কেরলে চলছে বিক্ষোভ । ছবি: পিটিআই।
আদালতে মামলার নিষ্পত্তি হওয়ার পরে বিতর্কটা ধীরে ধীরে স্তিমিত হয়ে আসবে বলে ধরে নেওয়া গিয়েছিল। এ দেশে অনেকগুলো বহুচর্চিত তথা প্রলম্বিত বিবাদের মীমাংশাই আদালতের পথ ধরে এসেছে। আদালতের চূড়ান্ত রায় ঘোষিত হওয়ার পরে বিবাদে ইতিও পড়েছে। তাই শবরীমালা বিতর্কেও তেমনটাই আশা করা অস্বাভাবিক কিছু ছিল না। কিন্তু এখনও পর্যন্ত ঘটছে উল্টোটাই। বেশ বিরল এই পরিস্থিতির নেপথ্যে বেনজির রাজনৈতিক দায়িত্বজ্ঞানহীনতাও লক্ষ্য করা যাচ্ছে। দেশের সাংবিধানিক কাঠামোর পক্ষে এটা কোনও সুলক্ষণ কিন্তু নয়।
কেরলের শবরীমালা পাহাড়ে অবস্থিত আয়াপ্পা স্বামীর মন্দিরে সব বয়সের মহিলাই প্রবেশ করতে পারবেন— রায় ভারতের সর্বোচ্চ আদালতের। প্রবেশাধিকার সংক্রান্ত এই রায় আচমকা একদিনে আসেনি। দীর্ঘ টানাপড়েন, দীর্ঘ সংগ্রাম, দীর্ঘ আইনি যুদ্ধের ইতিহাস পিছনে ফেলে এই রায় সামনে এসেছে। সর্বোচ্চ আদালতের এই রায় দীর্ঘ টানাপড়েনে ইতি টানবে বলে হয়তো আমরা অনেকেই আশা করেছিলাম। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে আদালত আগুন নেভাতে পারেনি, বিবাদের শিখা লেলিহান হয়েছে বরং। আদালতের রায়কে হাতিয়ার করে গত কয়েকমাস ধরে বারবার মহিলা ভক্তরা আয়াপ্পার গর্ভগৃহে পৌঁছনোর চেষ্টা করেছেন, প্রতিবার বলপ্রয়োগ করে সেই চেষ্টা রুখে দিয়েছে এক তীব্র গোঁড়ামি তথা অন্ধত্ব। ২০১৯ সালের ২ জানুয়ারি অবশেষে বিন্দু ও কনকদুর্গা ইতিহাস গড়েছেন। কেরল প্রশাসনের তৎপরতায় এবং সহযোগিতায় তাঁরা আয়াপ্পার মন্দিরে প্রবেশ করেছেন। কিন্তু তাতে টানাপড়েনটা চিরতরে শেষ হয়ে গেল না। বরং অগ্নিতে ঘৃতাহুতি পড়ল যেন। প্রায় গোটা কেরল উত্তপ্ত হয়ে উঠল, রাজ্য জুড়ে অশান্তি-বিশৃঙ্খলা দেখা দিল, ভাঙচুর-আগুন-হিংসার ছবি ধরা পড়ল, রাজ্য জুড়ে পুলিশ ব্যাপক ধরপাকড়ে নামল। কিন্তু পরিস্থিতি সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রয়েছে বলে এখনও সম্ভবত মনে করছে না প্রশাসন। ঘটনাপ্রবাহ যে দিকে গড়াচ্ছে তাতে কেরল আরও উত্তপ্ত হবে বলে আশঙ্কা তৈরি হচ্ছে।
শীর্ষ আদালতের রায় ঘোষিত হওয়া মাত্রই কেরলে তার বিরোধিতা শুরু হয়েছিল। যাঁরা সুপ্রিম কোর্টের রায়ের বিরোধিতা শুরু করেছিলেন, বিস্ময়কর ভাবে বিজেপি প্রকাশ্যে তাঁদের সমর্থন দিতে শুরু করেছিল। দেশের শাসন ক্ষমতা যে দলটার হাতে, সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের এমন প্রকাশ্য বিরোধিতা সেই দল কী ভাবে করতে পারে, সাংবিধানিক নীতি-নৈতিকতার বোধ দিয়ে তা বোঝা সম্ভব নয়। সুপ্রিম কোর্টের রায় ঘোষিত হওয়ার অব্যবহিত পরে কেরলের রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে অস্বচ্ছতা তৈরি হয়েছিল। সুপ্রিম কোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে যেখানে যেখানে বিক্ষোভ হচ্ছিল, বিজেপি সেগুলোকে সমর্থন জানাচ্ছিল। কেরলের কংগ্রেসও সুপ্রিম কোর্টের রায়কে শিরোধার্য করার কথা বলছিল না। দেশের দক্ষিণ প্রান্তের রাজ্যটার বামপন্থী সরকার আদালতের রায় মেনে চলার কথা ঘোষণা করেছিল ঠিকই। কিন্তু মহিলা ভক্তদের আয়াপ্পার দরজায় পৌঁছে দিতে প্রশাসন সত্যিই কতটা তৎপর, তা নিয়ে সংশয় তৈরি হচ্ছিল। সরকার অবশেষে স্বচ্ছ অবস্থানের প্রমাণ দিল। প্রশাসনিক তৎপরতায় বিন্দু ও কনকদুর্গা ইতিহাস গড়লেন। কিন্তু পরিস্থিতির বৈপরীত্যটা দুর্ভাগ্যজনক। কেরলের প্রশাসন স্বচ্ছ অবস্থান নেওয়ার চেষ্টা করতেই গোটা কেরল আগুন হয়ে উঠল।
সম্পাদক অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা আপনার ইনবক্সে পেতে চান? সাবস্ক্রাইব করতে ক্লিক করুন
শুধুমাত্র রাজনৈতিক স্বার্থের কথা মাথায় রেখে এমন অসাংবিধানিক অবস্থান একটা স্বীকৃত রাজনৈতিক দল তথা দেশের প্রধান শাসক দল কী ভাবে নিতে পারে! এর ফলাফল কী হতে পারে, দেশের সাংবিধানিক কাঠামোয় কতটা আঘাত লাগতে পারে, আইনের শাসন কতটা দুর্বল হতে পারে সে কথা কি বিজেপি নেতৃত্ব বুঝতে পারছেন না? শীর্ষ আদালতের সুস্পষ্ট নির্দেশ সত্ত্বেও যে নৈরাজ্যের জন্ম আজ দেওয়া হচ্ছে কেরলে, সেই নৈরাজ্য যদি পরম্পরায় পরিণত হয়, তাহলে এই সুবিশাল দেশটাকে নিয়ন্ত্রণে রাখা যাবে তো? ভারতীয় গণতন্ত্রের কত বড় নৈতিক ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে শবরীমালা বিতর্কের আঁচে পুড়তে থাকা কেরলে, বিজেপি নেতারা যদি সে কথা উপলব্ধি করতে না পারেন, তাহলে সংবিধানের জন্য সঙ্কটকাল সূচিত হতে আর খুব দেরি নেই।
আরও পড়ুন: শবরীমালা ইস্যুতে ১২ ঘণ্টার বন্ধে উত্তাল কেরল, ইন্ধন দিচ্ছে বিজেপি, তোপ