Sean Connery

যে তারা মাটির কাছাকাছি

এডিনবরার প্রায়-বস্তিতে জন্ম, শ্রমিক বাবা ও সাফাইকর্মী মায়ের অভাবের ঘরে বড় হওয়া।

Advertisement

শিশির রায়

শেষ আপডেট: ০৭ নভেম্বর ২০২০ ০০:৪৫
Share:

পুরাতন যুগসত্য ছিল, ‘ব্যাদে সব আছে’। নতুন যুগসত্য হল— ‘নেটে সব আছে’। বাহামায় নিজের প্রাসাদোপম বাড়িতে গত ৩১ অক্টোবর ঘুমের মধ্যেই মারা গেলেন স্যর টমাস শন কনরি, তার পর থেকেই আন্তর্জাল ভরে উঠেছে রুপোলি পর্দার প্রথম ও সবচেয়ে বিখ্যাত জেমস বন্ডকে নিয়ে হাজারও খবরে। পাঁচ দশকেরও বেশি অভিনয়জীবনে স্যর শন সিনেমার মণিমুক্তো দিয়েছেন অনেক, ৯০ বছরের দীর্ঘ জীবন শেষ হতে খোঁজ মিলল বিচিত্রতর জীবনবৈভবের।

Advertisement

এডিনবরার প্রায়-বস্তিতে জন্ম, শ্রমিক বাবা ও সাফাইকর্মী মায়ের অভাবের ঘরে বড় হওয়া। নিজেদের বাথরুম পর্যন্ত ছিল না! আর কাজ? বাড়ি বাড়ি দুধ পৌঁছে দেওয়া। ট্রাক চালানো। কফিন পালিশ করা। রয়্যাল নেভিতে যোগ দিয়েছেন, ‘মিস্টার ইউনিভার্স’ প্রতিযোগিতাতেও। নুড মডেলিংও করেছেন তরুণ শন কনরি! বৃন্দগানের দলে যোগদান, মিউজ়িক্যালে অভিনয়, তার পর ছোট-বড় ‘পার্ট’ করতে করতে ১৯৬২-তে বিস্ফোরণ— ডক্টর নো! দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী কূটনৈতিক অবিশ্বাস আর দোলাচলের রাজনীতিবিশ্বকে ইয়ান ফ্লেমিংয়ের তুখোড় ধুরন্ধর ব্রিটিশ গুপ্তচর জেমস বন্ডের অবয়বে পর্দায় হাজির করল লন্ডনের প্রযোজনা সংস্থা ‘ইঅন প্রোডাকশনস’। পৃথিবী পেল শন কনরিকে!

১৯৬২ থেকে ১৯৭১, ছ’টা ‘অফিশিয়াল’ বন্ড-ছবিতে নামভূমিকায় অভিনয়, ’৮৩ সালে আরও একটায়। জেমস বন্ড চরিত্রে অভিনয় তাঁকে অর্থ, যশ, খ্যাতি, প্রতিষ্ঠা দিয়েছে, বাহামার দ্বীপে বিরাট এস্টেটের গল্ফ কোর্সওয়ালা বিলাসবহুল বাংলো-সহ তাঁর বিখ্যাত ফাউন্ডেশন ও বিপুল দানধ্যানের ভিত গড়ে দিয়েছে। কিন্তু মজার কথা, জেমস বন্ডকে খুব একটা পছন্দ করতেন না তিনি। সামনে পেলে খুন করবেন, জেমস বন্ড তাঁরই সঙ্গে শেষযাত্রায় যাবে, নানা সময়ে এমন কথাও বলেছেন। এই সব মন্তব্যে হয়তো তাঁর স্বভাবসিদ্ধ ব্রিটিশ তথা স্কটিশ রসিকতার ছোঁয়াচ মিশে আছে, কিন্তু আক্ষেপও কি নেই? বন্ডের ছবিগুলো প্রবল জনপ্রিয় ও বাণিজ্যসফল বটে, কিন্তু তাদের প্রকৃত নান্দনিক ও শৈল্পিক গুণ নিয়ে বরাবরের সংশয়, এমনকি এ কালেও। শন কনরি সারা জীবনে একটা অস্কার, দুটো বাফটা, তিনটে গোল্ডেন গ্লোব পেয়েছেন, তার কোনওটার সঙ্গেই জেমস বন্ডের কোনও যোগ নেই।

