সুশান্ত ও রিয়া। — ফাইল চিত্র
সকল মানুষই মরণশীল; কমলাকান্ত মানুষ, অতএব কমলাকান্ত মরণশীল। অবরোহী যুক্তিবিদ্যার এই উদাহরণটি একুশ শতকে হাস্যকর ও দুর্ভাগ্যজনক ভাবে উল্টাইয়া ব্যবহার হইতেছে। সুশান্ত সিংহ রাজপুতের মৃত্যুর ঘটনায় তাঁহার বান্ধবী রিয়ার বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠিয়াছে। তাহার তদন্তও হইতেছে। কিন্তু ইহার সমান্তরালেই ঘটিয়া গেল আশ্চর্য ঘটনা— অভিযুক্ত ঘটনাচক্রে বাঙালি বলিয়া সকল বাঙালি নারীর বিরুদ্ধে কদর্য অঙ্গুলি উঠিল। তর্জনের সারাৎসার, মন্দ মেয়ে রিয়া সুশান্তের উপর তুকতাক করিয়াছেন; রিয়া বাঙালি, সুতরাং সকল বাঙালিনিই মন্দ ও পুরুষদের তন্ত্রেমন্ত্রে বশ করিয়া থাকেন। কেহ বলিলেন, বাঙালি মেয়ে মাত্রেই ডাকিনী বা সর্পিণী, ফাঁদে ফেলিয়া কার্যোদ্ধারই তাঁহাদের মতলব।
অভিযুক্তের সূত্রে তাঁহার গোটা জাতি-গোষ্ঠীকে কাঠগড়ায় টানিয়া আনা কেবল কাণ্ডজ্ঞানহীনতাই নহে, চরম মূর্খতারও অভিজ্ঞান। কিন্তু তলাইয়া দেখিলে বুঝা যাইবে, এই অন্যায় বিচারসভা আহ্বানের মূলে রহিয়াছে বৃহত্তর ভারতীয় সমাজের একাংশের নারীবিদ্বেষ তথা বাঙালি-বিদ্বেষ। যে নাগরিকেরা সকল বাঙালি নারী বর্জনের, এমনকি গণ-গ্রেফতারেরও দাবি তুলিলেন— বিশ্বাস করিতে কষ্ট হইলেও সত্য— তাঁহারা আসলে নারীকে এখনও সম্পত্তি বা পণ্য হিসাবে দেখেন, এবং জাতি হিসাবে বাঙালি নারী-স্বাধীনতায় তাঁহাদের তুলনায় অধিক বিশ্বাস করে বলিয়া, বাঙালি নারী জীবনের সর্বক্ষেত্রে ভাস্বর হইতেছে েদখিয়া গাত্রদাহ ও মর্মপীড়ায় ভুগেন। প্রশাসন হইতে বিজ্ঞান, বিনোদন হইতে ব্যবসা, সাহিত্যক্ষেত্র হইতে শিল্পের অঙ্গনে বাঙালি নারীর অবাধ বিচরণ ও কীর্তিস্থাপন তাঁহাদের চোখে পড়ে না। তবে কিনা, দেখিয়াও না দেখিবার, সজ্ঞানে সরাইয়া রাখিবার এই আচরণ রাজনীতি-প্রভাবিতও বটে। আজিকার ভারতের হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি নারীকে প্রকাশ্যে দেবী ও অন্তরে দাসী হিসাবে দেখিতে চাহে, মানবী নহে। দেবী পূজা পাইলে তৃপ্ত, দাসীর তৃপ্তির কথা ভাবিবার দায় মালিকের নাই— কিন্তু মানবীকে লইয়া মুশকিল, তাহার নিজস্ব মতামত আছে। সেই কারণেই শিক্ষা ও সমসময়ের মূল্যবোধ সহায়ে বাঙালি বা অন্য যে কোনও নারীরই অগ্রযাত্রা তাহার সহে না। অপ্রতিরোধ্য কাহাকেও রুখিতে গেলে ব্যক্তিগত ও জাতিগত কলঙ্কলেপনের জুড়ি নাই। সেই জন্যই ‘নারীকে নিয়ন্ত্রণ করিতে পারে না’ বলিয়া বাঙালি পুরুষকে বিদ্রুপ, বা টিভি ও চলচ্চিত্রে বাঙালি নারীর রহস্যময়ী বা পরাবাস্তবানুগ চরিত্রায়ণ দেখিয়া অশিক্ষিত নিদান— সকল বাঙালি নারীই ডাকিনী।
বাঙালি নারী এই জাতি ও লিঙ্গ-পরিচয়ভিত্তিক বিদ্বেষের প্রতিবাদ করিয়াছেন। আগাইয়া আসিয়াছেন পুরুষরা, অবাঙালি অন্য নাগরিকও। ভোজনরত স্ত্রীর পাশে বসিয়া পাখার বাতাস করিতেছেন স্বামী, সত্যজিৎ রায়ের চলচ্চিত্রের বিখ্যাত দৃশ্য সমাজমাধ্যমে তুলিয়া কেহ লিখিয়াছেন, স্ত্রীটি কেমন জাদুটোনা করিয়াছে! ইহা নিশ্চিত ভাবেই শ্লেষোক্তি, কিন্তু অন্তরালে রহিয়াছে বহিরঙ্গে আধুনিক সমাজের প্রতি উদ্দিষ্ট এক অভিমান। তবে অভিমানিনী হইয়া বসিয়া থাকিলে বাঙালি নারীর চলিবে না। প্রতিবাদ নিশ্চয়ই কাম্য, কিন্তু সবার উপরে প্রয়োজন শুভ কর্মপথে আগাইয়া যাওয়া। এত দিন যাহা করিয়া আসিতেছিলেন, পূর্ণ বিশ্বাস ও সক্রিয়তায় তাহার সাধন। তাহাই যথেষ্ট।