তোরা আমাকে এই কথাটা বললি? বলতে পারলি?”— অবিশ্বাসের সুরে স্যরের কথাটা এখনও যেন কানে বাজে! যিনি আমাদের ঘেরাও তথা ছাত্র-আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন, সেই সিনিয়র দাদা তখন বললেন, “আপনাকে বলিনি, আপনার পোস্টটাকে বলেছি।”
সত্তরের দশকের শেষ, আশির দশকের প্রথম দিক। নির্বাচনে বিপুল সমর্থনে প্রতিষ্ঠিত বাম সরকার। টালমাটাল সময়। বিনা বিচারে বন্দিদশা থেকে মুক্ত হয়ে বামপন্থীরা গণআন্দোলনে শামিল। সমাজের বিভিন্ন অংশের মানুষের দাবিদাওয়া নিয়ে আন্দোলনের রাজনীতি করা মার্ক্সবাদী নেতা-কর্মীদের— সে তিনি সরকার-সমর্থক হন বা সরকার-বিরোধী— অবশ্যপালনীয় পবিত্র কর্তব্য।
এই সামাজিক-রাজনৈতিক আবহে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে প্রিন্সিপাল ঘেরাও। স্লোগান দিতে দিতে ছাত্রছাত্রীরা প্রিন্সিপালের ঘরে হুড়মুড় করে ঢুকে দাবিদাওয়া পেশ করল— সঙ্গে অবিলম্বে সমাধানের দাবি। প্রিন্সিপাল মেডিক্যাল কলেজের প্রাক্তনী ফরেন্সিক সায়েন্সের বিশিষ্ট অধ্যাপক জে বি মুখোপাধ্যায় (ছবিতে)। দাবিদাওয়া যা-ই হোক, চাইলেই যে সঙ্গে সঙ্গে পাওয়া যায় না— সিদ্ধান্ত নিয়েও তা কার্যকর করতে সময় লাগে, সেটা বোঝার মতো বয়স আমাদের হয়নি, তা নয়। কিন্তু চটজলদি সমাধানের আকাঙ্ক্ষা হোক বা বুঝেও না-বোঝা বা ছাত্র-আন্দোলনের উত্তেজনা বজায় রাখার উত্তুঙ্গ চাহিদা, প্রিন্সিপালের ঘরে স্লোগান চলতেই থাকল। আন্দোলনের উত্তেজনার এক বেলাগাম মাদকতা আছে— কখন লক্ষ্মণরেখা পার হয়ে যায়, খেয়াল থাকে না। উগ্র উত্তেজনাতে স্লোগান উঠল: “কিক আউট, কিক আউট, কিক আউট দ্য প্রিন্সিপাল।” তখনই নিজের কানে শুনে যেন বিশ্বাস হচ্ছে না এমন মলিন স্বরে বললেন ডাক্তার মুখোপাধ্যায়— “তোরা আমাকে এই কথাটা বললি? বলতে পারলি?”
প্রিন্সিপালের ঘরে তাঁকে ঘিরে মেডিক্যাল কলেজের ছাত্রছাত্রী সংখ্যায় তখন ত্রিশ জন বা আরও বেশি। ব্যক্তি নয়, তার পদটাকে লাথি মেরে বাইরে ফেলে দেওয়ার যুক্তিতে আস্থা রেখে আমরা অনেকেই সে দিনের সেই স্লোগানে গলা মিলিয়েছিলাম। তীব্র গ্লানি এবং অপরাধবোধ তখনই আসেনি, এসেছিল পরে— যখন পদ এবং পদাসীন ব্যক্তির একটা পার্থক্য বানিয়ে সেই পদাসীন বিশিষ্ট শিক্ষককে ঘেরাও করে লাগাতার হেনস্থা অপমান করে মানসিক নির্যাতন করার রাজনৈতিক অপযুক্তি বিবেকবুদ্ধির কাছে হার মানে। ধন্দটা কিন্তু সে দিনই হয়েছিল। প্রিন্সিপালের পোস্টটাকে পদাঘাতে বাইরে ফেলে দেওয়ার ডাকও কি নৈরাজ্যের আহ্বান নয়? কলেজে প্রিন্সিপাল না থাকলে প্রশাসনিক সার্বিক দায়িত্বভার কে বহন করবেন? এই স্লোগান কি যুক্তিসম্মত বাস্তব? বাস্তব যদিও বা হয়, তা কি ন্যায়নীতিসম্মত? মানবিক?
কলেজে ছাত্রছাত্রীদের পঠন-পাঠন-আবাসন-নিরাপত্তা ইত্যাদি সংক্রান্ত বিভিন্ন সমস্যা থাকে। এমনও হয় যে, কোনও প্রবল সমস্যায় ছাত্রছাত্রীরা সকলে পীড়িত, কিন্তু তার জন্য কলেজের প্রিন্সিপাল, ভাইস প্রিন্সিপাল তথা সুপার বা ডিনকে দায়ী করা যায় না। একটা উদাহরণ দিই। ১৯৭৮ সালে সারা দেশে প্রথম বারো ক্লাসের উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার পর প্রথম সাড়ে চার বছরের এমবিবিএস কোর্সে বায়োকেমিস্ট্রি চালু হয়। অথচ কলেজে বায়োকেমিস্ট্রি পড়ানোর কোনও শিক্ষক নেই। থাকবেই বা কী করে? বায়োকেমিস্ট্রি তো এই প্রথম চালু হল! পড়ানোর জন্য যিনি এলেন, তিনি অর্গানিক কেমিস্ট্রির। মনে রাখা প্রয়োজন, সেই বছর প্রবল বন্যায় সারা রাজ্যে এমনই দুরবস্থা যে, কলেজে ক্লাসই শুরু হতে পারেনি।
প্রিন্সিপাল সম্পর্কে আমাদের ধারণা ও প্রত্যাশা এমনই যে তিনি প্রশাসনের শীর্ষস্তরে শুধু একটা ফোন করবেন আর বহুবিধ জটিল সমস্যার তুরন্ত সমাধান হয়ে যাবে— সে সমস্যা শিক্ষক না থাকা হোক বা হস্টেলে ছাত্রছাত্রীদের স্থানাভাব, মেয়েদের হস্টেলে পুরুষ-চোরের প্রবেশ অথবা ব্লাড ব্যাঙ্কে চুরি কিংবা বৌবাজারে মদের দোকানের সামনে খুন। কী দাবি নিয়ে সে দিন প্রিন্সিপালকে ঘেরাও করা হয়েছিল, আজ আর মনে নেই। খুব যুগান্তকারী স্মরণীয় কিছু নয়, হলে মনে থাকত। শুধু মনে আছে, এক জন সম্মাননীয় শিক্ষক যেন বিশ্বাস করতে পারছেন না তাঁর সন্তানসম ছাত্রছাত্রীরা তাঁকে চরম হেনস্থা, কটূক্তি, অপমান ও নির্যাতন করে মর্মান্তিক যন্ত্রণা দিচ্ছে! কাজটা যে চরম অমানবিক, অন্যায় ও অপরাধ, তার বোধোদয় ছাত্রজীবনেই হয়েছিল, কিন্তু তার জন্য ক্ষমাপ্রার্থনা দূরের কথা, তা স্বীকার করাও হয়নি। অপরাধ-অন্যায় করেও স্বীকার না-করার এক সামাজিক পরম্পরা তৈরি হয়েছে। আন্দোলনে দাবিদাওয়ার যুগে যুগে পরিবর্তন হয়, কিন্তু নির্যাতনের ট্র্যাডিশন চলতে থাকে।
স্যর অন্য মেডিক্যাল কলেজে বদলি হয়ে যান, পরে অবসরগ্রহণ করেন, অনেক কাল হল মারা গিয়েছেন। এখন বুঝি, কলেজের ছাত্রছাত্রীদের ভালবাসতেন। বেঁচে থাকলে শিক্ষক দিবসে কাছে গিয়ে প্রণাম করে বলতাম, “স্যর, ক্ষমা চাইছি।”