এক মাস ধরে চলা একটা যুদ্ধ এ বার শেষ হতে যাচ্ছে। ফুটবলের যুদ্ধ, বিশ্বকাপের জন্য মরণপণ লড়াই। যে দেশ খেলছে বা যে দেশ খেলছে না নির্বিশেষে সবাই মোটামুটি এখন একই সুরে। কারও মন খারাপ, কারও দুঃখ, কারও আনন্দ, কারও স্বপ্নভঙ্গ, এ সবেরই কেন্দ্রে একটা ফুটবল।
ধরে নেওয়া যাক না কেন এ কলকাতারই কথা, অথবা চন্দননগর, অথবা বর্ধমান, অথবা শিলিগুড়ি। কোন এক জাদুবলে বর্ধমানে নেমে আসছে লন্ডন, চন্দননগর আর প্যারিস একাকার হয়ে যাচ্ছে, ব্রাজিল আর আর্জেন্টিনার জন্য গলা ফাটিয়ে লড়াই করে যাচ্ছে কলকাতার এ পাড়া ও পাড়া— এই ছবিটার জন্য অপেক্ষা করতে হবে আবারও চার বছর। এই চার বছরে তামাম দুনিয়ার আপামর মানুষ আমরা কি বিশ্বকাপের পাঠগুলো ঝালিয়ে নেব একবার, একবার ভেবে দেখব এই বিশ্বকাপ, অথবা এই ফুটবল অথবা নির্বিশেষে যে কোনও খেলাই এক বিরাটের শিক্ষা কী ভাবে দিয়ে যায় আমাদের?
তীব্র প্রতিযোগিতা, জেতার জন্য মরণপণ প্রয়াস, তীব্র অধ্যবসায়, সমষ্টি হিসাবে বাঁচার মন্ত্রগুপ্তি— এবং এই সবকে ছাপিয়েও একটা সর্বজনীনের পাঠ মাঠ জুড়ে ছড়িয়ে দেওয়ার কী দারুণ ছবিটাই না আঁকা হয়! মাঠের বাইরে যে বৃহত্ জগত্, পৃথিবীর সেই ক্লিষ্ট রণাঙ্গনে শরণাগত উদ্বাস্তুরা যখন লাখে লাখে জড়ো হন সীমান্তগুলোতে, এবং মুখোমুখি হন তীব্র দ্বেষ-ঘৃণাভরা একটাই বার্তার, ‘তোমরা অনাকাঙ্খিত’— ঠিক সেই সময়ই ফ্রান্স অথবা ক্রোয়েশিয়া, ইংল্যান্ড অথবা বেলজিয়াম স্বপ্ন দেখে উমতিতি, মডরিচ, লুকাকুদের কাঁধে সওয়ার হয়ে বিশ্বকাপ জেতার। মুহূর্তে ভৌগোলিক রেখাগুলো দূর হয়ে যায়, মুছে যায় যেন সামাজিক ব্যবধানগুলোও। খেলা কোথাও নিয়ে আসে এই মিলন প্রাঙ্গনেও। জেতার জন্য তীব্র আকুতি যে খেলার মাঠের লড়াইয়ের একটা অঙ্গমাত্র, এই বোধ শেখায় এক দলের খোলয়াড়কে অন্য দলের খেলোয়াড়ের প্রতি সম্মান জানানোর।
সম্পাদক অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা আপনার ইনবক্সে পেতে চান? সাবস্ক্রাইব করতে ক্লিক করুন
রাজনৈতিক ময়দানে অথবা পাড়ার ছোট বিবাদে যখন আমার ক্রমাগত ছোট থেকে আরও ছোট গণ্ডির মধ্যে নিজেদের আটকে দিচ্ছি, যখন হৃদয়ের উদারতাকে ক্রমাগত আরও ছোট করে তুলছি আমরা, যখন বিদ্বেষ এবং ঘৃণাকেই স্বাভাবিক নিয়ম বলে গণ্য করছি, তখন আমরা একবার কি খেলার মাঠের এই শিক্ষাটাকে নেব? আরও একবার ব্রাজিল, আর্জেন্টিনার জন্য গলা ফাটানোর আগে চার বছর ধরে আমরা ঝালিয়ে নেব উদার হওয়ার এই পাঠ?
আরও পড়ুন: ঘৃণা আর চোখরাঙানিকে পিছনে ফেলে এই বিশ্বকাপ আসলে উদ্বাস্তুদের