কৃষ্ণমূর্তি সুব্রহ্মণ্যন
ঔষধটি চিকিৎসাশাস্ত্রসম্মত, সন্দেহ নাই। কিন্তু, মুখ্য অর্থনৈতিক উপদেষ্টা কৃষ্ণমূর্তি সুব্রহ্মণ্যনের ব্যবস্থাপত্রে মোক্ষম কয়েকটি ফাঁক রহিয়া গিয়াছে। ফলে, তাঁহার বেসরকারি বিনিয়োগরূপী বড়ির পরামর্শে ভারতীয় অর্থনীতির স্বাস্থ্য ফিরিবে, এমন ভরসা করা মুশকিল। প্রথম ফাঁকটি হইল, কোন গন্ধমাদনে সন্ধান করিলে বেসরকারি লগ্নি নামক বিশল্যকরণী পাওয়া যাইবে, ২০১৮-১৯ সালের অর্থনৈতিক সমীক্ষায় তিনি জানান নাই। বিদেশি লগ্নি এবং ভারতের ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড বা তারুণ্যের সুবিধা জাতীয় ভাসা ভাসা কথায় দায় সারিয়াছেন। বার্ষিক আট শতাংশ বৃদ্ধির হার বজায় রাখিবার মতো লগ্নি যদি এমনই সহজলভ্য হয়, তবে বার্ষিক সাত শতাংশ বৃদ্ধির ব্যবস্থা করিতেই এত দিন মূলত সরকারি ব্যয়ের উপর ভরসা করিতে হইল কেন? দ্বিতীয় ফাঁকটি এখানেই। বেসরকারি লগ্নি কেন নাই, অর্থনৈতিক সমীক্ষা সে বিষয়ে নীরব। কেহ আশঙ্কা করিতে পারেন, অর্থনীতির রোগের মূল কারণটি স্বীকার করিয়া লইলে আর এই বেসরকারি লগ্নির নিদান দেওয়ার উপায় থাকিবে না বলিয়াই সমীক্ষা মৌনী। সত্য হইল, লগ্নিকারীরা ভারতে নগদ ঢালিতে ভরসা পাইতেছেন না। তাহার এক দিকে যদি নোট বাতিল বা জিএসটি-র ন্যায় সিদ্ধান্ত থাকে, অন্য দিকে আছে বাজারে চাহিদার অভাব। লোকে যদি না-ই কিনে, তবে উৎপাদন বাড়াইবে কোন সংস্থা? চাহিদার কথা না বলিলে বেসরকারি লগ্নির ঔষধটি কার্যত অর্থহীন হইয়া পড়ে।
সুতরাং, তৃতীয় ফাঁক পথ্যে। বেসরকারি লগ্নির ঔষধটি তখনই ধরিবে, যখন বাজারে চাহিদা তৈরি হইবে। এবং, মুখ্য অর্থনৈতিক উপদেষ্টা যাহাই বলুন, বেসরকারি লগ্নি নিজের জোরে সেই চাহিদা তৈরি করিয়া লইতে পারিবে না। তাহার জন্য মানুষের হাতে ক্রয়ক্ষমতা প্রয়োজন। তাহার জন্য কর্মসংস্থান চাই, মজুরির প্রকৃত হার বাড়া চাই, কৃষিক্ষেত্রে উপার্জন চাই। সুব্রহ্মণ্যন জানাইয়াছেন, কর্মসংস্থান, কৃষি, রাষ্ট্রীয় ব্যয়— এমন আলাদা আলাদা খোপে ভাবিলে চলিবে না। সামগ্রিক ভাবনা, অর্থাৎ লগ্নিমুখিতাই পারে সব কয়টি সমস্যা একসঙ্গে সমাধান করিতে। কী ভাবে, তিনি ভাঙিয়া বলেন নাই। কিন্তু, বাজারে চাহিদা তৈরি না হইলে ব্যবসায় নূতন লগ্নি হইবে না, এবং নূতন লগ্নি না হইলে নূতন কর্মসংস্থান হইবে না, ফলে চাহিদা বাড়িবে না— এই দুষ্টচক্রকে ভাঙিতে পারে কেবলমাত্র রাষ্ট্রীয় ব্যয়। কৃষিক্ষেত্রে সংস্কারও বেসরকারি লগ্নির টানে হইবে না— তাহার জন্যও রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ প্রয়োজন। এই পথ্যগুলির কথা না বলিলে ঔষধের কার্যকারিতা থাকে কোথায়?
অর্থনৈতিক সমীক্ষা নামক নথিটির প্রধানতম গুরুত্ব, তাহা সরকারের ভবিষ্যৎ-ভাবনার ইঙ্গিত দেয়। বর্তমান সমীক্ষা যদি সেই ইঙ্গিত বহন করে, তবে বলিতে হয়, কেইনসীয় অর্থনীতিকে স্বচ্ছ গঙ্গায় বিসর্জন দিয়া নরেন্দ্র মোদীরা ফের নব্য-উদার অর্থনীতিকে প্রতিষ্ঠা করিতে চাহিতেছেন। সম্ভবত দ্বিতীয় বার জয় তাঁহাদের ‘ট্রিক্ল ডাউন’ অর্থনীতির কথা সরাসরি বলিবারও সাহস জোগাইয়াছে। অর্থনৈতিক সমীক্ষায় পূর্ব এশিয়ার ‘টাইগার ইকনমি’গুলির উল্লেখ আছে— তাহাদের বৃদ্ধির মডেলটিই যে এখন ভারতের আরাধ্য, সমীক্ষা এক প্রকার স্বীকার করিয়া লইল। প্রসঙ্গত, ভারত এত দিন সজ্ঞানেই সেই পথে হাঁটে নাই। সেই মডেলের সহিত গণতন্ত্রের অভাবের অঙ্গাঙ্গি সম্পর্ক ভারতের ক্ষেত্রে অশনিসঙ্কেত বহন করিতেছে কি না, আপাতত সেই প্রশ্ন তোলা থাকুক। কিন্তু, টাইগার ইকনমির পদাঙ্ক অনুসরণ করিতে চাহিলে সরকারকে অনেকখানি দায়িত্ব লইতে হয়। ব্যবসা করার সুবিধা বৃদ্ধি যেমন একটি দায়িত্ব, সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধিও। সেই দায়িত্বের কথা ভুলিয়া শুধুমাত্র বেসরকারি পুঁজির ভরসায় থাকিলে বিপদ। তাহা হইলে, ঔষধ কাজ করিবে না, কার্যত বিনা চিকিৎসায় রোগীর প্রাণ যাইবে।