ছবি রয়টার্স।
কোনও এক ব্যক্তির প্রতি অন্যায় প্রত্যেকের ন্যায় পাইবার সম্ভাবনাকে বিপন্ন করে, বলিয়াছিলেন মার্টিন লুথার কিং। তাঁহার অনুসরণে বলা যাইতে পারিত, এক জন অন্যায়ের শাস্তি পাইলে সকলের ন্যায় পাইবার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়। কিন্তু বাস্তব যে জটিল, তাহার প্রমাণ উডি অ্যালেন। এই মার্কিন চলচ্চিত্র-ব্যক্তিত্বের আত্মকথার প্রকাশ বাতিল করিল এক বিখ্যাত প্রকাশক। যুক্তি, অ্যালেনের বিরুদ্ধে যৌন-নির্যাতনের অভিযোগ আনিয়াছেন তাঁহার সৎ কন্যা। তাঁহার আত্মকথা কী করিয়া প্রকাশক ছাপিতে পারে? প্রকাশনা সংস্থাটি বইয়ের স্বত্ব ফিরাইয়াছে। কিন্তু প্রশ্ন উঠিয়াছে আপত্তির ন্যায্যতা লইয়া।সকল পক্ষের কথা শুনিবার ইচ্ছাই কি গণতন্ত্রের, তথা উদারবাদের পরিচয় নহে? যাঁহার অপরাধ প্রমাণিত, তাঁহারও নিজের কথা জানাইবার অধিকার আছে।অ্যালেনের বিরুদ্ধে অভিযোগ আদালতে প্রতিষ্ঠিত হয় নাই। তাঁহার কণ্ঠরোধ হইবে কেন? ইহাতে ‘মিটু’ আন্দোলনের স্ববিরোধ ও দেখিতেছেন অনেকে। মেয়েদের কথার মর্যাদা দিবার জন্য যাঁহারা সওয়াল করিতেছেন, তাঁহারাই কী করিয়া অন্যের কথা না শুনিয়া খারিজ করিতে পারেন?
সকলেরই নিজের নিজের কথা বলিবার সমান অধিকার, এমন মত শুনিতে ভাল। কিন্তু ‘মিটু’ আন্দোলনের সহিত যাঁহারা যুক্ত, তাঁহারা এই মতের নৈতিকতা লইয়া প্রশ্ন তুলিবেন। কথার মর্যাদা দিয়াই মানুষের মর্যাদা নির্দিষ্ট হয়। যাহারা মানুষের অসহায়তার সুযোগ লইয়া জঘন্য অপরাধ করিয়াছে, বহু মানুষের জীবন বিষাইয়া দিয়াছে, তাহারা কী করিয়া সমাজে মর্যাদার আসন দাবি করিতে পারে? নিপীড়কের সহিত এক আসনে কী করিয়া বসানো যায়নি পীড়িতকে? তেমন ভাবিলে নিপীড়নকে অবজ্ঞা করা হয়, অপরাধকে প্রশ্রয় দান করা হয়। আদালতের বিচার বস্তুত দুই পক্ষের বয়ানের গ্রহণযোগ্যতারই বিচার। যাহার বক্তব্যের প্রামাণ্য প্রতিষ্ঠা হয় না, তাহার শাস্তি হয়। কিন্তু এমন কিছু অপরাধ সমাজে অহরহ ঘটিয়া চলে, আইনি বিচারের প্রক্রিয়ার মধ্যে যাহার প্রমাণ বা প্রতিকার দুষ্কর। যেমন কর্মক্ষেত্রে নারীর যৌন হয়রানি। ‘মিটু’ আন্দোলন ছড়াইবার পর বহুদেশে, বহু মহিলার বয়ান যখন মিলিয়া গেল, তখন কর্মপ্রার্থী বা কর্মরত মহিলাদের হয়রানির সত্যতা স্বীকৃতি পাইল। অপরাধের ব্যাপকতা স্পষ্ট হইল।
কিছু ক্ষেত্রে আদালতও অভিযোগের মান্যতা দিয়াছে। সম্প্রতি যৌন হয়রানির জন্য হলিউড প্রযোজক হার্ভে ওয়েনস্টেইনকে তেইশ বৎসরের কারাদণ্ড দিয়াছে মার্কিনআদালত। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে আদালতে যৌন হয়রানির প্রমাণ দুষ্কর। সেই কারণে ‘মিটু’ আন্দোলন অভিযুক্তের সামাজিক তিরস্কার ও বর্জনের দাবি তুলিয়াছে। বহু প্রভাবশালী ব্যক্তি নিপীড়িত মহিলাদের দ্বারা অভিযুক্ত হইবার পরে পদচ্যুত, ব্রাত্য। ‘মিটু’ আন্দোলনের সামাজিক তাৎপর্য অনস্বীকার্য, তৎসত্ত্বেও বিচারব্যবস্থা-বহির্ভূত শাস্তির দাবি অস্বস্তিকর।একজনও নিরপরাধ শাস্তি যেন না পায়, ইহাই বিচারের প্রধান শর্ত। সামাজিক বিচার সেই অনুজ্ঞা সর্বদা মানে না।তাই কোনও ব্যক্তি তাহার দুষ্কর্মের শাস্তি পাইলেও, ন্যায় মিলিবার সম্ভাবনা বাড়িল কিনা, সে সংশয় রহিয়া যায়। ‘মিটু’-কে সম্মান করিবার পরেও বলিতে হয়, যৌন হয়রানির নিষ্পত্তিকে বিচারের মূলধারায় আনা জরুরি।