বর্তমান সমাজ ও রাজনীতিকে সোশ্যাল মিডিয়া বস্তুটি কতখানি পাল্টাইয়া দিয়াছে, তাহার আরও একটি দৃষ্টান্ত এই বারের যাদবপুর ঘটনা। যুযুধান দুই পক্ষ একনাগাড়ে পরস্পরের মোকাবিলা করিয়া চলিতেছে, বিরতিহীন ভাবে। মোকাবিলা সামনাসামনি তত নহে, যতখানি নেট-দুনিয়ায়। গত বৃহস্পতিবার হইতে এই নেট-সংঘর্ষ এক মুহূর্ত বন্ধ থাকে নাই। লাগাতার কুৎসা ছড়াইবার, নিগ্রহ চালাইবার, প্রহার বা ধর্ষণ বা অ্যাসিড আক্রমণের হুমকি ছড়াইয়া যাইবার, ছবি বিকৃত করিয়া তথ্য আরও রংদার করিবার এমন সহজ পন্থা হাতের কাছে পাইয়া তাহার সম্পূর্ণ সদ্ব্যবহার করিতে ব্যস্তসমস্ত রহিয়াছে রাজনৈতিক দুষ্কৃতী বাহিনী। বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক বিভাগের আতঙ্কগ্রস্ত ছাত্রছাত্রী পুলিশের নিরাপত্তা দাবি করিয়াছেন, এতটাই তীব্র রূপ লইয়াছে তাঁহাদের উপর আক্রমণের হুমকি। সমগ্র দেশেই এখন এই নেট-অপরাধের প্রবল প্লাবন। সামান্য থেকে অসামান্য, যে কোনও ঘটনাতেই ভয়ঙ্কর আতঙ্ক ছড়াইয়া দেওয়া যায় অতি দ্রুততার সহিত। বিশেষত মহিলাদের ক্ষেত্রে আতঙ্কের পরিমাণটি সহজেই অনুমেয়। যে দেশে নারীনিগ্রহের অপরাধের সংখ্যা প্রতি দিন বিস্ময় উদ্রেক করে, সেখানে সমাজমাধ্যমে এমন আতঙ্ক ছড়ানো হইলে সাধারণ মানুষের কী অবস্থা হয়, বুঝিতে কষ্ট হয় না।
অবশ্য সমাজমাধ্যম-যুগের আগে হইতেই এ রাজ্যের রাজনৈতিক সমাজে কুকথা-কদাচারের দৃষ্টান্ত বহমান। নিকট ও দূর অতীতে অসামান্য সব নিদর্শন দেখাইয়া গিয়াছেন, ও যাইতেছেন, বিনয় কোঙার, অনুব্রত মণ্ডল ও দিলীপ ঘোষরা। তবুও স্পষ্টত, ‘নেট’মঞ্চের দৌলতে এখন কুকথার নীচতা ও কদাচারের পরিমাণ প্রত্যহ নূতন রেকর্ড তৈরি করিতেছে। কাজ সহজ হইয়াছে। এখন আর রাস্তায় নামিয়া গা ঘামাইয়া সংঘাত করিতে হয় না, বাড়িতে বসিয়া অবসরমতো বাছা-বাছা শব্দাস্ত্র প্রয়োগে অপরকে ঘায়েল করা চলে। দ্বিতীয়ত, সামনাসামনি কুকথা বলিলে তাহা বক্তা-শ্রোতাসমেত মাত্র কয়েক জনের মধ্যে আবদ্ধ থাকে, কিন্তু নেট-এর মাধ্যমে সহজে অসংখ্য মানুষের মধ্যে হিংসা ছড়ানো যায়। তৃতীয়ত, প্রত্যক্ষ সংঘর্ষের তুলনায় অনেক সহজে অপরের ব্যক্তিগত নিভৃত পরিসরে ঢুকিয়া পড়া যায়। যে ছেলেটির মা-কে ভয় দেখাইয়া ক্ষমা চাওয়াইবার ছবি সমাজমাধ্যমে ছড়াইয়া পড়িয়াছে, সে কাজ নেট-প্রযুক্তি ছাড়া এত সহজ হইত কি না বলা কঠিন। অর্থাৎ, সাধারণ বোধের বিপরীত ঘটনাটিই ঘটিতেছে— প্রত্যক্ষের তুলনায় সমাজমাধ্যমের পরোক্ষ মঞ্চে ব্যক্তিপরিসর অনেক বেশি ধ্বস্ত ও আক্রান্ত হইতেছে।
যাদবপুর-কাণ্ডের পর আপাতত এই সব রকম হিংসাই চলিতেছে অবিরাম। অকুতোভয়ে।
অকুতোভয়ে, কেননা বোঝা যাইতেছে, নেট-নিগ্রহের প্রতিকার করিতে এ রাজ্যের প্রশাসন সম্পূর্ণ ব্যর্থ। কেন এই অক্ষমতা? সোশ্যাল মিডিয়ায় অবমাননা, হুমকি, নির্যাতন ইত্যাদির বিরুদ্ধে আইন অাছে। তবে অভাব কিসের? আক্রমণকারী ও আক্রান্ত, দুই পক্ষেরই সন্ধান যেখানে সহজেই মেলা সম্ভব, হুমকিদাতা কিংবা ট্রোলকারীকে কেন শাস্তিদান করা যায় না? বিশেষত প্রতিপক্ষ যখন অল্পবয়সি ছাত্রছাত্রীরা, কোনও রাজনৈতিক দলের পোড়খাওয়া সমর্থক-কর্মী নহেন! বাস্তবিক, প্রশাসন কেবল নেট-হিংসা থামাইতে ব্যর্থ নহে, যাদবপুরে দুই পক্ষের সংঘর্ষ আটকাইতেও ব্যর্থ। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ পুলিশ ডাকিতে অরাজি হওয়ায় সাংসদ মহাশয় সে দিন পুলিশের সাহায্য পান নাই। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের বাহিরে যে উত্তাল জনতার আস্ফালন, এবং সন্ধ্যায় যে ভাঙচুর-অগ্নিকাণ্ড, সেখানেও কি পুলিশের ভূমিকা প্রত্যাশিত ছিল না? প্রকাশ্য হিংসা ও সাইবার-হিংসা দুই-ই যদি দৃষ্টান্তযোগ্য শাস্তির মাধ্যমে আটকানো না যায়, তবে সিদ্ধান্ত কেবল একটিই: প্রশাসনের সদিচ্ছায় গুরুতর ফাঁক আছে।