রজার ফেডেরার এখনও ক্ষুধার্ত। তাঁহার সাম্প্রতিক অতিমানবিক সাফল্যে স্তম্ভিত হইয়া অনেকেই ভাবিয়াছেন, মানুষটি নিজেকে আর প্রণোদিত করেন কী করিয়া। তাঁহার বৈভবের শেষ নাই, পারিবারিক জীবন সুখী, প্রায় সর্বসম্মতিক্রমে তাঁহাকে পৃথিবীর সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ টেনিস খেলোয়াড়ের স্বীকৃতি দেওয়া হইয়াছে, কু়িড়টি গ্র্যান্ড স্ল্যাম তিনি জিতিয়া লইয়াছেন, এক জন মানুষের আর কী চাহিবার থাকিতে পারে। কথায় কথায় আমরা বলিয়া থাকি, মানুষের আকাঙ্ক্ষার শেষ নাই। কিন্তু ইহাও আমরা জানি, যাঁহারা ক্ষমতা বিত্ত খ্যাতির শীর্ষে অবস্থান করেন, তাঁহারা এক সময়ের পর নিজেকে ‘মোটিভেট’ করিতে পারেন না। কিন্তু ফেডেরার সাম্প্রতিক সাক্ষাৎকারেও বলিয়াছেন, তিনি কোনও খেলাতেই প্রথম রাউন্ডে হারিয়া বিদায় লইতে আসেন না। বলিয়াছেন, পূর্বের তুলনায় তাঁহার উপর চাপ কমিয়াছে, কিন্তু তাহার অর্থ ইহা নয় যে তিনি নিজেকে আরও এক বার প্রমাণ করিতে চাহেন না। মানুষ যে-কোনও ক্ষেত্রে তুঙ্গ স্পর্শ করিতে চাহিলে তাঁহাকে যেমন প্রতিভা অধ্যবসায় উদ্যম ইত্যাদি বহু উপাদানের সমন্বয় আয়ত্ত করিতে হয়, তাহার সহিত সতত নিজের কাজটির প্রতি নাছোড় ভালবাসাও লালন করিতে হয়। প্রতি দিন জিম-এ যাওয়া, ঝালহীন খাবার খাওয়া যদি বা সহজ, হৃদয়কে ফুটবল ভালবাসিতে বাধ্য করা সহজ নহে। কিন্তু মহান হইতে চাহিলে, ভালবাসাও অনুশীলন করিতে হয়।
শুনিলে বিস্ময় জাগে, কারণ ভালবাসাকে আমরা স্বতঃস্ফূর্ত আবেগ বলিয়া জানি এবং সেই কারণেই তাহাকে মূল্য দিই। কিন্তু ইহাও মনে রাখিতে হইবে, এক পর্যায়ের প্রবল আকাঙ্ক্ষার প্রেমিকও অন্য পর্যায়ে অভ্যাসসিদ্ধ স্বামী হইয়া যান, শিল্পী কর্মজীবনের প্রত্যুষে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করিবার নিমিত্ত যে তীব্রতায় ঝাঁপাইয়া পড়েন, তাঁহার খ্যাতি আন্তর্জাতিক স্তরে পৌঁছাইয়া যাইলে আর সেই আকুলতা বজায় থাকে না। মানুষ আসলে নিজেকে যাহা ভাবে, সে তেমন নহে। সে সার্বিক আনুকূল্য পাইলে তীক্ষ্ণতা হারাইয়া ফেলে। তাহার প্রতিকূলতা প্রয়োজন, যাহাকে অতিক্রম করিবার জন্য সে কোমর বাঁধিয়া লাগিবে। যখন এক সুইটজারল্যান্ডের খেলোয়াড় বুঝিয়া ফেলেন, অজানা দেশের অচেনা কিশোরও তাঁহার পোস্টার দেওয়ালে টাঙাইতেছে এবং তাঁহার জীবন ও কীর্তি দ্বারা অনুপ্রাণিত হইতেছে, তখন এক অসামান্য তুষ্টি আসিয়া তাঁহাকে ঘিরিয়া ধরে। সেই তুষ্টি বহু সময়েই তাঁহাকে গ্রাস করিয়া, পরিপাক করিয়া, তাঁহার একটি ছায়াকে উগরাইয়া দেয়। আত্মসন্তুষ্ট মানুষ তখন আর পূর্বের জেদ লইয়া, নিজেকে প্রমাণ করিবার তাগিদ লইয়া সার্ভিস করিতে পারেন না, বা গান লিখিতে পারেন না।
কিন্তু যাঁহারা জিনিয়াসের জিনিয়াস, তাঁহারা কেবল বয়সের সহিত, সমালোচনার সহিত লড়েন না, অত্যন্ত সচেতন ভাবে এই আত্মসন্তুষ্টির সহিত সমধিক লড়েন, নিরন্তর নিজ কাজের প্রতি ভালবাসা পুনর্নবীকরণের প্রক্রিয়া প্রস্তুত করিয়া লন। নোবেল পাইবার পরেও রবীন্দ্রনাথের শিল্পে নূতন দিগন্ত আবিষ্কারের প্রেরণা কমে না, একশত শতরান করিবার পরেও সচিন তেন্ডুলকর খেলাকে বিদায় দিবার লগ্নে ভাঙিয়া পড়েন। সম্ভবত এই মানুষগুলি নিজ কাজে ব্যাপৃত হইবামাত্র, নিজেদের তৈলচিত্রগুলি সম্পূর্ণ ভুলিয়া যান। হৃদয় হইতে ট্রফি, শংসাপত্র, সংবাদপত্র-শিরোনামগুলির ছাপ সরাইয়া ফেলিতে সক্ষম হন। ক্রিজে আসিয়া, বা কাগজের সম্মুখে বসিয়া, তাঁহার হইয়া পড়েন নবিশ-কালের ন্যায় উন্মুখ, বিস্মিত, শিখরকামী। ইহার জন্য তাঁহারা শিখিয়া লন কেবল বর্তমানে বিহার করিবার হৃদয়বত্তা। কারণ অতীত-গরিমা দ্বারা এক বার পিষ্ট হইতে শুরু করিলে, তাঁহারা আর উঠিয়া দাঁড়াইতে পারিবেন না। তাই তাঁহাদের মনে মনে নিরন্তর ওই প্রাপ্তিগুলিকে উপেক্ষা করিতে শিখিতে হয়। পিকাসোর এক সঙ্গিনী বলিয়াছেন, কোনও সভায় পিকাসোকে সর্বশ্রেষ্ঠ শিল্পী বলিয়া উদ্যোক্তারা পরিচয় করাইলে, শিল্পী রসিকতার ছলে বান্ধবীকে ঠেলিতেন, অর্থাৎ, লোকগুলি নির্বোধের ন্যায় কথা বলিতেছে। তাহার অর্থ কি, পিকাসো নিজ শ্রেষ্ঠত্বে বিশ্বাস করিতেন না? অবশ্যই করিতেন, কিন্তু একই সঙ্গে তাহাকে লঘু ভাবেও লইতে পারিতেন। সামান্য মানুষের ফেসবুক-অহং’এর প্লাবনে যখন বিশ্ব ভাসিয়া যাইতেছে, তখন নিরন্তর নিজের মূর্তি নিজে ভাঙিবার এই মহান চর্যার প্রতি কিঞ্চিৎ মনোযোগ ও শ্রদ্ধা ধাবিত হইলে, সমাজের মঙ্গল।
যৎকিঞ্চিৎ
দুধ ঢেলে মূর্তি ‘শুদ্ধ’ করা হচ্ছে। কিন্তু দুধ ঢাললে হঠাৎ মূর্তি শুদ্ধ হবে কেন? শিবরাত্রির হ্যাংওভার? আসলে, দুধ এখানে পঞ্চগব্য-র প্রতিনিধি। পঞ্চগব্য: দই, দুধ, ঘি, গোমূত্র, গোময়। তা হলে তো মূর্তি-শুদ্ধি অসম্পূর্ণ, চারটে উপাদান বাদ! ফাঁকিবাজি ছেড়ে, দুধের সঙ্গে ঘি ও দই কিনতে হবে, তার পর গোবর ও গোমূত্র সংগ্রহ করে, সবটা গুলে লেই তৈরি করে, মহাপুরুষকে মাখাতে হবে। অবশ্য তার পর দুর্গন্ধ দূর করার জন্য পারফিউম ছড়াতে হবে কি না, শাস্ত্রে লেখেনি।