জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়ার সামনে গুলিচালনা। —ফাইল চিত্র
মহাত্মা গাঁধীর প্রয়াণ দিবসে সিএএ-এনআরসির প্রতিবাদে দিল্লির জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ৭ নম্বর গেট থেকে দুপুর একটা নাগাদ শুরু হয় মিছিল। মিছিল শেষ হওয়ার কথা ছিল রাজঘাটে। মাত্র শ’খানেক মিটার মিছিল এগোতেই সারি দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা দিল্লি পুলিশের দিকে পিঠ করে, হাতে দেশি পিস্তল নিয়ে মিনিটখানেক ধরে সেই মিছিলকে শাসিয়ে গেল সাদা প্যান্ট আর কালো জ্যাকেটের এক গুন্ডা। গোটা সময়টা কার্যত ঠুঁটো হয়ে দাঁড়িয়ে রইল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের নিয়ন্ত্রণাধীন দিল্লি পুলিশ। ওই অবস্থাতেই মিছিল লক্ষ্য করে সে গুলি ছুড়ল। সেই গুলিতে বাঁ হাতে চোট পেলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর স্তরের পড়ুয়া শাদাব ফারুখ। অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে অভিযুক্তের পাশে দাঁড়াল হিন্দু মহাসভা। তাকে গাঁধীর হত্যাকারী নাথুরাম গডসের সঙ্গে তুলনা করে সংবর্ধনা দেওয়ার সিদ্ধান্তও নিল উগ্র হিন্দুত্ববাদী সংগঠনটি। এই ঘটনার মাত্র ৪৮ ঘণ্টার ব্যবধানে সিএএ-র প্রতিবাদ স্থলে আবারও শূন্যে গুলি চালাল বছর পঁচিশের কপিল গুজ্জর। জামিয়া মিলিয়ার পরে এ বার দিল্লির শাহিন বাগে। সেই রেশ না মেলাতেই গত ৫ ফেব্রুয়ারি শাহিন বাগেই বোরখা পরে ‘ভারত তেরে টুকরে হোঙ্গে’ মার্কা পাকিস্তানি স্লোগান দিতে গিয়ে গ্রেফতার হলেন আরএসএস নেত্রী গুঞ্জা কাপুর।
তিনটি ঘটনাতেই আশ্চর্যজনক মিল। সেই মিল সর্বধর্ম সমন্বয়ের যে দীর্ঘ ঐতিহ্য গড়ে উঠেছে আমাদের দেশে, তাকে যে ভাবেই হোক নষ্ট করে দেওয়া, বদলে একমাত্রিক একরৈখিক হিন্দুরাষ্ট্র গঠনের স্বপ্নে বিভোর হওয়া। এই বিদ্বেষের বীজ বপণ করা হয়েছে আজ থেকে প্রায় ১০০ বছর আগে। তাই যে হিন্দু মহাসভা কিংবা রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের সদস্যেরা সারা জীবন ভারতে ব্রিটিশ শাসনের শেষ দিন পর্যন্ত ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে নিশ্চুপ থেকেছেন, দেশের প্রত্যেকটি স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রতিটি অধ্যায়ের সরাসরি বিরোধিতা করে এসেছেন, আজ তাঁরাই সহসা দেশপ্রেমের ঠিকাদারি নিতে চাইছেন একচেটিয়া ভাবে!
১৯১৫ সালে হরিদ্বারের কুম্ভমেলায় পণ্ডিত মদনমোহন মালব্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ‘অখিল ভারতীয় হিন্দু মহাসভা’। গাঁধী হিন্দু-মুসলমানের ঐক্যবদ্ধ অসহযোগ-খিলাফত আন্দোলনের ডাক দিলেও অসহযোগের তীব্র বিরোধিতা করে কার্যত নিষ্ক্রিয় ছিল মালব্যের মহাসভা। চৌরিচৌরার হিংসার প্রেক্ষিতে গাঁধী আন্দোলন প্রত্যাহার করে নেওয়ার পরে ১৯২৩ সাল নাগাদ বিরাট হিন্দু পুনরুত্থান অভিযান শুরু করে তারা। সেই বছর অগস্ট মাসে মালব্যের সভাপতিত্বে বারাণসী অধিবেশনে মহাসভা ‘শুদ্ধি’ কর্মসূচি গ্রহণ করে, ডাক দেয় ‘হিন্দু আত্মরক্ষা বাহিনী’ গড়ে তোলার জন্যও। এর পাল্টা হিসাবে গড়ে ওঠে মুসলমানদের ‘তবলিগ’ (প্রচার) ও ‘তনজিম’ (সংগঠন)। ফলে যে অসহযোগ আন্দোলনকে কেন্দ্র করে দেশব্যাপী হিন্দু-মুসলমানের অভূতপূর্ব ঐক্য সম্মিলিত হয়েছিল, সেই একই আন্দোলনের প্রত্যাহারের পর থেকেই দেশ জুড়ে শুরু হয় অসংখ্য সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। সাইমন কমিশনের রিপোর্ট থেকে জানা যায় যে ১৯২২ থেকে ১৯২৭ সালের মধ্যে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে ১১২টি দাঙ্গায় প্রায় সাড়ে চারশো জন মারা যান, আহত হন প্রায় পাঁচ হাজার মানুষ।
অসহযোগ-খিলাফতের ব্যর্থতার পরে মুসলমান সমাজের আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে আনা এবং কংগ্রেসের সঙ্গে যোগসূত্র গড়ে তোলার জন্য ১৯২৪ সালের ৪ মে লাহোরে অনুষ্ঠিত মুসলিম লিগের সভাপতির অভিভাষণে জিন্না বলেন, “স্বরাজ অর্জনের এক অপরিহার্য শর্ত হল হিন্দু ও মুলমানদের মধ্যে রাজনৈতিক ঐক্য... আমি এই কথা বলতে চাই যে, যেদিন হিন্দু ও মুসলমান মিলিত হবে সেই দিনই ভারতবর্ষ ঔপনিবেশিক স্বায়ত্তশাসন পাবে।” অথচ, সেই সম্ভাবনাকে অঙ্কুরে বিনাশ করতে চেয়ে হিন্দু মহাসভার অন্যতম নেতা লালা লাজপত রাই ওই একই বছরের ১৪ ডিসেম্বর ‘দ্য ট্রিবিউন’ পত্রিকায় ঘোষণা করেন, “Under my scheme the Muslims will have four Muslim States: 1) The Pathan Province or the North-West Frontier 2) Western Punjab 3) Sindh and 4) Eastern Bengal. If there are compact Muslim communities in any other part of India, sufficiently large to form a province, they should be similarly constituted. But it should be distinctly understood that this is not a united India. It means a clear partition of India into a Muslim India and a non-Muslim India”।
লাজপত রাইয়ের এই ঘোষণার পরের বছরে অর্থাৎ ১৯২৫ সালে বিজয়া দশমীর দিন কেশব বলীরাম হেডগেওয়ারের নেতৃত্বে একটি গোষ্ঠী হিন্দু মহাসভা থেকে বেরিয়ে তৈরি করেন ‘রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ’ (আরএসএস) নামে এক নতুন সংগঠন। স্বাধীনতা আন্দোলন সম্পর্কে আরএসএস-এর দৃষ্টিভঙ্গি প্রসঙ্গে সরসঙ্ঘচালক গোলওয়ালকর বলেছিলেন, “ব্রিটিশ বিরোধিতাকে ভাবা হচ্ছে দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবাদের সমার্থক। এই প্রতিক্রিয়াশীল দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের সমগ্র স্বাধীনতা আন্দোলন, তার নেতৃবর্গ ও সাধারণ মানুষের উপর বিনাশকারী প্রভাব ফেলেছিল।” অর্থাৎ তাঁর মতে ব্রিটিশ বিরোধিতা হচ্ছে ‘প্রতিক্রিয়াশীল দৃষ্টিভঙ্গি’!
এহ বাহ্য! ১৯৪০ সালে জিন্নার লাহোর প্রস্তাবের ৩ বছর আগেই হিন্দু মহাসভার আমদাবাদ অধিবেশনে সভাপতির বক্তৃতায় বিনায়ক দামোদর সাভারকর বলেন, ‘ভারতবর্ষকে আজ আর একক ও সমপ্রকৃতির জাতি মনে করা যায় না। পক্ষান্তরে এ দেশে প্রধানত দু'টি জাতি— হিন্দু ও মুসলমান’। তিনি বলেন— “As it is, there are two antagonistic nations living side by side in India. Several infantile politicians commit the serious mistake in supposing that India is already welded thus for the mere wish to do so. … India cannot be assumed today to be Unitarian and homogeneous nation, but on the contrary there are two nations in the main: the Hindus and the Muslims, in India”।
১৯৩৮-এর ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত হিন্দু মহাসভার নাগপুর অধিবেশনে তিনি আবারও বলেন, “We Hindus are a Nation by ourselves ... Hindu nationalists should not at all be apologetic to being called Hindu communalists. The idea that there could be one homogeneous all-India nationhood was a mirage, the Hindu-Muslim schism was an unpleasant fact. It could not be wished away or overcome by compromise. The only way to treat it was to recognise that all India was Hindustan, the land of the Hindus, at once their father land and holy land।”
(চলবে)
ইংরেজির শিক্ষক