Advertisement

গত অগস্টে এক ব্রিটিশ সমীক্ষায় ‘সেরা বন্ড’ নির্বাচিত হয়েছেন শন কনরি। তাঁর প্রয়াণের পর অন্য জীবিত বন্ডরা— জর্জ ল্যাজ়েনবি, পিয়ার্স ব্রসনান থেকে ড্যানিয়েল ক্রেগ— বিমুগ্ধ শ্রদ্ধায় ভরিয়ে দিয়েছেন স্মরণলেখ। আর দুনিয়া জুড়ে ছড়িয়ে থাকা শন কনরির অভিনয়ের ভক্তেরা বলছেন দ্য আনটাচেবলস, মার্নি (আলফ্রেড হিচকক পরিচালিত) দ্য রক, ফাইন্ডিং ফরেস্টার, দ্য নেম অব দ্য রোজ়, দ্য হান্ট ফর রেড অক্টোবর-এর মতো ছবির কথা। জেমস বন্ডকে খানিক সরিয়ে রাখলে দেখা যাবে, কেরিয়ার জুড়ে বিচিত্র সব চরিত্রকে অভিনয়ে অন্য মাত্রা দিয়েছেন স্যর শন। স্টিভেন স্পিলবার্গের ইন্ডিয়ানা জোন্স অ্যান্ড দ্য লাস্ট ক্রুসেড-এ তিনি ইন্ডিয়ানার বাবা প্রফেসর হেনরি জোন্স সিনিয়র, মার্ডার অন দি ওরিয়েন্ট এক্সপ্রেস-এ কর্নেল আরবাথনট, দ্য রেড টেন্ট-এ অভিযাত্রী রোল্ড আমুন্ডসেন। অড্রে হেপবার্নের পাশে তিনি রবিন হুড, আবার এনট্র্যাপমেন্ট ছবিতে ক্যাথরিন জ়িটা-জোন্সের বিপরীতে হাই-প্রোফাইল চোর রবার্ট ম্যাকডুগাল। আগামেমনন, কিং আর্থার, গ্রিন নাইট থেকে অ্যালান কোয়াটারমেন— সব চরিত্রেই তিনি।

পর্দায়, এবং জীবনেও, তিনি সাফ কথার মানুষ, মহাতারকা হয়েও নিরহং আন্তরিক— বলেছেন তাঁর সহ-অভিনেতা, পরিচালক, চিত্রনাট্যকার থেকে প্রযোজক, সকলেই। দ্য রক-এর শুটিংয়ে পরিচালক শিডিউল ঘেঁটে ফেলে প্রযোজকের ভয়ে থরহরিকম্প, শন কনরি অম্লানবদনে ডিজ়নি-র মেজো-সেজো বাবুদের সঙ্গে লাঞ্চে বসে পড়লেন: “ছেলেটা ভাল কাজ করছে, ওর আরও টাকা চাই!” (এত সোজাসরল ভাষায় বলেননি অবশ্য, খানিক কপট অশ্রাব্যতা মিশে ছিল।) এক বার ফোনে কথা বলতে গিয়ে জানলেন, চিত্রনাট্যকারের এক আত্মীয়া ব্যক্তিগত শোকে চরম বিপর্যস্ত। তক্ষুনি ফোন নম্বর চেয়ে নিয়ে তাঁকে ফোন, আধ ঘণ্টা ধরে কথা বললেন। লন্ডনের নামী পোশাক নির্মাতা সংস্থার কর্তার ফোনে এক দিন ভয়েসমেল, “শন কোনরি বলছি, গোল্ডফিঙ্গার ছবিতে যেমন স্যুট পরেছিলাম, ঠিক তেমন একটার বরাত দিতে চাই আমার ছেলের জন্য।” তারকাসুলভ দেখানেপনা নেই, ও দিকে শনের কণ্ঠস্বর চিরদিনের উপহার হয়ে রইল সেই ব্যবসায়ীর কাছে। এডিনবরায় ট্যাক্সিতে যাচ্ছেন, একটা পাড়ার সব রাস্তা তাঁর চেনা দেখে ট্যাক্সিচালক অবাক। শন বললেন, চিনবই তো, এ পাড়ায় বাড়ি বাড়ি দুধ পৌঁছে দিতাম! নাসিরুদ্দিন শাহ স্মৃতিচারণ করেছেন, দ্য লিগ অব এক্সট্রাঅর্ডিনারি জেন্টলম্যান ছবির শুটিংয়ের অবকাশে স্যর শন সকলের সঙ্গে গল্প করছেন, এখানে-ওখানে চুলকোচ্ছেন... আকাশের তারা নন, সহজ স্বাভাবিক মানুষ।

পৃথিবীকে স্কটল্যান্ডের সেরা উপহার শন কনরি, বলেছেন সে দেশের ফার্স্ট মিনিস্টার। স্যর শন চাইতেন, স্কটল্যান্ড স্বাধীন দেশ হোক। হাতে ট্যাটু করিয়েছিলেন, ‘স্কটল্যান্ড ফরএভার’। ৩০০ বছরেরও বেশি পরে ১৯৯৯ সালে খুলল স্কটিশ পার্লামেন্ট, উচ্ছ্বসিত হয়েছিলেন ভূমিপুত্র। স্কটিশ ন্যাশনালিস্ট পার্টির সদস্য ছিলেন, আর কী আশ্চর্য, সদস্যপদের রসিদের নম্বরটাও ছিল ‘০০৭’!

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement