নব্য-নাৎসি আর বিশ্ব হিন্দু পরিষদ যেখানে মিলে যেতে থাকে

মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন

রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলতে শুরু করেছিলেন, সরকার গঠন না হলে ফের ভোট হবে এবং আরও বেশি সংখ্যক আসন পেয়ে ক্ষমতায় চলে আসবে এএফডি। উদ্বাস্তু সমস্যার চূড়ান্ত সময়ে মধ্যবিত্ত জার্মান ভাবাবেগে এতই নাকি তাদের ‘জনপ্রিয়তা’।

Advertisement

স্যমন্তক ঘোষ

শেষ আপডেট: ০৫ অগস্ট ২০১৮ ০০:০০
Share:

প্রথম দৃশ্য

Advertisement

মার্চের প্রথম সপ্তাহ

খবর এল, অল্টারনেটিভ ফুয়ার ডয়েচল্যান্ড, সংক্ষেপে এএফডি দল একটি ‘প্রাইভেট’ প্রতিনিধি দল পাঠিয়েছে সিরিয়ায়। সেখানকার পরিস্থিতি সরজমিন খতিয়ে দেখতে। বিষয়টা যে বেশ উদ্বেগজনক, তা বোঝা যাচ্ছিল সেখানকার তথাকথিতলিবারালমানুষজনের সঙ্গে সামান্য কথা বললেই। কারণ, ইউরোপের রাজনীতিতে জার্মানির এএফডি ‘নিয়ো নাৎসি’ রাজনৈতিক দল বলেই পরিচিত। গত কয়েক বছরে ধর্মীয় উগ্রতা’, ‘জাতি বিদ্বেষ’, ‘ইহুদি বিদ্বেষ’, এই সব বিষয়েই এএফডি তার নিজস্ব পরিমণ্ডল তৈরি করে ফেলেছে হিটলার-পরবর্তী জার্মানিতে। ২০১৩ সালের জাতীয় নির্বাচনে চার শতাংশ ভোট পেয়েছিল দলটি। জার্মান সংসদে প্রবেশই করতে পারেনি। অথচ চার বছর পর ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরের নির্বাচনে তাদেরই ঝুলিতে ১৩ শতাংশ ভোট। দখল করেছে ৯৪টি আসন। যার পরিণামে বদলে গিয়েছে জার্মান রাজনীতির চেহারাটাই। সেপ্টেম্বর নির্বাচনের পর জাতীয় সরকার গঠন করতে রীতিমতো বেগ পেতে হয়েছে মূলস্রোতের জার্মান রাজনৈতিক দলগুলিকে। শেষ পর্যন্ত ২০১৮ সালের মার্চ মাসের শেষ সপ্তাহে আঙ্গেলা ম্যার্কেলের ক্রিশ্চান ডেমোক্র্যাটিক পার্টি এবং তথাকথিত মধ্য বামপন্থী সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি বা এসপিডি এক প্রকার ‘বাধ্য’ হয়েই জোট সরকার গঠন করে। প্রায় ছমাস ধরে সেই জোট-জল্পনা চলেছিল একটাই কারণে। এএফডি-কে আটকানো। রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলতে শুরু করেছিলেন, সরকার গঠন না হলে ফের ভোট হবে এবং আরও বেশি সংখ্যক আসন পেয়ে ক্ষমতায় চলে আসবে এএফডি। উদ্বাস্তু সমস্যার চূড়ান্ত সময়ে মধ্যবিত্ত জার্মান ভাবাবেগে এতই নাকি তাদেরজনপ্রিয়তা

Advertisement

জোট হয়েছে। সরকার হয়েছে। ৯৪টি আসন নিয়ে এএফডি এখন জার্মান পার্লামেন্টে প্রধান বিরোধী শক্তি।

এ হেন এএফডি সিরিয়ায় প্রতিনিধি দল পাঠালে উদ্বিগ্ন হওয়ারই কথা! সপ্তাহ দেড়েক পর উদ্বেগ আরও বাড়িয়ে সাংবাদিক বৈঠক করলেন তথাকথিতনিয়ো নাৎসি নেতারা। শোনালেন তাঁদের সিরিয়া সফরের কাহিনি। যার সারমর্ম, কিছু কিছু এলাকায় সমস্যা চোখে পড়লেও, সিরিয়ার সার্বিক চিত্রটি মোটের উপর শান্তিপূর্ণ বলেই মনে হয়েছে তাঁদের। সে দেশে রাজনীতির বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে কথা বলে তাঁরা বুঝতে পেরেছেন, ইউরোপে, বিশেষত জার্মানিতে বসবাসকারী সিরিয়ান উদ্বাস্তুদের দেশে ফিরিয়ে দেওয়াই যায়। নতুন সরকার যাতে সেই ব্যবস্থা করে, তার জন্য তাঁরা লড়াই করবেন বলে জানিয়ে দেওয়া হয়। তথ্যের খাতিরে বলে রাখা ভাল, জার্মানিতে শুধুমাত্র সিরিয়ান উদ্বাস্তুর সংখ্যাই এখন ছলক্ষের বেশি। তবে ২০১৬ সালের পর থেকে উদ্বাস্তু প্রবেশের হার অনেকটাই কমেছে। সে দিনের সাংবাদিক বৈঠকে আরও একটি কথা বলেছিলেন ওই নেতারা। জার্মানি পরোপকারী, অর্থবান। ফলে সিরিয়ান উদ্বাস্তুদের দেশে পাঠিয়ে সে দেশের সরকারকে মোটা অর্থ সাহায্য করতে পারে জার্মানি। প্যাকেজপেলে খুশি মনে নিজের লোকেদের ফিরিয়ে নেবে রাষ্ট্র। অনুপ্রবেশকারীদের জন্য গ্রাসাচ্ছাদনের ব্যবস্থা করতেও সরকারের সুবিধা হবে। তা ছাড়া, মানবিকতার খাতিরে উদ্বাস্তুদের পাশেও তো দাঁড়ানো দরকার! শুধু সিরিয়ান নয়, সে দেশের তুর্কি, আফগান, উত্তর আফ্রিকান, এমনকি, ভারতীয় উপমহাদেশীয় উদ্বাস্তুদের বিষয়েও একই মতামত ছিল ওই নেতাদের। তাঁদের বক্তব্যে দুটি বিষয় খুব স্পষ্ট ছিল। এক, উদ্বাস্তুরা জার্মানসংস্কৃতিকে নষ্ট করছে। এবং দুই, তাদের জন্য ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশের অর্থনীতি।

পর দিন জার্মান সংবাদমাধ্যমের একটি বড় অংশ এএফডির মতামতকেসুপারিশ’-এর চোখেই দেখেছিল।

দ্বিতীয় দৃশ্য

অগস্টের প্রথম সপ্তাহ

সদ্য প্রকাশিত হয়েছে অসমের জাতীয় নাগরিক পঞ্জির চূড়ান্ত ড্রাফট। কলকাতায় সাংবাদিক বৈঠক ডাকলেন বিশ্ব হিন্দু পরিষদের এক বর্ষীয়ান নেতা। যার পর দিন রাজ্য বিজেপির সদর দফতরে বসে এক শীর্ষস্থানীয় বিজেপি নেতা বৈঠকি চালে বলেছিলেন, ‘‘কলকাতায় সঙ্ঘের কোনও সাংবাদিক বৈঠকে এমন জমায়েত আগে কখনও দেখিনি। বাড়ছি, বাড়ছি, আমরা বাড়ছি। এর পর ছুঁতেও পারবে না।’’

সাংবাদিক বৈঠকে অনেক কথার মধ্যে সে দিন ভিএইচপি সব চেয়ে বেশি জোর দিয়েছিল একটি বিষয়ে— এ বার জাতীয় পঞ্জি চাই পশ্চিমবঙ্গে। দুধ কা দুধ পানি কা পানি বুঝে নিতে জাতীয় পঞ্জিই নাকি একমাত্র দাওয়াই। তাদের ধারণা, এ রাজ্যে জাতীয় পঞ্জি তৈরি হলে অন্তত এক কোটি বাংলাদেশি মুসলিমকে অবৈধ ‘অনুপ্রবেশকারী’ বলে দেগে দেওয়া যাবে। এ পর্যন্ত এক রকম ছিল। চেনা সুরেই গড়াচ্ছিল বৈঠক। কিন্তু এর পরবর্তী বাক্যগুলিতে মিলে গেল গঙ্গা এবং রাইনের জল। বরিষ্ঠ নেতা বলে বসলেন, ‘‘ওরা যাতে সুষ্ঠু ভাবে নিজের দেশে ফিরে যেতে পারে, তার ব্যবস্থা আমরা করে দেব। প্রয়োজনে সে দেশের সরকারকেও কিছু আর্থিক অনুদান দেওয়া যাবে। কত দেশকেই তো আর্থিক সাহায্য করি আমরা। কারও ক্ষতি হোক আমরা চাই না। গ্রাসাচ্ছাদনের ব্যবস্থা হোক সকলের জন্য। তবে নিজের দেশে। এ দেশে নয়।’’ বিশ্ব হিন্দু পরিষদের বক্তব্যে দুটি বিষয় স্পষ্ট ছিল। এক, অনুপ্রবেশকারী মুসলিমরাসনাতন ভারতীয় সংস্কারধ্বংস করছে। এবং দুই, অর্থনীতির বারোটা বাজছে।

সাত দশক পরেও

এএফডি-র সেই ‘মহান’ সাংবাদিক বৈঠকের পর সুযোগ হয়েছিল সে দেশের কয়েক জন সমাজবিজ্ঞানীর সঙ্গে কথা বলার। সকলের বক্তব্যেই একটা কথা বার বার উঠে আসছিল। জাতি-রাষ্ট্রেও জাতীয় পরিচয়বান্যাশনাল আইডেনটিটির ধারণাটি ক্রমশ গুলিয়ে যাচ্ছে। একুশ শতকের বিশ্বেউদ্বাস্তু পরিচয়ও কি কোনও দেশেরজাতীয় পরিচয়’-এর অংশ নয়? এই ছিল তাঁদের প্রশ্ন।

উদ্বাস্তু এবং আশ্রয় চাওয়া মানুষদের একটা বড় অংশকে ‘ডিপোর্ট’ করা পশ্চিমি ইতিহাসে নতুন কিছু নয়। জার্মান নথি বলছে, ২০১৬-১৭ সালে পৌঁছে সেই আপাত সাধারণ বিষয়টি আরও একটি উদ্বেগের কারণ তৈরি করেছে। ৭০ শতাংশেরও বেশি সংখ্যক মানুষকে তাদের দেশে ফেরত পাঠানো যায়নি, কারণ উদ্বাস্তুদের নিজ নিজ দেশের সরকার প্রয়োজনীয় নথি পাঠায়নি জার্মান অভিবাসন দফতরকে। ফলে কাগজপত্রহীন উদ্বাস্তুদের তোলাই যায়নি কোনও বিমানে। এর মধ্যে আবার দশ শতাংশ মানুষের ঠিকানাই নাকি বুঝে ওঠা যায়নি। এক শরণার্থী শিবির থেকে অন্য শরণার্থী শিবিরে ঘুরে বেড়ানো এই সমস্ত মানুষ বলেই উঠতে পারেননি তাঁদের জন্মভূমির ঠিকানা।

ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে আসা এক অতি সাধারণ সাংবাদিকের সঙ্গে ওই বিশিষ্ট সমাজবিজ্ঞানীরা কথা বলতে রাজিই হয়েছিলেন একটি বিশেষ কারণে। নিজেদের সমস্যার কথা উল্লেখ করে তাঁরা শুনতে চাইছিলেন, দীর্ঘ দিন ধরে উদ্বাস্তু সমস্যায় জর্জরিত উপমহাদেশের বাস্তব সমস্যাগুলির হাতে গরম তথ্য এবং কাহিনি।

সে দিন সম্ভবত খুশি করার মতো বিশেষ কিছু শোনানো যায়নি তাঁদের। কিন্তু, আজ বলাই যায়, একুশ শতকে পৃথিবীর অন্যতম পরিচিত জনকল্যাণকারী জাতি-রাষ্ট্র যে দার্শনিক (নাকি বাস্তবিক) দ্বন্দ্বের কিনারায় এসে দাঁড়িয়েছে, ৭০ বছর ধরে ভারতীয় উপমহাদেশ তার চেয়েও গভীর সঙ্কট বয়ে চলেছে তার শিকড়বাকড়ে। নিত্য যাপনে। অনেকের মতে, উপমহাদেশ খণ্ডিত হয়েছে বটে, কিন্তু জাতি-রাষ্ট্রের ধারণাটিই তৈরি হয়নি এখনও। সীমান্ত পারাপার, রাষ্ট্রপুঞ্জ নির্ধারিতউদ্বাস্তু’, ‘শরণার্থী’, ‘অনুপ্রবেশকারীশব্দগুলি তাই এখানে কেবলই গুলিয়ে যায়। এর ইতিহাস কেবল কিছু সময়, কিছু ঘটনার ক্রমে আটকে থাকে না। অনুপ্রবেশকারী বলে যাঁরা চিহ্নিত হচ্ছেন এবং কালক্রমে আরও বেশি বেশি করে হবেন, তাঁদের আসলে কোনও দেশ নেই। জার্মানিতে হয়তো সংখ্যাটা এখন ১০-১৫ শতাংশ। গোটা ইউরোপে তার চেয়ে সামান্য বেশি। কিন্তু যে দেশে ষাট বছর আগে টোবা টেক সিং লেখা হয়েছিল, সে দেশে এই সংখ্যাটা বোধ হয় শতাংশের হিসেবকেও ছাড়িয়ে যায়।

পুনশ্চ: এত দিন রাজনীতি সময়ের নিয়ম মেনে ছোট ছোট পরিসরে আরও ছোট ছোটরফাসূত্র তৈরি করে পরিস্থিতির সামাল দিত। এএফডি-সঙ্ঘের রাজনীতি সুদূরপ্রসারী আশঙ্কার সুপারিশ করছে। বাকি উত্তর তো ইতিহাসের জানাই!

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement