সতীদাহেই শেষ হয়নি জাতির দুর্ভাগ্য, ধর্মীয় হিংসা চলছেই

সতীদাহ নামক অপরাধটির সামাজিক বৈধতা দিয়েছিল কিছু গোঁড়া হিন্দু। আজ গো-হত্যাকে সামাজিক অপরাধ হিসাবে সর্বসম্মতি দেওয়ার তৎপরতা শুরু হয়েছে। লিখছেন জয়ন্ত ঘোষালকত কত বছর আগের কথা! ১৭৯৬ সাল। ছেলের কাছে সকাতর অনুনয় করেও ২৪ পরগনা জেলার মজিলপুর গ্রামের কোনও এক মা নিজের জীবন বাঁচাতে পারেননি। তার এক মর্মস্পর্শী বিবরণ পাওয়া যায় ওয়ার্ড সাহেবের বইয়ে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৮ জুন ২০১৬ ০০:০৩
Share:

কত কত বছর আগের কথা! ১৭৯৬ সাল। ছেলের কাছে সকাতর অনুনয় করেও ২৪ পরগনা জেলার মজিলপুর গ্রামের কোনও এক মা নিজের জীবন বাঁচাতে পারেননি। তার এক মর্মস্পর্শী বিবরণ পাওয়া যায় ওয়ার্ড সাহেবের বইয়ে। সতীনের ছেলে নয়। নিজের পেটের ছেলে। প্রচণ্ড প্রসববেদনা দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করে যে মা ছেলেকে পৃথিবীর মুখ দেখিয়েছিলেন, সেই ছেলে মাকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল আগুনের মুখে। ঘটনাটি এ রকম— মজিলপুরে বাঞ্চারাম নামে এক ব্রাহ্মণ মারা যান। স্ত্রী সহমরণে যাবেন স্থির হল। আনুষ্ঠানিক সব কাজকর্মের পর বিধবা স্ত্রীকে চিতার সঙ্গে বাঁধা হল। ছেলে মুখাগ্নি করলেন পিতার ও চিতার। কৃষ্ণপক্ষের ঘন অন্ধকার রাত। বৃষ্টি পড়ছে টিপটিপ করে। আগুনের আঁচ লাগতেই চিতার উপর ছটফট করে উঠলেন জীবিতা স্ত্রী। তিনি তো মরতে চান না। আগুন তখনও ভাল ভাবে জ্বলেনি। হঠাৎ কী ভাবে কী হল! দড়ির বাঁধন খুলে গেল। চিতা থেকে হামাগুড়ি দিয়ে বেরিয়ে এলেন ওই মহিলা। কিন্তু কোথায় পালাবেন? চারিদিকেই তখন ধর্মাকাঙ্খীদের বেষ্টনী। পাশেই একটি বড় ঝোপে লুকিয়ে পড়লেন ওই নারী। কিছু ক্ষণের মধ্যেই সবার খেয়াল হল, চিতার উপরে তো মাত্র একটিই শব। আর এক জন গেল কোথায়! খোঁজ খোঁজ রব পড়ল চারিদিকে। শেষ পর্যন্ত ছেলের হাতেই ধরা পড়লেন মা। টেনেহিঁচড়ে মাকে ঝোপ থেকে বার করল ছেলে। যাও এখুনি গিয়ে চিতায় ঝাঁপ দাও, ছেলের আদেশ। কান্নায় ভেঙে পড়েন মা। আবেদন জানান, ‘‘ওরে ছেড়ে দে আমায়! আমি আগুনে পুড়ে মরতে পারব না!’’ শেষপর্যন্ত ছেলে ও অন্যরা তাঁকে আষ্টেপৃষ্ঠে দড়ি দিয়ে বেঁধে ছুড়ে ফেললেন চিতার আগুনে। কিছু ক্ষণের মধ্যেই সব শেষ!

