সর্বশিক্ষা কি কেবল ‘আদর্শ’ হইয়াই থাকিবে? সরকারি রিপোর্টে প্রকাশ, গত দুই বছরে পঞ্চম থেকে অষ্টম শ্রেণিতে তফসিলি জাতি ও জনজাতির শিশুদের স্কুলছুটের সংখ্যা দ্বিগুণ হইয়াছে। ইহার দুইটি অর্থ থাকিতে পারে। এক, এই শিশুরা কোনও স্কুলেই আর নাই। তাহারা বিদ্যালয়ের শিক্ষা সম্পূর্ণ করিতে পারিবে না, শিশুশ্রমিক অথবা বালিকাবধূ হইয়া দিন কাটাইবে। এই সম্ভাবনার পক্ষে সাক্ষ্য মাধ্যমিকের পরীক্ষার্থীর সংখ্যা। পশ্চিমবঙ্গে প্রায় সতেরো লক্ষ শিশু প্রতি বৎসর প্রথম শ্রেণিতে নাম লিখাইয়াছে। মাধ্যমিক পরীক্ষায় এ বৎসর বসিয়াছে এগারো লক্ষ। ছয় লক্ষ শিশু আজও স্কুলের পাঠ সম্পূর্ণ করিতে পারিতেছে না, এই ক্ষতি অপূরণীয়। এই স্কুলছুট শিশুদের মধ্যে দরিদ্র পরিবারের শিশুরাই অধিক। ইহারা যাহাতে স্কুলশিক্ষার বৃত্তের বাহিরে না থাকিয়া যায়, তাহার জন্যই শিশু শিক্ষা কেন্দ্র এবং মাধ্যমিক শিক্ষা কেন্দ্র চালু করিয়াছিল পশ্চিমবঙ্গ সরকার। প্রত্যন্ত গ্রামীণ এলাকাগুলিতে এগুলি শুরু হইয়াছিল, এবং নানা সমীক্ষায় স্পষ্ট হইয়াছিল যে এই কেন্দ্রগুলিতে অধিকাংশ ছাত্রছাত্রী তফসিলি জাতি, জনজাতি এবং মুসলিম পরিবারের শিশু। এই প্রতিষ্ঠানগুলি কেন্দ্র ও রাজ্য, উভয় তরফে ক্রমাগত বঞ্চিত হইয়াছে। শূন্যস্থানে শিক্ষক পূরণ হয় নাই, শিক্ষকদের ভাতাও বাড়ে নাই। সরকারি প্রতিষ্ঠান হইলেও, সরকারি স্কুলগুলির তুলনায় কোনও সুবিধাই পায় না এই প্রতিষ্ঠানগুলি। প্রান্তিক শিশুদের স্কুলছুটের হার বাড়িতেছে।
ইহা তৃণমূল সরকারের ব্যর্থতা। পঞ্চায়েত মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায় পূর্বতন বাম সরকারের উপর দায় চাপাইয়াছেন। তাঁহাদের শিক্ষক নিয়োগ নীতির জন্যই নাকি মাধ্যমিক শিক্ষা কেন্দ্রের মান নামিয়াছে। এই অজুহাত হাস্যকর। তৃণমূল সরকার ছয় বৎসর সময় পাইয়াছে। শিক্ষাখাতে নানা অনুদানের প্রকল্পে ব্যয় উত্তরোত্তর বাড়িয়াছে। এমনকী কন্যার বিবাহের জন্য অনুদানের ‘রূপশ্রী’ প্রকল্পে টাকা ঢালিতেও কার্পণ্য করে নাই সরকার। কেবল মাধ্যমিক শিক্ষা কেন্দ্রগুলির সংস্কার করিতেই তাহাদের টাকায় টান পড়িল, পরিকল্পনার ক্ষমতায় চড়া পড়িয়া গেল? আসল সমস্যার সূত্র মেলে মন্ত্রীর বক্তব্যেই। তাঁহার অভিযোগ, বামফ্রন্ট দলীয় কর্মীদের শিক্ষাকর্মীর পদে নিয়োগ করিয়াছিল। ইহাদের অবসর অবধি তাঁহার সরকার অপেক্ষা করিতেছে। অর্থাৎ, বিরোধী কর্মীদের ভাতা তৃণমূল বাড়াইবে কেন? ইহাই রাজধর্ম বটে। এমন ক্ষুদ্র দৃষ্টি যে কী বৃহৎ ক্ষতি করিতে পারে, তাহা পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষাব্যবস্থা ফের প্রমাণ করিল।
দলিত-আদিবাসীদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পোষণ না করিয়া বস্তুত রাজ্য সরকার দরিদ্র শিশুদেরই বঞ্চনা করিল। দক্ষিণ চব্বিশ পরগনায় একুশ শতাংশ আদিবাসী শিশু স্কুলছুট, ইহার অপেক্ষা লজ্জার কথা কী হইতে পারে? একটি সম্ভাবনা, ওই শিশুরা মাধ্যমিক শিক্ষা কেন্দ্র ছাড়িয়া কোনও অনুমোদনহীন প্রতিষ্ঠানে নাম লিখাইয়া থাকিতে পারে। তাহাতে সরকারি সমীক্ষায় তাহারা ‘স্কুলছুট’ বলিয়া পরিগণিত হইবে। কিন্তু তাহাতেও রাজ্য সরকারের দায় কমিবে না। শিক্ষার অধিকার আইন অনুসারে, সকল বিদ্যালয়কে অনুমোদন দিতে হইবে, অথবা বন্ধ করিতে হইবে। সে দায় পূর্ণ করিবে কে? শূন্য অজুহাত না দিয়া সরকার তাহার কর্তব্য করুক। দরিদ্র শিশু ফিরিয়া আসুক বিদ্যাঙ্গনে।