মানিয়ে নিতেই হবে? কেন?

মুম্বইয়ের সংস্থার আগেই ভারতে নজির রেখেছে বিহার। ১৯৯২ থেকে সরকারি দফতরের সব স্তরের নারীকর্মীদের জন্য এই ছুটি বরাদ্দ হয়। সফল ভাবে সেই রেওয়াজ চলছেও।

Advertisement

সোহিনী মজুমদার

শেষ আপডেট: ০৩ অগস্ট ২০১৭ ০৬:০০
Share:

কোনও আগে থেকেই তৈরি করা খোপে মেয়েদের খাপ খাওয়ানোর সমানাধিকারের কথা নারীবাদ বলে না। বরং ‘মেয়ে’ নামক সামাজিক-শারীরিক সত্তাটিকে খাপ খাওয়ানোর মতো করে খোপটিকে কিঞ্চিৎ পুনর্গঠিত হতে বলে সে। এখানেই ‘ইকুয়ালিটি’র সঙ্গে ‘একুইটি’র তফাত। যে একুইটির প্রয়োজন আমাদের সমাজের রূপান্তরকামী, তৃতীয়, চতুর্থ লিঙ্গের মানুষের জন্যও। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে যখন মেয়েরা বিপুল পরিমাণে খনিতে, কারখানায় যোগ দিতে লাগল, জাপানের কর্মক্ষেত্রে সেই সময়ে মেয়েদের প্রয়োজনীয় স্যানিটেশনের ব্যবস্থা ছিল না। তাই ১৯৪৭ সাল থেকে ‘লেবর স্ট্যান্ডার্ড ল’ অনুযায়ী সে দেশে মেয়েদের মাসিক চলাকালীন সবেতন ছুটি বরাদ্দ করা হয়। গবেষক অ্যালিস জে ড্যান বলছেন, “এই পদক্ষেপ নারীমুক্তির প্রতীক। নিজেদের শরীর নিয়ে খোলাখুলি কথা বলতে এবং শ্রমিক হিসেবে মেয়েদের সামাজিক স্বীকৃতি দিতে এই উদ্যোগ প্রতিনিধিত্ব করেছিল”। দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান, চিনের তিনটি প্রদেশ, ইন্দোনেশিয়াতেও মেয়েদের ঋতুকালীন এক থেকে তিন দিন করে ছুটি বরাদ্দ। স্পোর্টস ব্র্যান্ড নাইকি ২০০৭ সাল থেকে সমস্ত দেশে তার মহিলা কর্মীদের মাসিক ছুটি দিয়ে থাকে। ব্রিটেনের অলাভজনক সংস্থা কোএগজিস্ট, নেপালের অনলাইন শপিং সংস্থা সাস্তো ডিলও গত বছর দুয়েকের মধ্যে এই ছুটি কার্যকর করেছে।

Advertisement

মুম্বইয়ের সংস্থার আগেই ভারতে নজির রেখেছে বিহার। ১৯৯২ থেকে সরকারি দফতরের সব স্তরের নারীকর্মীদের জন্য এই ছুটি বরাদ্দ হয়। সফল ভাবে সেই রেওয়াজ চলছেও। যদিও ইন্দোনেশিয়াতে অভিযোগ উঠেছিল, জোর করে জামা খুলিয়ে ‘বিশেষ দিন’-এর প্রমাণ দেওয়ার, উঠতে বসতে চলা সেক্সিস্ট মন্তব্যের। এই মানসিকতা বদলানোর জন্যই শরীরের প্রয়োজন নিয়ে আরও বেশি করে খোলামেলা কথা হওয়া জরুরি। জাপানেও কমেছে ছুটি নেওয়ার মাত্রা। তার একটা কারণ, বাজার অর্থনীতির ইঁদুরদৌড়ে কারও এক পা দম নেওয়ার জো নেই। কিন্তু সমাজকে, বাজারকে স্বীকার করতে হবে, শরীরের এই বিশেষ প্রক্রিয়াটির জন্য কারও যদি একটি বা দুটি দিন বিরতির প্রয়োজন হয়, সেটা ‘অসুস্থতা’র ছুটি নয়, তাই এটা মহিলা কর্মী নিয়োগে অনীহার কারণ হতে পারে না। বরং মেয়েদের বিশেষ জৈবিক চাহিদা অনুযায়ী নতুন ধাঁচে কর্মপরিসরকে সাজানোর কথা ভাবতে হবে। স্যানিটারি ন্যাপকিনের বিজ্ঞাপনে দাগ লুকিয়ে রাখার মাহাত্ম্য দেখাতে গিয়ে কিশোরী বা তরুণীটি অবলীলায় ফুটবল খেলে বা পাহাড়ে চড়ে। তলপেটে খিঁচুনি, কোমরে ব্যথা, অস্বস্তি বা মাথার যন্ত্রণাও যেন ঠিক স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহার করলেই গায়েব! ‘ব্যথাহীন ওই পাঁচটা দিন’ই আমাদের কাছে মান্য হয়ে ওঠে। আমরা ভুলে যাই ব্যথাটার অস্তিত্বও রক্তের দাগের মতোই সত্যি, স্বাভাবিক।

