বন্ধুত্ব উদ্‌যাপনের উৎসব ‘সহেলা’

সোশ্যাল মিডিয়ার মতো ‘আনফ্রেন্ড’ করার উপায় নেই এখানে। এখানে আমৃত্যু পালন করতে হয় প্রতিশ্রুতি রক্ষার দায়িত্ব। ভাল না লাগলেই যেমন ‘রক্তের সম্পর্ক’ ঝেড়ে ফেলা যায় না, তেমনই ঝেড়ে ফেলা যায় বন্ধুত্বের সম্পর্ক। ‘সহেলা’ অন্তত তাই শেখায়। এই উৎসবকে নিয়ে লিখছেন শিবপ্রসাদ চৌধুরীসমমনোভাবাপন্ন মানুষের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার প্রবণতা সহজাত। সেই কারণে আদি অনন্তকাল থেকেই মানুষ থেকেছে একত্রিত হয়ে। একসঙ্গে। কিন্তু সভ্যতা যত উন্নত হয়েছে, যত জটিল হয়েছে সমাজ ব্যবস্থা, এই সহজাত প্রবৃত্তির উপর তত বেশি চেপে বসেছে ঠুনকো রীতি-নীতি-প্রথা।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৮ অক্টোবর ২০১৯ ০২:৪৫
Share:

সহেলা’ পাতাচ্ছেন ইন্দাস পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি ফরিদা খাতুন এবং ইন্দাসের বিডিও মানসী ভদ্র চক্রবর্তী। ছবি: তারাশঙ্কর গুপ্ত

কখনও ওরা বকুলফুল, কখনও ভালবুলি। কখনও আবার ওদের নাম চোখের বালি। বাঙালি সমাজের এই সইয়েরা নানা ভাবে নানা সময়ে বঙ্গসাহিত্যে ফিরে ফিরে এসেছে। কিন্তু শুধু সাহিত্য-গল্পগাথা নয়, তার বাইরে যেখানে ওঁদের জলজ্যান্ত অবস্থান, সেখানেও ‘সই’ নামের মানববন্ধন রীতিমতো উদ্‌যাপনের বিষয়। বন্ধুত্ব উদ্‌যাপনের এমনই এক উৎসব হল ‘সহেলা’।

Advertisement

সমমনোভাবাপন্ন মানুষের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার প্রবণতা সহজাত। সেই কারণে আদি অনন্তকাল থেকেই মানুষ থেকেছে একত্রিত হয়ে। একসঙ্গে। কিন্তু সভ্যতা যত উন্নত হয়েছে, যত জটিল হয়েছে সমাজ ব্যবস্থা, এই সহজাত প্রবৃত্তির উপর তত বেশি চেপে বসেছে ঠুনকো রীতি-নীতি-প্রথা। বাদ সেধেছে ক্ষুদ্র স্বার্থ। স্বার্থচিন্তা মানুষকে সংকীর্ণ করে তুলেছে। মানুষে মানুষে দূরত্ব বাড়িয়েছে। বিভেদ সৃষ্টি করেছে, জাতের ভিত্তিতে, অর্থনৈতিক অবস্থার ভিত্তিতে।

এর বিপরীতে অবশ্য এমন মানুষও কালে কালে এসেছেন, যাঁরা এই সমস্ত বাধাকে সরিয়ে ফের মূলস্রোতে ফেরাতে চেয়েছেন সমাজকে। তাঁরা মানবতার পূজারি। বিভিন্ন ভাবে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে তাঁরা এই বিভাজন-বৈষম্যের অবসানের চেষ্টা করেছেন। একসময় যেমন হিন্দু ধর্মাবলম্বী মানুষের মধ্যে চরম বিপর্যয় নেমে এসেছিল। সে ছিল বিচ্ছেদের বিপর্যয়। তখন আবির্ভাব হয়েছিল শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর। সর্বধর্ম সমন্বয়ের কথা বলে সে সময় তিনি বঙ্গজীবনে কীর্তন গানের প্লাবন নিয়ে এলেন। মহামিলনের বার্তা দিলেন।

Advertisement

এই ভাবে নানা সময়ে বিভিন্ন রূপে বিভিন্ন ভাবে উদারবাদীদের আবির্ভাব ঘটেছে। প্রচলিত হয়েছে নানা প্রথা, নানা উৎসব। আর এই উৎসব-অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে মানুষ ফের অটুট বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার চেষ্টা করেছে। কখনও ভালোবাসা, কখনও ভালবুলি, বকুলফুল, বকুলকথা, মকর, কখনও মনের কথা প্রভৃতি নানা নতুন নতুন সম্পর্কের প্রচলন হয়েছে সমাজে। কোথাও সামান্য ফুল-মালা পরিয়ে, কোথাও একটি পান-সুপারি দিয়ে পালিত হয়েছে বিভেদ ঘোচানোর উৎসব।

জমিদার প্রথা চলাকালীন জমিদার এবং তাঁর ছাত্রছায়ায় যে সমস্ত কর্মচারী ছিলেন তাঁদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ অত্যাচারের ফলে সমাজের নানা স্তরে বিভেদ সৃষ্টি হয়েছিল। সেই সময়ে সমাজের চালিকাশক্তি যাঁরা ছিলেন সেই নিম্নশ্রেণির বর্গক্ষত্রিয়, প্রামাণিক বা ডোমেরা সে সময় বিভিন্ন ভাবে নিষ্পেষিত হতেন। এই ‘অন্ত্যজ’ জাতির মানুষের জায়গা হত না দূর্গামণ্ডপ, চণ্ডীমণ্ডপে। সেই কারণে তাঁরা তাঁদের আরাধ্যা মনসা দেবীকে গ্রামের ধারে, পুকুরপাড়ে বা ঘরে উঠোনে নিজেদের মতো করে পুজো করতেন। আর তেমন করেই কোনও সময় মনসা পূজার মধ্য দিয়ে নিজেদের মধ্যে বন্ধন অটুট করার উৎসব শুরু করেছেন ইন্দাসের মানুষ। পালিত হয়েছে ‘সহেলী’ বা ‘সহেলা’ বা চলতি কথায় ‘সয়লা’।

প্রতি তিন বছর, পাঁচ বছর বা বার বছর অন্তর আট থেকে আশি, ছেলে হোক বা মেয়ে, সকলেই এই ‘সহেলা’ উৎসবে একে অপরের সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতাতে শুরু করেছেন। এই বন্ধুত্বের সম্পর্কে থাকে না কোনও পোশাকী বাহুল্য, অর্থনৈতিক মাপকাঠি, জাতি-বর্ণের ভেদাভেদ। থাকে শুধু দু’টি মুক্ত মন আর আজন্ম সুখ-দুঃখ ভাগ করে নেওয়ার প্রতিশ্রুতি।

‘সহেলা’ উৎসবের প্রথা অনুযায়ী, উৎসবের প্রায় এক মাস আগে নিয়ম মতো ইন্দাস-সহ পার্শ্ববর্তী এলাকার প্রতিটি দেবমন্দিরে পাঠানো হয় ‘পান -সুপারি আর গোটা হলুদ’। এই প্রথার নাম ‘গোয়া দেওয়া’ বা ‘গোয়া চালানো’। শুধু দেবমন্দিরই নয়, তার সঙ্গে মনোমতো বন্ধুর খোঁজে নিজের গ্রাম বা পাশাপাশি গ্রাম থেকে দূর-দূরান্তের গ্রামের মানুষদেরও ‘পান, সুপারি আর হলুদ’ দিয়ে নিমন্ত্রণ করেন এখানকার মানুষ। তার পর মনসা পুজোর দিন হবু বন্ধুরা এলে শুরু হয় সই পাতানো।

মেয়েরা ডালা নিয়ে আসেন হাতে করে। এই ডালায় থাকে পান, সুপারি, হলুদ, খই, দই, বাতাসা, সিঁদুর, লাটাই প্রভৃতি সামগ্রী। এই মাঙ্গলিক সামগ্রী দিয়েই বন্ধুকে বরণ করা হয়। তার পর উচ্চারিত হয় বন্ধুত্বের শপথ মন্ত্র। ‘উপরে খই, নিচে দই, তুমি আমার জন্মের সই’। হয়ে যায় চিরকালের বন্ধুত্ব। এরপর যতদিন দুই বন্ধুর দেখা হয় তাঁরা একে অপরকে সম্বোধন করেন ‘সই’ বলে। সম্পর্ক থাকে আমৃত্যু। এই উৎসবে ছেলেরাও মালাবদল করে জন্মের জন্য বন্ধুত্ব পাতায়। ছেলেদের ক্ষেত্রে বন্ধু আখ্যায়িত হয় ‘স্যাঙাত’ নামে। তার পর হয় মিষ্টিমুখ। বাঁকুড়ার এই অঞ্চলে জিলিপিই প্রধান মিষ্টি। তা ছাড়া পাঁপড়, বারোভাজা তো থাকেই।

এই সহেলা উৎসবের সূচনাকাল সম্পর্কে সঠিক ধারণা করা যায় না। তবে উৎসবটি যে প্রাচীন সে সম্পর্কে আমরা নিশ্চিন্ত। বর্তমানে পূর্ব বর্ধমান, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, হুগলির কিয়দংশে এই মিলন উৎসব ‘সহেলা’ এখনও পালিত হয়।

বহু সাহিত্যেও এই সই-পাতানি উৎসবের উল্লেখ পাওয়া গিয়েছে। যেমন, লোক-সাহিত্যবিশারদ দীনেশচন্দ্র সেন-এর ‘পূর্ববঙ্গ গীতিকায়’ আমরা পড়ি “রূপবতী কন্যার সাথে রাজকন্যা পাতবা সহেলা।” এই “সই পাতানি” একসময় বঙ্গের অন্যতম সুন্দর উৎসব ছিল। শুধু মেয়েতে-মেয়েতে নয়, পুরুষে পুরুষেও সখ্য পাতানো হত। তাতে পরস্পরের সুখে দুঃখে আজীবন ভাগী হওয়ার প্রতিশ্রুতি গ্ৰহণ করা হত। বর্তমান সোশ্যাল মিডিয়া’য় থাকা ‘ফ্রেন্ড’-এর চেয়ে যে বন্ধুত্বের আয়ু অনেকগুণ বেশি।

লেখক ইন্দাসের সাহিত্যকর্মী

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement