মাধব ঝা দৌড়চ্ছেন। হাতে সময় বড় কম। তুষারপাতে বেশ কিছু সময় ধরে বন্ধ রয়েছে মেট্রো। বাইরে ক্যাবও নেই। এই শীতের রাত্রে দৌড় ছাড়া সেখানে পৌঁছনোর আর কোনও উপায় নেই মাধবের হাতে।
তাঁকে পাওয়া যেতে পারে এমন একটা আভাস পাওয়া গিয়েছে এই মাত্র। কিন্তু তাঁকে খুঁজতেই তো সুদূর এই নিউইয়র্কে স্বল্পমেয়াদের একটা কাজ জুটিয়ে আসা। কাজের মেয়াদ শেষ, কিন্তু সে এখনও অধরা। এই সামান্য আভাসটুকুই তাই দেশে ফিরে যাবার আগে, মাধবকে উত্তেজিত করেছে জোর।
কিন্তু ঘড়ির কাঁটা এগোচ্ছে দ্রুত। মধ্যরাতের আর দেরি নেই বেশি। তাপমাত্রা ৬.৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এত শীতে দৌড়তে গিয়ে পায়ে, পেটের পেশিতে ক্র্যাম্প ধরে যাচ্ছে, কিন্তু তাকে পাত্তা দিলে চলবে কেন! গুগল ম্যাপ খুলে উদ্দিষ্ট জায়গার অবস্থান ক্ষণে ক্ষণে দেখে নিচ্ছেন মাধব। ভালবাসার জন্য এতটা পথ পাড়ি দিয়ে এসেছেন। এর শেষটা যেন মধুর হয়, এমন প্রত্যাশায় বুক বেঁধে তিনি দৌড়চ্ছেন। সঙ্গে সঙ্গে পাঠকও। একেবারে দমবন্ধ অবস্থা।
মাধব যখন ক্যাফেতে ঢুকলেন, তখন গায়িকার শেষ গান চলছে। চোখ বন্ধ করে গাইছেন গায়িকা। আর মাঝে মাঝে চোখ খুলে দেখে নিচ্ছেন দর্শকদের প্রতিক্রিয়া। এদিকে গায়িকাকে দেখে মাধবের সারা শরীরে শিহরণ। এতক্ষণের পথশ্রম নিমেষে উধাও। অবশেষে দেখা মিলল তাঁর! নতুন করে নিজে বিড়ম্বনায় পড়বেন না, ভালবাসার মানুষটিকে বিড়ম্বনায় পড়তে দেবেন না এমন মনোভাব থেকে ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার ভুল সংবাদ দিয়ে দূরে সরে এসেছিলেন রিয়া। রিয়া সোমানি। নিউইয়র্কের বারে গান গাইবার আবাল্য বাসনাটিকে চরিতার্থ করার মধ্যেই খূঁজতে চেয়েছিলেন জীবনকে। কিন্তু ধরা পড়ে গেলেন মাধবের ভালবাসার কাছে।
চোখ খুলে মাধবকে দেখে থেমে গেল রিয়ার গান, ‘you’re beautiful, you’re beautiful’.মিলন ঘটল প্রেমিক প্রেমিকার।
‘Half Girlfriend’ উপন্যাসে চেতন ভগত এ ভাবেই টান টান উত্তেজনার স্বাদু পরিণতি দিয়ে মন ভরিয়ে দেন পাঠকের। উপন্যাসের পটভূমি কখনও দিল্লি, কখনও বিহার, কখনও নিউইয়র্ক। কাহিনিতে কখনও বিল গেটস চলে আসছেন, কখনও ঘানা, উগান্ডা, তাঞ্জানিয়া, বৎসোয়ানার এইচআইভি, এইডস-সমস্যা ছায়া ফেলে যাচ্ছে, আবার কখনও প্রত্যন্ত বিহারের দারিদ্র্য, শিক্ষা-সমস্যা, স্কুল নিয়ে ভাবনা উঠে আসছে অনুপুঙ্খ বিবরণ সহ। কথক কখনও স্বনামে লেখক, কখনও নায়ক। রয়েছে আধুনিক জীবনযাপনের নানা অনুষঙ্গ। শেষবিচারে হয়ত কাহিনি দুর্দান্ত কিছু নয়, কিন্তু কী অসাধারণ প্যাকেজিং!
হালফিলের বাংলা গল্প উপন্যাস কি এই প্যাকেজিং এ মার খাচ্ছে কোথাও? হয়ত। তবে এটাই মূল কারণ নয়। এবারের জেলা বইমেলায় ইংরেজি বইয়ের স্টলগুলোয় ভিড় দেখে মনে হল, রাজ্যের অন্য জায়গার মতো এখানেও বাংলা মাধ্যম বিদ্যালয়ের ক্রমে শীর্ণ হয়ে আসা নদীটির মতো অবস্থা কাজ করছে এর পিছনে।
বাংলা মাধ্যম বিদ্যালয়ে যে ছাত্রসংখ্যা ক্রমহ্রাসমান, এটা এখন আর নতুন কোনও তথ্য নয়। এ চিত্র যেমন জেলার সদরে, তেমনই মফস্সলেও। কিছুটা বাংলা মাধ্যম বিদ্যালয়ের ঢিলেঢালা অবস্থা, আর কিছুটা সর্বভারতীয় পরীক্ষাগুলোতে বসতে গেলে ইংরেজির মুখোমুখি হওয়ার বাধ্যবাধকতা। মূলত এই দুই কারণে ইংরেজি মাধ্যম বিদ্যালয়ে সন্তানকে পড়ানোর মানসিকতা এখন দূর প্রত্যন্ত গ্রামের অভিভাবকদের মধ্যেও দেখা যাচ্ছে। হাতের কাছে ইংরেজি মাধ্যম বিদ্যালয়ও এখন সহজলভ্য। ইংরেজি মাধ্যম বিদ্যালয়ে পড়া খরচসাপেক্ষ, ফলাফল অনেক সময়েই প্রত্যাশার ধারেপাশে নেই, তবু সন্তানের ভবিষ্যতের কথা ভেবে ইংরেজির মায়াজালে ক্রমেই আটকে পড়ছেন অভিভাবকেরা। খুব স্বাভাবিক ভাবেই ইংরেজি ভাষার জ্ঞান-বিজ্ঞানের বই খুঁজতে ইংরেজি বইয়ের স্টলগুলোতে ভিড় করছেন ছাত্র-অভিভাবকের দল।
এই ইংরেজি-প্রীতির সূত্র ধরে একটা সার্বিক বাংলা-অনীহা জন্ম নিচ্ছে চারদিকে। ইংরেজির ঢেউয়ে মধ্যবিত্ত পরিবারে গরু এখন cow, প্রজাপতি butterfly।আর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর? সুভো ঠাকুর একদা ছড়া কেটেছিলেন…‘Poet Tagore কে হন তোমার / জোড়াসাঁকোতেই থাকো?/বাপের খুড়ো হন শুনিয়াছি-/ মোর কেহ হন নাকো।’ ইংরেজি মাধ্যম বিদ্যালয়ে পড়া ছাত্রটির কাছেও এখন রবীন্দ্রনাথ যেন শুধু বাবা-কাকাদেরই প্রিয়, দূরের কোনও জন। বদলে যাওয়া এই মানসিকতার সূত্র ধরে নতুন প্রজন্মের বাঙালি সন্তানদের হোয়াটসঅ্যাপ, ফেসবুক ব্যস্ততার ফাঁকে যেটুক সাহিত্য পাঠ এখনও বেঁচে আছে সেখানে ঢুকে পড়েছেন চেতন ভগত, অজয়কুমার পান্ডে, দুর্জয় দত্তেরা।
এই সব বেস্টসেলার ইংরেজি-লেখকদের উপন্যাসে বর্তমান প্রজন্মের সহজে মজে যাওয়ার উপকরণও প্রচুর। প্রথমত ভাষার সারল্য। পড়তে গিয়ে হোঁচট খেতে হয় না কোথাও। এ ছাড়া কাহিনির বুননেও নেই জটিলতা। উপরন্তু রয়েছে থ্রিলারের টান। আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার প্রায় সর্বত্র। আর এই সব উপন্যাসে সবচেয়ে যেটা বড় ব্যাপার, চালাকি কম। পুথিপড়া বা ইন্টারনেট ঘাঁটা বিবরণ নয়, প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার ছাপই নজরে পড়ে বেশি।
অজয় কে পান্ডের ‘Her Last Wish’ এর কথাই ধরা যাক। আস্থা ও বিজয়ের এই গল্পে আস্থার এইচাইভি সংক্রমণ থেকে এইডসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়া অব্দি আস্থার চিকিৎসা এবং তাঁর সাতটি ইচ্ছার একে একে পূরণ হওয়ার এমন বিশ্বস্ত বর্ণনা লেখক হাজির করেন যে পাঠকও একাত্ম হয়ে পড়েন এবং এইডস নামক ভয়ানক রোগটির ক্রম-পরিণতির ব্যাপারে রীতিমত অভিজ্ঞতাও লাভ করে ফেলেন।
এই সব উপন্যাসের শেষে, আমাদের সম্পন্ন বাংলা সাহিত্যের পাঠকদের প্রাপ্তি হয়ত তেমন কিছু হয় না, কিন্তু যাঁরা সাহিত্যপাঠই শুরু করবেন এঁদের দিয়ে, তাঁরা কিন্তু চেতন ভগত বা অজয় কে পান্ডের মতো লেখকদের একটা উপন্যাসের সূত্র ধরে পড়তে চাইবেন তাঁদের অন্য লেখাগুলিও। এবং সেসবের খোঁজে বইমেলার ইংরেজি বইয়ের স্টলে ভিড়ও করবেন। বেস্ট সেলার ইংরেজি লেখকদের জিতটা বোধহয় এখানেই।
কিন্তু এখনও সত্যজিৎ রায়, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বইয়ের পাঠক যে রয়েছে, তা চোখে পড়ে। পাঠক এখনও আরও অনেক বাঙালির লেখকের বই কিনছেন। পাঠক রয়েছে ছোট পত্রিকা এবং কবিতারও। ভয় হয়, সেই পাঠক আস্তে আস্তে কমে যাবে কি না।
ভয় হয় বেস্টসেলার ইংরেজি উপন্যাসের গল্পের মান দেখে। সিনেমা বা টেলিভিশনের সিরিয়ালের সঙ্গে উপন্যাসের যে জাতিগত পার্থক্য রয়েছে, তা চেতন ভগতদের উপন্যাস পড়লে অনেক সময় ভুলে যেতে হয়। এ কথা বললে হবে না যে, তখন টিভি বা সিনেমা ছিল না। উপন্যাস চরিত্রগত ভাবে পাঠকের সঙ্গে একাকী সম্পর্কের বাঁধনে বাঁধা। লিখিত অক্ষরের সঙ্গে সঙ্গে পাঠকের মনের কথা তাতে মেশে। যেখানে অনেকে মিলে এক সঙ্গে বসে দেখা নেই। এই একাকিত্বে একই উপন্যাসের একাধিক পাঠক একাধিক পাঠ তৈরি করেন। সেই বহুস্তরীয় পাঠটিই সভ্যতার অঙ্গনে পোঁতে চিন্তার নতুন বৃক্ষ। তা থেকে সরে এলে বাংলা সাহিত্যের ক্ষতি তো বটেই, পাঠকের নিজেরই বড় ক্ষতি।
শিক্ষক, ভগবানগোলা হাইস্কুল