ট্র্যাডিশন: ২০১৮ সালের ১০ জুলাই যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সুরঞ্জন দাসকে ঘেরাও করে বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন ছাত্রছাত্রীরা
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্প্রতিক গোলযোগের ঘটনা এবং অগ্রজপ্রতিম সুরঞ্জন দাস ও শিক্ষক-বন্ধুদের উপর ছাত্র-সঙ্গীদের অত্যাচারের ঘটনায় অনেক বারের মতো এ বারও মনটা খারাপ হল। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিতরের সমস্যাগুলোর প্রকৃতি তেমন পাল্টায় না— ফেল করলে পাশ করিয়ে দেওয়ার দাবি; অমানবিক ভাবে শিক্ষকদের আটকে রাখা, তাঁদের অসুস্থতায় পরোক্ষ ভাবে উল্লসিত হওয়া; আক্রমণাত্মক ছোট একটি গোষ্ঠীর বার বার বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মকানুনকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখানো; ঝঞ্ঝাটভীরু বিশাল অংশের নির্বাক পড়ুয়াদের ক্ষতিসাধন; কম বয়সেই সংগঠিত গণতান্ত্রিক ব্ল্যাকমেলে হাতেখড়ি— এ সবই এখন নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা।
এগুলো নিয়ে কান্নাকাটি বা উষ্মার মধ্যেও একটা সামাজিক ভণ্ডামি লুকিয়ে থাকে। রাজনৈতিক ভাবে সঠিক থাকা, সমাজ ও শাসনের প্রতিটি পরিসরে ‘জনপ্রিয়’ হয়ে থাকার লালসা, গণতান্ত্রিক অপরাধ, বহুমতের তোষণ, সব কিছুকেই সব জায়গায় ব্যবহার করতে গিয়ে, এবং পাতলা রবারের জুতোর মতো এই সব ধ্যানধারণাকে যত দূর সম্ভব ঢাকতে গিয়ে ছিঁড়ে গেলে আত্মহত্যা করা— এ সবই ফাটা রেকর্ডের মতো বেজে চলেছে বহু দিন। ঘেরাও করা বেআইনি, অমানবিক, দণ্ডনীয় অপরাধ— এ সব বার বার বলেছি, লিখেছি, আর এই বিশ্ববিদ্যালয়েরই মাস্টারমশাইরা আমাকে গালমন্দ করেছেন, লিখিত ভাবেই করেছেন। বর্তমানের অধিকাংশ ছাত্র-আন্দোলন আসলে সুযোগসন্ধানীদের জনগণতান্ত্রিক ব্ল্যাকমেল, আর শিক্ষকদের রাজনৈতিক অন্তর্দ্বন্দ্বপ্রসূত ইন্ধনের চালচিত্র— আমি আমৃত্যু এটাই বিশ্বাস করে যাব। কিন্তু আমার মনে হয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে আমাদের দৈনন্দিন ঘর-গেরস্থালির চত্বরে প্রাত্যহিক জীবনের মধ্যে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের নিয়মভাঙা ব্ল্যাকমেলের বীজ লুকিয়ে আছে। আর তাকে মদত দেয় রাজনৈতিক সচেতনতার নামে গণতান্ত্রিক তোষণ। আমি পর পর কতকগুলো কথা বলব। আমার বিশ্বাস, এ সবই আমরা প্রতিনিয়ত দেখি এবং এড়িয়ে যাই, আর ছোটবেলা থেকে বড়বেলার হাত ধরে শিশুদের অপরাধী করে তোলে আমাদের কাপুরুষতা।
অনেক দিন ধরেই আমরা দেখে চলেছি বাচ্চা ছেলেমেয়েরা বাড়িতে যা চায়, বাবা-মা তাদের সব কিছু দেওয়ার জন্য এখন অতিরিক্ত চেষ্টা করেন, যা আমাদের বাবা-মায়েরা সচ্ছল থাকলেও করতেন না। একটি নামী-দামি স্কুলে দু’টি ছেলে পড়ে। এক জনের বাবা-মা বড়লোক, কিন্তু ছেলেকে সময় দিতে পারেন না। ছেলেটির মন ভাল করতে নতুন নতুন জিনিস কিনে ঘর ভরিয়ে দেন। তার সহপাঠী তার বাবা-মায়ের কাছে বায়না করে, তারও ওই সব চাই। বাবা-মা অন্যদের কাছে দুঃখ করে বলেন, বাধ্য হয়ে তাঁরা কিনে দেন— কারণ তাঁরা ভয় পান যে, আজকাল ছেলেমেয়েরা যা চাইছে, তা না পেলে অনেকে আত্মহত্যা করার চেষ্টা করে। আমি শৈশবে স্কুলে যাওয়ার সময় এক টাকা, কলেজে দু’টাকা আর বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঁচ টাকা পেতাম, হাতখরচ। ‘তখনকার এক টাকা এখন অনেক টাকা’— এ যুক্তি আমাকে দেওয়া ঠিক হবে না, কারণ ওই বিষয়টি চর্চা করেই আমার পেট চলে। এর বেশি চাইলে আমার বাড়িতে থাকা হত না। চাইলেই পাব, এমনটা হত না। এই ‘চাইলেই পাব’র জীবনদর্শনটা কিন্তু ভয়ানক। বিশেষ করে, কী ভাবে ব্ল্যাকমেল করলে পাওয়া যাবে, সেই শিক্ষার আঁতুড়ঘর হল আজকের সমাজ। ব্ল্যাকমেল করাটা এখন একটা হাতিয়ার হয়ে দাঁড়িয়েছে, বড় রকমের হাতিয়ার। ভবিষ্যৎ জীবনে আক্রমণাত্মক আচরণ, এবং অভিভাবকসম শিক্ষকদের উপরে শারীরিক ও মানসিক অত্যাচারের অমানবিক জীবনদর্শনকে নৈতিকতার নামান্তর হিসেবে চিহ্নিত করা ঠান্ডা মাথার অপরাধের লক্ষণ।
এর পর, ভেবে দেখেছি কি, কেন বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ঘেরাও হয় না? সেখানে কি কোনও অন্যায় নেই, বা লেখাপড়াই হয় না? না কি, সেখানকার কর্তৃপক্ষ, ছাত্রছাত্রী-শিক্ষক, সবাই ভিন্গ্রহ থেকে নেমে এসেছেন? তা তো নয়। আসলে ন্যায্য-অন্যায্য, যে কোনও গন্ডগোলে জড়িয়ে পড়লেই যে সংশ্লিষ্ট ছাত্রছাত্রীদের আর সেখানে পড়তে দেওয়া হবে না, এটা তাঁরা জানেন। অবশ্যই ব্যাপারটি বাঞ্ছনীয় নয়, কিন্তু দোষ প্রমাণিত হলে শাস্তি দেওয়া যাবে না— এটা সরকারি প্রতিষ্ঠানে হতে পারে। কারণ, গণতন্ত্র, সমাজকল্যাণ, সাম্য, সব কিছুর ঘোষিত আদর্শ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কার্যকর করার মহান দায়িত্ব আমরা নিয়েছি। তাই, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে বছরে ১০০টি ক্লাস হলে সরকারি প্রতিষ্ঠানে ২৫টিও হতে পারে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরতে পরতে সকাল-সন্ধ্যা হরেক বেনিয়ম আর অনৈতিকতার গন্ধ বেরোলে তাকেই সৃষ্টিশীলতার চরম নিদর্শন বলে ধরে নেওয়া হয়। কারণটা ঠিক বুঝতে পারি না। কিন্তু সেই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকেরাই বেসামাল হওয়াটাকে অসম্মান করেন না, এমনটাও দেখেছি। আর এ সব বিষয়ে কোনও প্রশ্ন নয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বড়কর্তা একটু উসখুস করলে জোট বেঁধে ছাত্রছাত্রীরা তাঁকে বলেন, “স্যর, আপনি কিন্তু কিছুই দেখেননি।” বড়কর্তা আর একটু বেয়াদবি করলে গণসঙ্গীত গেয়ে তাঁকে বরখাস্ত করা হয়।
দলমতনির্বিশেষে সরকার বাহাদুর এ সব সমর্থন করেন, কারণ সংগঠিত নৈরাজ্যকে তাঁরা ভয় পান। আজ পর্যন্ত ছাত্রছাত্রীদের বিরুদ্ধে কোনও ধরনের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা করতে পারেন না, ‘আহা বাছা’ করে এড়িয়ে যান, অথচ কাগজপত্রে সরকারি স্তরে ব্যবস্থা যে নেই, তা নয়। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে সংবাদমাধ্যমের সামনে দাঁড়িয়ে ‘সবাই আমার আপন’, এমন ধরনের মুচলেকা দিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তির পদ অলঙ্কৃত করতে হয় না। আমরা সবাই সোশ্যাল মিডিয়ায় ‘লাইক’ খুঁজে বেড়াচ্ছি।
পকেটের অনেক পয়সা খরচ করে পড়াশোনা করলে সেখানে নৈরাজ্য কম হয়। তখন একটা দিন ক্লাস না হলে, কিংবা ডিগ্রি-ডিপ্লোমা না পেলে, বা শাস্তিমূলক ব্যবস্থার মুখোমুখি হ লে দুশ্চিন্তা বেশি হয়। ফেল করলে পাশ করিয়ে দেওয়ার দাবিতে ব্ল্যাকমেল করা, সেখানে টাকার মূল্যে অনেকখানি। হাজার হাজার টাকা খরচ করে দামি স্কুলের মাইনে দিতে, টিউশন ফি দিতে গায়ে লাগে না, কিন্তু সরকারি প্রতিষ্ঠানে দু’পয়সা দিয়ে শিক্ষা নিয়ে একটা সচ্ছল জীবনে উপনীত হওয়ার আগে কিছু দিন বিক্ষোভের নামে যখন তখন নৈরাজ্য সৃষ্টি করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শান্তি নষ্ট করার মতো, আর্থিক ভাবে এবং পড়াশোনায় দুর্বল ছাত্রছাত্রীদের ক্ষতি করার মতো ন্যক্কারজনক বিনোদন উপভোগ করতে কিছু বিপ্লবীর গায়ে লাগে না।
দরিদ্র ছাত্রছাত্রীদের কাছ থেকে একটি পয়সা না নিয়ে সম্পন্ন ও সচ্ছল ছাত্রছাত্রীদের বাজারদরসম মাইনে ও খরচ দিতে বাধ্য করা কল্যাণমূলক অর্থনীতির প্রথম শ্রেণির পাঠ্য একটি নীতি। এটা করলে বিপ্লব, প্রতিবাদ, বিক্ষোভের নামে ভণ্ডামিও কমে যাবে। সমাজবিজ্ঞানীরা গবেষণা করে দেখতে পারেন, ক’জন নুন-আনতে-পান্তা-ফুরোয় বাড়ির ছেলেমেয়ে প্রতিবাদে শামিল হচ্ছেন, এবং যাঁরা উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মাতব্বরি করেন, তাঁরা সমাজের কোন আর্থিক স্তরের মানুষ।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছেলেমেয়েদের নৈরাজ্য সহ্য করে ঘরের ভিতর মুখ লুকিয়ে বসে থাকলে শিক্ষকেরা অপমানিত, লাঞ্ছিত হতেই থাকবেন। মেরুদণ্ড ক্রমশ মাটিতে মিশে যাচ্ছে, অথচ আমাদের কোনও হুঁশ নেই। শিক্ষকদের গায়ে হাত পড়লে পুলিশ এগিয়ে আসে না, এটাই সত্যি। দূরে দাঁড়িয়ে মজা দেখতে তাদের বাধ্য করা হয়, এটাই আমাদের ট্র্যাডিশন।
মাস্টারমশাইরা আত্মরক্ষা করতে চাইলে সেটা হল শোষণের শামিল। আর ছাত্রছাত্রীরা তাঁদের চপেটাঘাত করলে— সেটা বিপ্লব।
প্রাক্তন উপাচার্য, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়