নতুন নাগরিকত্ব আইনের প্রতিবাদে জমায়েত। অসমে। ছবি: পিটিআই
উত্তর-পূর্ব ভারতের ভৌগলিক এবং আর্থ-সামাজিক অবস্থান ভারতের অন্য অংশের থেকে আলাদা। সুতরাং ‘এক ভারত এক আইন’ গ্রহণের সমস্যা অবশ্যম্ভাবী। এক দিকে, রয়েছে ৫০৫০ কিলোমিটার আন্তর্জাতিক সীমারেখা। যা ভাগ করে নিয়েছে ভূটান (৫০২ কিলোমিটার), চিন (তিব্বত ১০৩৫ কিলোমিটার), মায়ানমার (১৬৪৩ কিলোমিটার) এবং বাংলাদেশ (১৯৭৯ কিলোমিটার)। এখানে অভ্যন্তরীণ সীমারেখা মাত্র ২৮ কিলোমিটার, যা সমগ্র সীমারেখার মাত্র দু’শতাংশ। মনে রাখতে হবে, উত্তর-পূর্ব ভারত আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকা। ফলে (ক) দ্য ইনার লাইন রেগুলেশান (বেঙ্গল অ্যান্ড ইস্টার্ন ফ্রন্টিয়ার), (খ) দ্য শিডিউল ডিস্ট্রিক্ট অ্যাক্ট, (গ) দ্য অসম ফ্রন্টিয়ার ট্র্যাক্ট রেগুলেশন (২), (ঘ) দ্য চিন হিলস রেগুলেশন প্রভৃতি ধারাগুলির মাধ্যমে কিছু নির্দিষ্ট অর্থনৈতিক সুবিধা, কিছু ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ ছাড় দেওয়া হয় স্থিতাবস্থা বজায় রাখার জন্য।
কিন্তু এই অঞ্চল বরাবরই বঞ্চিত। বিশেষজ্ঞেরা মনে করেন, অসমের এই অবস্থার পিছনে আছে দীর্ঘ রাজনৈতিক অবজ্ঞা, অর্থনৈতিক উপেক্ষা, অবহেলা ও ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের শোষণনীতির (১৮২৬-১৯৪৭) ধারাবাহিকতা বজায় রাখা। এ সবই দীর্ঘদিন ধরেই অসমকে অর্থনৈতিক ভাবে পঙ্গু করে দিয়েছে। ১৯৭৪ সালে আসুর তথ্যে উঠে এল এক ভয়াবহ ছবি। দেখা গেল রাজ্য চালানোর জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ রাজ্যের হাতে নেই। ১৯৭০-৮০ সারা ভারতবর্ষের উৎপাদন বৃদ্ধির হার ছিল ১.৪৩ শতাংশ, সেখানে অসমে ছিল মাত্র ০.৪ শতাংশ। ১৯৭১-৮১ সালের মধ্যে বেকার যুবকের সংখ্যা বাড়ল ২৭০ শতাংশ এবং এই একই সময়ে শিক্ষিত মানুষের সংখ্যা বাড়ল ৩৪৩ শতাংশ। এ দিকে রাজ্যের কাছে কোনও চাকরি নেই এবং কেন্দ্রীয় সংগঠনগুলি অসমিয়া এবং আদিবাসীদের সঙ্গে বিমাত্রিসুলভ আচরণ করে। ফলে, কেন্দ্রীয় সরকারের উপরে ঘৃণা তৈরি হল।
এই অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবহেলাই পরে বুমেরাং হয়ে ফিরে এল। ১৯৭৬ একটি সমীক্ষায় দেখা গেল এনএফ রেলওয়ের সদর দফতর গুয়াহাটির মালিগাওে ৪,৪৭৪ কর্মচারীর মধ্যে ৫৯ শতাংশের জন্ম অসমের বাইরে, ৫৭ শতাংশ বাংলাদেশ থেকে আগত এবং ২২ শতাংশ পশ্চিমবঙ্গের। মাত্র ২১ শতাংশ অসমের নাগরিক। অর্থাৎ ৭৯ শতাংশ বাঙালি। দেখা গেল, কয়লা, চা, তেল এবং প্লাইউড শিল্পে স্থানীয় লোকের সংখ্যা নামমাত্র।
অভিযোগ, বড় শিল্পের মালিকেরা সামাজিক কর্তব্য বলতে কিছুই করেনি। ব্রিটিশ এবং ভারতীয় সংস্থাগুলি লাভ্যাংশ অসমে খরচ না করে অন্য রাজ্যে বিনিয়োগ করত। চা বাগানগুলির সদর দফতর পশ্চিমবঙ্গে থাকায় বিক্রয়করের ৫০ শতাংশ পেত অসম। ১৯৭৯-৮০ সালে যেখানে অসম বিক্রয় কর বাবদ পায় ২২ কোটি টাকা পায় সেখানে ৪২ কোটি টাকা পায় পশ্চিমবঙ্গ। অসমের চা বাগানের ৮৫ শতাংশ ম্যানেজার ছিলেন অসমের বাইরের লোক। আর ‘টি বোর্ড’ কলকাতায়। অসমের পরিকাঠামোর উন্নয়নে ‘টি বোর্ড’ এবং চা সংস্থাগুলির অবদান ছিল নূন্যতম। প্লাইউড উৎপাদনের ক্ষেত্রেও ছবিটি এক। যেখানে এক সময়ে এই শিল্প থেকে কেন্দ্রের মুনাফা ছিল ৮০ কোটি টাকা। আর অসম পেত মাত্র ৩৫ লক্ষ টাকা ।
অসমের তেল উৎপাদনে (বেসরকারি) ডিব্রুগড় অগ্রনী ভূমিকা পালন করে। সেখানে ১৮৯০ সালে প্রথম ০.১ মিলিয়ন টন অশোধিত তেল উৎপাদিত হয় এবং ১৯৬২ সাল পর্যন্ত একই রকম চলতে থাকে। কিন্তু ৬০ এর দশকের শেষ ভাগে বিশেষ করে উপরি অসমে প্রচুর তেলের সন্ধানে পাওয়া যায় এবং বাৎসরিক ৩.৫ মিলিয়ন টন অশোধিত তেল উৎপাদন হতে শুরু করে। ১৯৭০ সালে যেটা গিয়ে দাঁড়ায় পাঁচ মিলিয়ন টনে। কিন্তু ১৯৭৯ সালে জানা যায় কেন্দ্র এই অশোধিত তেলের জন্য প্রতি টনে অসমকে দেয় মাত্র ৪২ টাকা। এ নিয়ে প্রবল অসন্তোষ শুরু হলে, কেন্দ্রীয় সরকার ১৯৮০ সালে প্রতি টন তেলের জন্য প্রথমে ৩২৫ টাকা এবং কিছু দিন পরেই ৫৭৮ টাকা করে দিতে শুরু করে। অসম চেয়েছিল মধ্যপ্রাচ্য থেকে আমদানি করা তেলের মূল্যের সমান দেওয়া হোক। যা ছিল বিক্রিয় মূল্যের ২০ শতাংশ। কিন্তু কেন্দ্র রাজি হয়নি। বিক্রয় কর বাবদ যেখানে কেন্দ্রের ভাঁড়ারে জমা পড়ত প্রতি টনে ৯৯১ টাকা সেখানে অসম পেত টন প্রতি ৫৭৪ টাকা।
কেরাসিন তেলের ক্ষেত্রেও দৃশ্যপটের কোনও পরিবর্তন নেই। বিক্রিয় কর বাবদ কোটি কোটি টাকা পশ্চিমবঙ্গের খাতে জমা হত। কারণ, এর বিক্রয় বিভাগের সদর দফতর ছিল শিলিগুড়িতে। অসমে প্রায় ৬০ মিলিয়ন টন প্রাকৃতিক গ্যাস সঞ্চিত আছে। এর সম্পর্কেও কেন্দ্র একেবারে উদাসীন। ৫০ মিলিয়ন কিউবিক ফিট প্রাকৃতিক গ্যাস প্রতিদিন তেলের খনিতে জ্বলিয়ে দেওয়া হয়। যেটা ঠিক ভাবে কাজে লাগালে ভারতের মধ্যে সবচেয়ে ধনী রাজ্যে হিসেবে অসম স্থান পেত। এর থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন, নানা শিল্পের উৎপাদন কাজের সহায়ক বিভিন্ন প্রকার রবার, নাইলন, প্লাসটিক, পলিস্টার ফাইবার, রং এবং ডাই এবং অন্য রাসায়নিক পদার্থ তৈরি হতে পারত। এই অর্থনৈতিক বঞ্চনা অসমে ক্ষোভের প্রেক্ষিতটি তৈরি করে রেখেছিল। এর পরেই ওঠে ভূমিপুত্রের দাবি।
প্রাক্তন অধ্যক্ষ, বিধানচন্দ্র কলেজ, আসানসোল