প্রতীকী চিত্র।
সম্প্রতি ফাঁস হয়ে যাওয়া একটি ভিডিয়ো ফুটেজ ক্রীড়াজগৎকে হতভম্ভ করে দিয়েছিল। জাতীয় স্তরের প্রতিযোগিতায় পদক জয়ী বাংলার এক কিশোরী সাঁতারুকে পিতৃপ্রতিম প্রশিক্ষক যৌন হেনস্থা করছেন দেখে সবাই যার পর নাই লজ্জিত। দেশ জুড়ে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। ঘটনার গুরুত্ব বুঝে কেন্দ্রীয় ক্রীড়ামন্ত্রী হস্তক্ষেপ করেন, যাতে অভিযুক্ত প্রশিক্ষক উপযুক্ত শাস্তি পান। দীর্ঘদিন ধরে নির্যাতিত হতে হতে লজ্জায় অপমানে কুঁকড়ে থাকা কিশোরীটি প্রতিবাদের রাস্তা বেছে নেয়। ঘটনার ভিডিয়ো করে জনসমক্ষে আনে তারই কোচের প্রকৃত চেহারা!
তবে, ওই ভিডিয়ো না-থাকলে অভিযুক্তের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হত কিনা সন্দেহ। সংবাদমাধ্যমেই প্রকাশ, অতীতে একই অভিযোগ তাঁর বিরুদ্ধে উঠেছিল। কিন্তু প্রমাণাভাবে ব্যবস্থা নেওয়া যায়নি। সাঁতারু মেয়েটিকে কুর্নিশ! অকাট্য প্রমাণ জনসমক্ষে পেশ করবার সাহস দেখাতে পেরেছে সে। মনে আছে ‘কোনি’র সেই দৃশ্য? চূড়ান্ত উত্তেজনায় ‘খিদ্দা’ চিৎকার করছেন ‘‘ফাইট কোনি!...ফাইট!” কিন্তু জীবন তো আর সিনেমা নয়...। এই কিশোরী সাঁতারুর মতো আরও যে কত মেয়েকে কোচ বা কর্মকর্তাদের যৌন হেনস্থা সহ্য করে টিকে থাকার পরীক্ষা দিতে হচ্ছে বা কেরিয়ার শুরুর আগেই স্বপ্নভঙ্গের যন্ত্রণা নিয়ে সরে যেতে হচ্ছে, সেই পরিসংখ্যান আমাদের কাছে নেই। খেলার দুনিয়া বহু সফল মহিলা ক্রীড়াবিদকে পেলেও আশ্চর্যজনক ভাবে মহিলা প্রশিক্ষকের সংখ্যা বেশ কম (ভাবার বিষয়)। মেয়েদের কোচিং ক্যাম্পগুলিতে মহিলা কোচ থাকাই বাঞ্ছনীয়। না পেলে অন্তত সহকারী হিসেবে কোনও মহিলার উপস্থিতি বাধ্যতামূলক করা উচিত। প্রয়োজনে মহিলা নিরাপত্তারক্ষীও নিয়োগ করা যেতে পারে যাতে এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি না ঘটে। ক্রীড়াক্ষেত্রে সফল হতে শারীরিক সক্ষমতার সঙ্গে সঙ্গে অসাধারণ মনের জোরও প্রয়োজন। এ রকম ঘটনা এক জন উঠতি খেলোয়াড়ের মনোবল ভেঙে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট।
মেয়েদের কাজের ক্ষেত্র এখন অনেক প্রসারিত। ফলে পেশাগত প্রয়োজনে রাতবিরেতেও রাস্তায় চলাফেরা করবার প্রয়োজন হয়। রাতের শহরে ট্যাক্সি প্রত্যাখ্যান, অ্যাপ-ক্যাবে চালকের হাতে নিগ্রহ, অটো চালকের অভব্য আচরণ— এ সব আকছার ঘটে মেয়েদের সঙ্গে। সহযাত্রীর হাতে যৌন হেনস্থার শিকার মহিলা মান বাঁচাতে প্রাণ হাতে নিয়ে চলন্ত অটো থেকে ঝাঁপ দিচ্ছেন, এমন ঘটনারও সাক্ষী থেকেছে কলকাতা। পুলিশ-প্রশাসনও মেয়েদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ। পরিকাঠামোগত খামতি কিছুটা থাকলেও মূল কারণ কিন্তু সদিচ্ছার অভাব এবং মেয়েদের সম্পর্কে মনে পুষে রাখা মধ্যযুগীয় কিছু ধারণা। যে দু’একটি ক্ষেত্রে পুলিশি তৎপরতা চোখে পড়ে, সেখানে কোনও অদৃশ্য ক্ষমতাবানের হস্তক্ষেপ থাকে। ঘরে বাইরের চাপ সামলে মেয়েরা শারীরিক ও মানসিক ভাবে এতটাই বিধ্বস্ত হয়ে যায়, যে কর্মদক্ষতায় তার প্রভাব পড়ে। রাতের শহরে মহিলা পুলিশের সংখ্যা বাড়ালে এবং মেয়েদেরই অ্যাপ-ক্যাব বা ট্যাক্সি চালকের পেশায় উৎসাহিত করলে হয়তো কিছুটা সমাধান হতে পারে।
মোদ্দা কথা, পথেঘাটে মেয়েদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে আরও বেশি মেয়েকে পথে নামতে হবে— এ ছাড়া অন্য রাস্তা বোধহয় নেই।
ট্রেনের মহিলা নিত্যযাত্রীদের অবস্থা আরও করুণ। মহিলা কামরা প্রয়োজনের তুলনায় কম থাকায় এক রকম বাদুড় ঝোলা হয়ে তাদের যাতায়াত করতে হয়। শারীরবৃত্তীয় কারণে বিশেষ কিছু সময়ের বাড়তি অস্বস্তি মেয়েদের শারীরিক এবং মানসিক স্বাস্থ্যের উপরে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। ভাবুন, যে মহিলা লোকাল ট্রেনে কাটোয়া থেকে হাওড়া রোজ যাতায়াত করেন, শৌচালয় না থাকাটা তাঁর পক্ষে কতটা অস্বাচ্ছন্দের কারন হতে পারে! এ ছাড়াও রয়েছে পুরুষ সহযাত্রীদের একাংশের অসহযোগিতা এবং অভব্য আচরণ। প্রথমত, সবাই বিরক্তি প্রকাশ করেন ‘জেন্টস কামরায়’ ওঠার জন্য। মেয়েটি যতদূর সম্ভব সঙ্কুচিত হয়ে থাকে। স্বস্তিতে দাঁড়ানোরও উপায় থাকে না, ডেলি প্যাসেঞ্জার কিছু ‘দাদা’র তাস পেটানোর অসুবিধে হয় তাতে। এমনই ‘দাদা’রা আবার মেট্রোয় ভিড়ের হাত থেকে বাঁচার জন্য পুরুষ বন্ধুকে ধরে মেয়ে দাঁড়িয়ে থাকলে উত্তমমধ্যম দিয়ে তাদের সহবত শেখান। রাতের প্রায় ফাঁকা মহিলা কামরায় মদের আসর বসানোও তো এখন গা সওয়া ব্যাপার।
পার্কস্ট্রিটের সেই মহিলারর কথা মনে পড়ে? থানায় ধর্ষণের অভিযোগ জানাতে গেলে কর্তব্যরত পুলিশকর্মীরা যাঁর সঙ্গে অভব্য আচরণ করেছিলেন! ভোলা যায় বারাসতের রাজীব দাসের কথা... দিদির সম্ভ্রম বাঁচাতে দুষ্কৃতীদের হাতে যে নিহত হয়? তার দিদি সংসারের প্রয়োজনে চাকরি করতে যেত। মাত্র কয়েক পা দূরেই জেলাশাসকের বাংলো। কামদুনির মেয়েটি বাড়ির প্রথম কলেজে পড়া মেয়ে, মা-বাবার স্বপ্ন মেয়ে নিজের পায়ে দাঁড়াবে...একদিন সে আর ফিরল না কলেজ থেকে। তার দ্বিধাবিভক্ত দেহ পাওয়া গেল এক পরিত্যক্ত কারখানার পাঁচিলের ভিতরে।
সাধারণ ঘরের মেয়েদের বাড়ির চাপ সামলে তবে বাইরে বেরতে হয়, পড়াশুনো হোক বা চাকরী এর ব্যত্যয় হয় না। এরপর পথের অনিশ্চয়তাকে জয় করে তবে সে পৌঁছয় স্কুলে, কলেজে বা কর্মক্ষেত্রে। এই অবস্থায় বাড়ির অভিভাবকরা যদি অল্পবয়সেই মেয়েদের বিয়ে দিয়ে সংসারের ঘেরাটোপে বন্দী করে রাখা নিরাপদ বলে বোধ করেন তাঁদের খুব দোষ দেওয়া যায় কি? বাস্তব অভিজ্ঞতা বলছে পুলিশ প্রশাসন, রাজনৈতিক নেতা থেকে শুরু করে নীতিবাগীশ সমাজপতি, আক্রান্ত মেয়েদের বা তাদের পরিবারের পাশে শেষপর্যন্ত কেউই থাকে না। তাহলে কি একটি সাধারণ মেয়ে লেখাপড়া শিখে বা দূরন্ত সাঁতারু কিংবা জিমন্যাষ্ট হয়ে বিশ্বজয় করবার স্বপ্ন দেখবে না? নিশ্চই দেখবে! সেই স্বপ্ন সার্থক করতে ছোটো থেকেই মেয়েটিকে আত্মরক্ষার প্রশিক্ষণ দেওয়া জরুরি। এ প্রসঙ্গে দিল্লি হাইকোর্ট একটি নির্দেশনামায় বলেছে “As a preventive precautionary measure, start self-defense classes so as to arm and strengthen girls and ensure their self protection. This should include all techniques, exclusively taught to them on a priority basis.” এই নির্দেশ কার্যকরী করতে সরকারি এবং বেসরকারি সমস্ত স্কুলকে যথাযথ উদ্যোগ নিতে হবে। সুস্থ সবল শরীর কিন্তু মনের জোরও অনেকটা বাড়িয়ে দেয় ফলে অন্যায়ের সঙ্গে লড়বার সাহস পাবে মেয়েরা। সেই সঙ্গে তাদের মধ্যে জাগিয়ে তুলতে হবে আত্মমর্যাদা বোধ। এখানে বাড়ির এবং স্কুলের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মনুবাদী চিন্তা থেকে বেরিয়ে নিজের পরিচয়ে বাঁচতে শিখতে হবে প্রত্যেকটি মেয়েকে।
পরিশেষে বলা যায়, স্বাধীনতার প্রথম কথা শরীর ও মনের স্বাচ্ছন্দ্য। মেয়েদের জন্য পরিবার, সমাজ এবং প্রশাসন যতদিন সেটা নিশ্চিত না করতে পারছে ততদিন নারী স্বাধীনতা কথাটা নেহাতই কথার কথা হয়েই থাকবে।
লেখক সাহিত্যকর্মী, মতামত নিজস্ব