ি উড়ানো অসম্ভব, তাহার জন্য খোলা জায়গায় আসিতেই হয়। অতএব, নজরদারিতে জোর দিলে দিনকয়েকের মধ্যেই বহু লোককে ধরিয়া ফেলা সম্ভব হইবে। বিক্রেতা এবং উপভোক্তা, উভয় পক্ষের জন্যই কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা হইলে এই অনাচার থামিতে বিশেষ সময় লাগিবে না। নজরদারির কাজটিও চালাইয়া যাইতে হইবে। বিপদ যত ক্ষণ অন্যের, তত ক্ষণ যাহারা গা করে না, তাহাদের সম্মুখে বিপদ উপস্থিত করাই নিয়ন্ত্রণের শ্রেষ্ঠ পন্থা। ঘুড়ি উড়াইয়া জেলে যাইতে অনেকেরই আপত্তি থাকিবে বলিয়া অনুমান করা চলে।
কলিকাতা পুলিশ এই কথাগুলি জানে না বলিয়া বিশ্বাস করা কঠিন। যেমন, নিষিদ্ধ বাজি কেনাবেচা কী ভাবে বন্ধ করিতে হয়, ভাসানের মিছিলে ডিজে-র অত্যাচার থামাইবার পথ কী, সেই কথাগুলিও পুলিশ বিলক্ষণ জানে। কিন্তু, জানা এক, করা আর এক। পুলিশ করে না। নগরপাল ‘কঠোর নির্দেশ’ দেন, দুই একটি ক্ষেত্রে পুলিশ কাজ করিয়া ফেলিলে কর্তারা সোশ্যাল মিডিয়ার পাতায় এমনই ঢাকের বাদ্যি বাজান যে কান পাতা মুশকিল হয়। তাহার পর, যে কে সেই। জিজ্ঞাসা করিলে সম্ভবত উত্তর আসিবে, নজরদারি করিবার মতো লোকবল পুলিশের নাই। নাগরিক নিরাপত্তার প্রশ্নে ইহা যুক্তি হইতে পারে না। প্রকৃত কারণটি সম্ভবত ভিন্ন— পুলিশের হাত-পা বাঁধা। কোনও অপরাধে কাহাকে গ্রেফতার করামাত্র বিভিন্ন প্রান্ত হইতে এমনই রাজনৈতিক চাপ আসিতে আরম্ভ করে যে গ্রেফতারিটি শেষ অবধি প্রহসনে পরিণত হয়। ফলে, পুলিশেরও অভ্যাস হইয়া গিয়াছে— নিতান্ত ঘাড়ে আসিয়া না পড়িলে ছোটখাটো বিষয়ে বাহিনী আর মাথা ঘামায় না। বাজি বা ডিজের ক্ষেত্রে না হইলেও উড়ালপুলে সুতার হাত হইতে বাইক-আরোহীদের বাঁচাইবার আর একটি পন্থা অবশ্য আছে— পুলিশ ভাবিয়া দেখিতে পারে— উড়ালপুলে বাইক চলাচল নিষিদ্ধ করিয়া দেওয়া। উড়ালপুলে নৈশ বাইক-দৌড় থামাইতে অপারগ হইয়া যেমন পুলিশ রাত্রি দশটার পর বহু উড়ালপুলেই আর বাইক উঠিতে দেয় না। তাহাতে নাগরিকের অসুবিধা হইবে বিলক্ষণ, কিন্তু পুলিশ যদি তাঁহাদের প্রাণরক্ষার দায়িত্ব না লইতে পারে, বাঁচিয়া থাকিবার ইহাও একটি উপায়।