এখন, ওই ক’দিনে মা-মাসিরা যুগ যুগ ধরে ঘরের কাজ করে এসেছেন বলে, বা আমরা অনেকেই দিব্যি অফিস, কারখানা করতে পারি বলে, প্রত্যন্ত গ্রামে-পাহাড়ে মেয়েরা কাপড় দিয়ে স্যানিটারি ন্যাপকিনের অভাব পুষিয়েও কত শ্রমসাধ্য কাজ করে যাচ্ছেন বলে এই বিশেষ সময়ে তাঁদের বিশেষ বিশ্রামের প্রয়োজন হয় না বা হয়নি কখনও, এ কথা হলফ করে কেউ বলতে পারবেন না। হ্যাঁ, এই পিতৃতান্ত্রিক সমাজে সেই ব্যথাকে স্বীকার করে নিয়ে বিশ্রাম চেয়ে নেওয়ার মতো সুযোগ বা পরিস্থিতি হয়তো আসেনি। যেমন এক পরিচারিকার বয়ান সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়েছে: “আমাদের মাসিক হলে কলকাতা বন্ধ হয়ে যাবে, হাজার বৌদি সকালের চা না পেয়ে মেজাজ খিঁচড়ে ছেলে পেটাবে, বাড়িতে আলুসিদ্ধ ভাত খেয়ে দিন কাটাবে, এঁটো বাসন থেকে গন্ধ ছড়াবে আর তাই আমাদের ‘মাসিক’ হয় না।”

Advertisement

মানসিকতায় বদল চাই। নারীবাদী গ্লোরিয়া স্টাইনেম ‘ইফ মেন কুড মেনস্ট্রুয়েট’ প্রবন্ধে বলেছেন, যদি ছেলেদেরও মাসিক হত তা হলে সমাজ একে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে দেখার জন্য মুখিয়ে থাকত। অবস্টেট্রিক্স এবং গাইনিকোলজির বিশেষজ্ঞ গেডিস গ্রুজিন্সকাস মনে করেন, প্রিমেন্সট্রুয়াল সিন্ড্রোমে অধিকাংশ মেয়েরা শারীরিক ও মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত থাকে, ওই সময়ে এক থেকে তিন দিন রোজকার কাজ থেকে ছুটি মেয়েদের কাজে উৎসাহ এবং উৎপাদনক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করবে।

সব মেয়ের যে ওই সময় সমান অসুবিধা হয়, বা আদৌ হয়, তা নয়। দ্য কনভার্সেশন ওয়েব পত্রিকায় (২০১৬) অস্ট্রেলিয়া সংস্করণে প্রকাশিত একটি রিপোর্টের ফল অনুযায়ী, নিউজিল্যান্ডের ৫০%, ৮৪% ইতালীয় মহিলা, ৯০% শতাংশ ইরানি মহিলা নানা মাত্রার ডিসমেনোরিয়ায় ভোগেন। তাই ছুটিটা সবার জন্য বাধ্যতামূলক করার দরকার নেই। কিন্তু কিছু মেয়ের সমস্যা হয় না বলে বা তাঁরা মানিয়ে নিতে পারছেন বলে বাকিদের সমস্যাকে স্বীকৃতি না দেওয়াটাও যুক্তির কথা নয়। সমস্যাটার মাত্রাও সকলের সমান নয়, সব মাসের জন্য বিশেষ ভাবে নির্ধারণও সম্ভব নয়, তাই কার্যত সমস্ত মেয়ের কথা ধরেই এই ছুটির বরাদ্দ রাখা উচিত। এতে কারও কর্মক্ষমতাকে ছোট করার প্রশ্নই ওঠে না। উঠলে, সেটা পুরুষতান্ত্রিক চিন্তার ফসল।

(শেষ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement