‘দোহাই আলি!’ কাঁদছে দেশ

আজ দেশ জুড়ে অশ্রু আর আগুনের বিস্তারে, কেন জানি না, বড় মনে পড়ে ঋত্বিক ঘটকের কোমল গান্ধার (১৯৬১) ছবির সেই বিখ্যাত বাফার শট।

Advertisement

সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০৩ জানুয়ারি ২০২০ ০০:০২
Share:

‘কোমল গান্ধার’ ছবির সেই বিখ্যাত বাফার শট।

আজ দেশ জুড়ে অশ্রু আর আগুনের বিস্তারে, কেন জানি না, বড় মনে পড়ে ঋত্বিক ঘটকের কোমল গান্ধার (১৯৬১) ছবির সেই বিখ্যাত বাফার শট। কী মর্মান্তিক সেই বিয়োগ গাথা! দেশবিভাগের ফলে পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে রয়েছে রেললাইন, কিন্তু ওয়াইড অ্যাঙ্গল-এ এই ট্র্যাকিং শট যেন অনন্তযাত্রা কোনও ভারতপথিকের। ভৃগু ও অনসূয়া স্থির, তবু পরিবেশের গুল্মলতা অবিরত আর্তনাদ করে চলেছে, তারা কাঁদছে, আর আকাশে বাতাসে রোদনের স্বর: ‘দোহাই আলি!’

Advertisement

এই একটি দৃশ্যে যেখানে পরিত্রাণহীন বিয়োগচিহ্ন, সেখানে ঋত্বিক তপোবন-বিচ্ছিন্না শকুন্তলাকে খুঁজে পান হাহাকারে। রবীন্দ্রনাথকে উদ্ধৃত করলে বলা যায়, ‘ইহা সমস্ত তপোবনভূমির ক্রন্দন’। শব্দপথে যে ‘দোহাই আলি’ আছড়ে পড়ে তা তো হতদরিদ্র অতিসামান্য মুসলমান জেলের সেই গানটি, যা একদা তার আনন্দক্রীড়ার সঙ্গী ছিল। এখন সে গান সর্বশক্তিমানের কাছে আকুল মিনতি: দোহাই আল্লা, এমন সর্বনাশ যেন না হয়! তবু ইতিহাসে নিষ্ঠুরতা আঘাত হানে। পর্দায় ধ্বংসের অকূল তিমির। খেয়াল করার যে, ঋত্বিক কিন্তু শুধু উদ্বাস্তুর কথা বলেননি। এই সর্বনাশ মুদ্রিত করে রাখে মুসলমান জনসমষ্টির থরথর আবেগ। দৃশ্যপর্যায়টি জরুরি দার্শনিক দিক থেকে। শতবর্ষে রবীন্দ্রনাথের ‘শকুন্তলা’ প্রবন্ধটির সাহায্য নিয়ে ঋত্বিক স্বদেশের গহন মানচিত্র আঁকেন, যেখানে— ‘টেম্পেস্ট’ নাটকের বিপরীতে— প্রকৃতি শুধু আখ্যানের পক্ষেই নয়, চরিত্রের পক্ষেও অত্যাবশ্যক। উদ্বাস্তুর গমনপথ তাই শকুন্তলার পতিগৃহে যাত্রা। আর হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষেই এই যাত্রা করুণ, সজল। ঋত্বিকের সাঙ্গীতিক নিসর্গ আইজ়েনস্টাইন কথিত এক ‘নন-ইনডিফারেন্ট নেচার’, যা এই উপমহাদেশের চরিত্রলক্ষণ। প্রাচ্যে নিসর্গ মানুষের সম্প্রসারণ। শকুন্তলার চ্যুতি মিরান্দার চাইতে অনেক অভিশপ্ত। এই রহস্য না জানা থাকলে বাজার-চালু হিন্দু রিফিউজি বনাম মুসলমান উদ্বাস্তুর চোরাবালিতে বাঙালি বুদ্ধিজীবীর মেধা ডুবে যাবেই।

রামায়ণ বা মহাভারতের উপাদান ব্যবহার করলেও সুবর্ণরেখা (’৬২) বা মেঘে ঢাকা তারা (’৬০), এমনকি যুক্তি তক্কো আর গপ্পো (’৭৪) এতই মৌখিক লোক-আখ্যানের ট্যাপেস্ট্রি যে, ঔপনিবেশিকতার আড়ালে হারিয়ে যাওয়া কোনও গহন ধারাকে মুক্ত করা তাঁর অভিপ্রেত। ঋত্বিক ‘হিন্দুত্ব’-কে সম্মুখবর্তী করেন না, ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের সাম্রাজ্যে অন্তর্ঘাত চালান। সুবর্ণরেখায় রেল স্টেশনে যখন অভিরাম মরণোন্মুখ হতভাগিনীর মুখে মায়ের পরিচয়পত্র খুঁজে পায়, আমাদের যাবতীয় সংস্কারে বিস্ফোরণ ঘটে। এই মা প্রকৃতই কৌশল্যা— ইক্ষ্বাকুবংশীয়া অসূর্যম্পশ্যা রাজমাতা নন, বাগদি বৌ। প্ল্যাটফর্মে যে ছেলেকে আর্তনাদ করতে দেখি সে-ও উচ্চবর্গীয় হিন্দু নয়, নিচু তলার দলিত। সুবর্ণরেখার পাশ দিয়ে অশৌচজনিত পোশাকে যখন সে কনেবেশী সীতাকে সঙ্গী করে নেয়, বিবাহ রজনীর সানাইকে সাক্ষী রেখে এক ‘অন্দর’ ইতিহাসের প্ররোচনায় ঋত্বিক নায়কের সিংহাসনে অন্ত্যজকে বরণ করে নিচ্ছেন। ষাট দশকের মার্ক্সবাদচর্চায় শ্রেণিসংগ্রামের গুরুত্ব মাথায় রেখেও জাতপাতের এই রাজনৈতিক অন্তর্দৃষ্টি এত বেশি বৈপ্লবিক যে শব্দপথের ক্যাকোফোনি এসে বর্ণাশ্রমের পলকা পাঁচিল ভেঙে দেয়। ‘যুক্তি তক্কো’-তে যখন ছো নাচের গ্রাম্য মুখোশশিল্পী চণ্ডীর মূল স্তোত্রকে প্রশ্ন করে, “মায়ের আবার অং বং কী হে?” তখন বুঝি এক জন শিল্পীর নাশকতা কত দূর প্রসারিত হয়ে আমাদের আধিপত্যবাদী প্রবণতাকে উপহাস করতে পারে। স্থানীয় দুর্ঘটনাকে গাঁধীপ্রয়াণের জাতীয় রাজনীতির সঙ্গে মুহূর্তে যোগ করে অতিকথায় যদুবংশ ধ্বংসের ইতিবৃত্ত ছুঁয়ে বেশ্যালয়ে ‘হে রাম’ কে বলেছিল? সীতার অগ্নিপরীক্ষা নিয়ে এত অভিসম্পাত শুনতে পাবে, আমাদের পুং-প্রজাতি কখনও ভেবেছিল? ঋত্বিকের নীতা উমা হয়ে ব্যর্থ কুমারসম্ভবের রাত্রি গোনে, সীতা, জনকনন্দিনী, জানতই না আরও অনেক দিন উন্নাও বা হায়দরাবাদে সর্বনাশের মধ্যরাতে তাকে দেখতে হবে নিয়তি অপেক্ষমাণ: ঈশ্বর।

Advertisement

একটি রাজনৈতিক দল তাঁর ছবির অংশ ব্যবহার করে হিন্দু বাস্তুহারাদের দুর্গতি বর্ণনার জন্য একটি স্বল্পদৈর্ঘ্যের ছবি বানাবে, এমন সংবাদ পড়ে মনে হল ১৯৬৪ সালে দাঙ্গা-পরবর্তী সময়ে একটি শারদীয় পত্রিকা তাঁকে ‘বাংলা: ১৯৬৪’ এই নামে একটি তথ্যচিত্র তুললে কী ভাবে বানাবেন সে বিষয়ে কিছু লিখতে অনুরোধ জানায়। ঋত্বিক সেই অনুরোধ রাখতে না পারার কৈফিয়ত হিসেবে লেখেন, “আজকে বাংলাদেশে আমরা গুন্ডামি করি, আমরা ধর্মবিদ্বেষ প্রচার করি; এত বছরের আন্দোলন এইখানে এসে পর্যবসিত হচ্ছে, এ যে কত বড় মর্মান্তিক ব্যাপার তা ভাবতে আমার কষ্ট লাগে। এই বাংলা দেশের তথ্যচিত্র যদি আমাকে তুলতে বলা হয়, আমি তুলবোই না মশাই। দেশটি ক্রমশই ইতরের দেশ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। আর কোনও সৎ শিল্পীরই নিজের দেশকে ইতর বলে দেখানো উচিত না। ব্যাপারটা অধার্মিক।’’

একদা সিন্ধুনদ গতিপথ পরিবর্তন করায় আমাদের ঠিকানা পাল্টায়। গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র, নর্মদা ও কাবেরী অধ্যুষিত এই দেশে মানুষের ছন্নছাড়া বাসস্থান তিনি দেখেছিলেন। এক বারই তিনি মুক্ত বাংলাদেশে ছবি করার সুযোগ পান, তখনও এই স্থানচ্যুতির ভাবনা তাঁকে ‘তিতাস’ পর্যন্ত টেনে নিয়ে যায়। মানুষের জন্য কোনও বাসভূমি তিনি রেখে যেতে চেয়েছিলেন আজীবন।

ঋত্বিক জানতেন যখন ঘর ভাঙে, গ্রামপতনের শব্দ হয়, তখন তার ফলে সেই ছিন্নমূল মানুষের কাছে আতঙ্কের হল দু’টি স্মৃতির মধ্যবর্তী শূন্যতার পরিসর। যে মানুষ উন্মাদ, যার কোনও শিকড় নেই, প্রলয়ের পরে তার সাংস্কৃতিক ঠিকানা কী হবে? নিথর শবদেহের ব্যবচ্ছেদ করা শিল্পীর কাজ নয়। ঋত্বিক প্রকৃত শিল্পী ছিলেন বলেই জানতেন, এই দেশ জননীকে স্নেহচ্ছলে বলে, ‘আয় গো উমা কোলে লই’, এই দেশ ক্ষুধায় সর্বস্ব হারিয়ে বিলাপ করে, ‘নামাজ আমার হইল না আদায়’! ‘বীভৎস মজা’ যারা দেখে তারা না হিন্দু না মুসলমান, তারা আসমুদ্রহিমাচলের কেউ না। তাঁর শেষ ছবির শেষ মুহূর্তে তিনি ভোরের আলোয় সত্যের মুখ দেখতে চেয়েছিলেন। এই সঙ্কটের দিনে তাঁর দেশবাসী এই সামান্য প্রার্থনাটুকু মঞ্জুর করবে না?

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement