প্রতীকী ছবি।
মাথা নত হয় যায়। লজ্জা বড় নির্মম রূপ নিয়ে একেবারে মুখোমুখি এসে দাঁড়ায়। আন্তর্জাতিক সমীক্ষা বলছে, এ গ্রহে মহিলাদের জন্য সবচেয়ে বিপজ্জনক প্রান্ত হল ভারত। কথাটা কানে যাওয়া মাত্রই অসীম লজ্জা হানা দিতে বাধ্য। কী জবাব দেব, কাকে দেব, কেন দেব— বুঝে ওঠা যায় না। কিন্তু পরক্ষণেই প্রশ্নও জাগে। কোন মানদণ্ডে ভারতকে এমন ভয়ঙ্কর তকমা দেওয়া হল? প্রতিদিন-প্রতিনিয়ত সভ্যতার যাবতীয় মূল্যবোধের নিধনযজ্ঞ চলছে পৃথিবীর যে সব প্রান্তে, নিরন্তর ধ্বংসলীলার মাঝে নারীর অধিকার বা আত্মমর্যাদা অস্তিত্বহীন হয়ে পড়ছে পৃথিবীর যে সব প্রান্তে, সে দেশের নারী ভারতীয় নারীর চেয়ে নিরাপদে রয়েছে কি সত্যিই?
টমসন রয়টার্সের সমীক্ষা। আন্তর্জাতিক মান্যতাপ্রাপ্ত সংস্থা। অতএব সমীক্ষার ফলাফল পত্রপাঠ নস্যাৎ করে দেওয়ার মতো নয়। সমীক্ষা বলছে, ভারতেই নারী সবচেয়ে নির্যাতিত, নিপীড়িত। নারীর স্বাস্থ্য, লিঙ্গ বৈষম্য, যৌন নিগ্রহ, অন্যান্য নিগ্রহ, নারী পাচার, নারী নির্যাতনকারী সামাজিক কুপ্রথা— এই ছ’টি বিষয়ের খোঁজখবর নেওয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্ট এলাকার নাগরিকদের একাংশের মতামত নেওয়া হয়েছে। তার ভিত্তিতেই প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে। এমন এক প্রতিবেদন যখন বলছে, পৃথিবীতে ভারতই নারীদের জন্য সবচেয়ে বিপজ্জনক, তখন উদ্বিগ্ন হতেই হবে।
উদ্বেগের মধ্যেই হানা দেয় খুব বড় প্রশ্নচিহ্ন। আর্থিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিক সূচকে ভারতের চেয়ে যোজন পিছিয়ে রয়েছে যে সব দেশ, টমসন রয়টার্সের সমীক্ষায় সেই সব দেশ কী ভাবে নারীর নিরাপত্তায় ভারতের চেয়ে এগিয়ে গেল, এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়া অত্যন্ত কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। ইউরোপের একাধিক দেশে, কানাডায় এবং আমেরিকায় এখন মধ্য এশিয়া থেকে যাওয়া শরণার্থীদের ভিড় যথেষ্টই। সিরিয়ায়, ইরাকে ঠিক কী ধরনের পীড়ন চলছে নারীর উপরে, ওই দুই দেশ ছেড়ে পালানো প্রায় প্রত্যেক মহিলার কাছে তার বিশদ বিবরণ মেলে। সিরিয়া ছেড়ে পালাতে সক্ষম হওয়া বা সে দেশ থেকে উদ্ধার হওয়া একের পর এক ইয়াজিদি মহিলার বয়ানে স্পষ্ট, কতটা অকথ্য নির্যাতনের শিকার হয়েছেন তাঁরা। হাজার হাজার মহিলাকে যৌনদাসী বানিয়ে রাখা হয়েছে আইএস শিবিরগুলিতে। যাঁরা উদ্ধার পেয়েছেন, বিভীষিকাময় স্মৃতি এখনও তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে তাঁদের। সহজ জনজীবনে এখনও ফিরতে পারেননি তাঁরা অনেকেই। আর যাঁরা উদ্ধার পাননি, তাঁরা কী পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যাচ্ছেন, তা কল্পনা করতেও ভয় হয়। এহেন সিরিয়ায় নারী কী ভাবে ভারতীয় নারীর চেয়ে বেশি নিরাপদে রয়েছেন?
সম্পাদক অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা আপনার ইনবক্সে পেতে চান? সাবস্ক্রাইব করতে ক্লিক করুন
যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তানের দিকে তাকানো যাক। ধর্মীয় অনুশাসনের কারণেই সমাজ অত্যন্ত রক্ষণশীল সে দেশে। দীর্ঘ তালিবানি শাসনে আরও শৃঙ্খলিত হয়েছেন আফগান নারী। আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপে তালিবান শাসন থেকে আফগানিস্তান আজ মুক্ত ঠিকই, কিন্তু আফগান সমাজ এখনও তালিবানি ফতোয়ায় অনেকখানি নিয়ন্ত্রিত। সেই ফতোয়া-রাজে কত রকম শৃঙ্খল চাপানো হয় নারীর উপরে, সে আখ্যান মুখে মুখে ফেরে। তাই প্রশ্ন জাগে, আফগানিস্তানে নারীর অবস্থা ভারতীয় নারীর চেয়ে ভাল কী ভাবে?
প্রায় প্রতিটি আর্থ-সামাজিক সূচকে ভারতের চেয়ে বহু পিছিয়ে পাকিস্তান। ধর্মীয় অনুশাসন এবং আইন অনেক ক্ষেত্রেই সমার্থক সে দেশে। অনুশাসনের নামে কতটা নিষেধাজ্ঞার বেড়াজালে ঘিরে রাখা হয় পাকিস্তানি নারীকে, সে ধারণা গোটা বিশ্বেরই রয়েছে। পড়াশোনা করতে চেয়ে কী পরিস্থিতির মুখে পড়েছিলেন মালালা ইউসুফজাই, গোটা বিশ্ব তা জানে। কী ঘটেছিল মুখতার মাইয়ের সঙ্গে তা-ও পৃথিবীর কাছে অজানা নয়। মালালা, মুখতারদের আখ্যান আসলে প্রতিনিধিত্বমূলক। পাক নারীর সামাজিক অবস্থান ঠিক কী রকম, তার একটা ধারণা দেয় এ সব আখ্যান। সেই পাকিস্তানকেও কী ভাবে নারীর নিরাপত্তায় ভারতের চেয়ে এগিয়ে রাখা হল, সে প্রশ্ন উঠছেই।
আরও পড়ুন: মেয়েদের জন্য সবচেয়ে বিপদের দেশ ভারত, বলছে সমীক্ষা
ভারতে নারী অত্যন্ত সুখে রয়েছে, এ দেশে নারীর বিরুদ্ধে অপরাধ নামমাত্র হয়, এমনটা বলা খুব কঠিন। যৌন নিগ্রহ, অন্যান্য নিগ্রহ, লিঙ্গবৈষম্য— ভারতে নারীর বিরুদ্ধে এই সব অপরাধ নিরন্তর ঘটছে। পরিস্থিতি বেশ উদ্বেগজনকও। তা নিয়ে দেশের প্রশাসন এবং দেশের সমাজ নিরন্তর সমালোচনার শিকারও হচ্ছে। কিন্তু কোন মাপকাঠিতে আন্তর্জাতিক সমীক্ষকদের মনে হল যে, সিরিয়া-আফগানিস্তান-পাকিস্তানে নারী ভারতের চেয়ে নিরাপদে রয়েছেন, তা বেশ দুর্বোধ্য। অতএব সমীক্ষার ফলাফলকে ঘিরে থাকে অস্বচ্ছতা।
অস্বচ্ছ মানদণ্ডে বিচার করে ভারতীয় সমাজের অবমূল্যায়ন ঘটানো হয়েছে, এমনটা যদি মনে হয়, তা হলে তার প্রতিবাদ তথা বিরোধিতা আমাদের করতেই হবে। টমসন রয়টার্সের সমীক্ষা ঠিক কী ধরনের মানদণ্ড ব্যবহার করে ভারতকে নারীর জন্য সবচেয়ে বিপজ্জনক স্থান আখ্যা দিল, সে প্রশ্ন আন্তর্জাতিক পরিসরেই আমাদের তুলতে হবে। তবে ঘরের ভিতরে দাঁড়িয়ে খতিয়ে দেখা দরকার, ঘরটা সত্যিই গোছানো রয়েছে তো? পাড়া-পড়শি যদি অবিশ্বাসসযোগ্য ভাবে আঙুল তোলে আমার ঘরের অগোছালো দশা নিয়ে, তা হলে তার বিরোধিতা করতেই হবে। কিন্তু ঘরে ফিরে আয়নার সামনে নিজেকে দাঁড়াতে হবে। গভীর ভাবে চেয়ে দেখতে হবে নিজেদের মুখপানেই। নিজেদের রোজ প্রশ্ন করতে হবে, বোঝার চেষ্টা করতে হবে, গলদ রয়ে যাচ্ছে কোথায়?