Advertisement

আজ ২০১৬ সালে এসে দাঁড়িয়ে আমরা দেখছি, উত্তরপ্রদেশে দাদরিতে গো-মাংস ভক্ষণের অভিযোগে মানুষ মানুষকে হত্যা করছে। মথুরায় জমি দখল নিয়ে মানুষ পুলিশকে হত্যা করছে। আবার বহু গ্রামে অনেক সময়ে বিনা অপরাধে পুলিশ হত্যা করছে মানুষকে। রাজস্থানে গো-মাংস রফতানি করার অভিযোগে এক মুসলিম যুবককে উলঙ্গ করে ‘কে বা কারা’ প্রথমে পেটান। তার পর সেই উলঙ্গ শরীরের উপরে সদলবলে ছবি তোলার অধিবেশন হয়। তার পর সেই ছবি ফেসবুকে পরিবেশিত হয়। সে দিন সতীদাহ নামক অপরাধটির সামাজিক বৈধতা দিয়েছিল কিছু গোঁড়া হিন্দু। আজ গো-হত্যাকে সামাজিক অপরাধ হিসাবে সর্বসম্মতি দেওয়ার তৎপরতা শুরু হয়েছে। অদ্ভুত ব্যাপার, পেশাগত কারণে কেউ যদি গো-মাংস রফতানি করার প্রতিবাদ করেন তবে তাঁকে বলব, যখন বেদে ব্রাহ্মণের গো-মাংস ভক্ষণের কথা লেখা হয়ে থাকে তখন তিনি কি সেই বেদকে পরিত্যাগ করতে রাজি? নাকি সেই বৈদিক যুগকে ইতিহাসের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে দেখাই কাম্য?

যাঁরা ব্যাধগীতা পড়েছেন তাঁরা জানেন, ধর্মব্যাধ মাংস বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। তথাপি তিনি কিন্তু প্রাজ্ঞ ব্যক্তি ছিলেন। তাঁর জীবিকা তার বিবেককে কলুষিত করেনি। মহর্ষি বেদব্যাসের লেখা মহাভারতের বনপর্বের অন্তর্গত এই ব্যাধগীতা। যেখানে ব্যাধ সৎ ব্রাহ্মণ বংশজাত। তত্ত্বজ্ঞানী। স্বামী বিবেকানন্দ এই ব্যাধের গল্প স্মরণ করে বলেছিলেন, এই ব্যাধগীতা বেদান্ত দর্শনের চূড়ান্ত ভাব। ব্যাধগীতায় সমস্ত অসহিষ্ণুতার মধ্যেও কর্তব্যের পথ দেখানো হয়েছে। আজ যখন গোটা সমাজ জুড়ে এই ভয়াবহ অসহিষ্ণুতা এক চূড়ান্ত জায়গায় এসে পৌঁছেছে তখন মনে রাখতে হয়, এই কুসংস্কার ও অসহিষ্ণুতার প্রতিবাদে সে সময়েও যেমন প্রতিবাদী কণ্ঠ উচ্চারিত হয়েছিল, আজও এই ভয়াবহ অসহিষ্ণুতার আবহের বিরুদ্ধে গড়ে উঠছে, গড়ে উঠবে চিন্তার ব্যারিকেড।

Advertisement

১৮৩২ সালে কলকাতায় প্রকাশিত ডি এল রিচার্ডসনের লেখা বই ‘দ্য ওরিয়েন্ট পার্ল’ প্রকাশিত হয়। সেখানে জব চার্নক সম্পর্কে কিংবদন্তির কথা বলা আছে। কথিত আছে পটনাবাসী লীলা নামে এক কিশোরী কাশীবাসী এক বাঙালি পণ্ডিতের বাগদত্তা ছিলেন। লীলার যখন ১৫ বছর বয়স, তখন কাশী থেকে ওই বৃদ্ধ পণ্ডিতের মৃত্যুসংবাদ আসে। সেই সঙ্গে আসে সহমরণের আদেশ। সে সময়ে জব চার্নক ওই নারীকে ছিনিয়ে নিয়ে এসে বিবাহ করেছিলেন। মাইক্রোসফ্ট-অ্যাপলের যুগে এখনও আমাদের জাতপাত ও ধর্ম নিয়ে হিংসার কথা লিখেই চলতে হচ্ছে। দুর্ভাগ্য আমাদের!

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement