বর্তমান রাজ্য প্রশাসনের নানা দিক নিয়ে সঙ্গত সমালোচনা থাকতে পারে। কিন্তু গত সাত বছরে শিক্ষার প্রসার অনস্বীকার্য। শিক্ষার প্রসার শিক্ষাক্ষেত্রে সংঘাত এনেছে। অন্তত, এটুকু আশা করা যায় যে, যে সব সমস্যা থেকে সংঘাতের সৃষ্টি, সেই সব সমস্যার আংশিক হলেও কিছু সমাধান করে শিক্ষার প্রসার অব্যাহত থাকবে।
উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে নানা ধরনের সংঘাতের কথা আমরা জানি। একই সঙ্গে উচ্চশিক্ষার প্রসারও আমাদের নজরে পড়ার কথা। ২০১০-১১ সালে শিক্ষাক্ষেত্রে যোজনা ব্যয় হয়েছিল ১০৮ কোটি ৭০ লক্ষ টাকা; ২০১৭-১৮’তে সেই ব্যয়ের পরিমাণ হয়েছে ৫১৪ কোটি ২০ লক্ষ টাকা। একই সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ১২ থেকে বেড়ে দাঁড়ায় ৩৪। যার মধ্যে ২২টি সরকারি উদ্যোগে, ১২টি বেসরকারি উদ্যোগে। এবং ওই একই সময় কলেজে প্রবেশ করা ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ১৩ লক্ষ ২৪ হাজার থেকে বেড়ে দাঁড়ায় ২১ লক্ষ ১৫ হাজার। ভর্তির হার বেড়ে যায় ১২.৪ শতাংশ থেকে ১৮.৫ শতাংশে। উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বাড়ে ৮৫৫ থেকে ১৮৪৯-তে। শুনেছি আরও ৫টি বিশ্ববিদ্যালয় শীঘ্র শুরু হবে।
নতুন সরকারি কলেজ আরও ৩১টি তৈরি হয়েছে; ১৬টি সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত কলেজও নতুন প্রতিষ্ঠিত। শিক্ষক এবং শিক্ষাকর্মী সংখ্যাও বেড়েছে, তার কারণ মোট ২৮১৬টি নতুন শিক্ষকশিক্ষিকা এবং শিক্ষাকর্মী পদের সৃষ্টি হয়েছে। এবং সহকারী অধ্যাপকরাও নিযুক্ত হয়েছেন বহু পড়ে থাকা ফাঁকা পদে। এই সংখ্যাও কম নয়, ৫৯৩১। ২০১৭-১৮’য় ৪৭টি নতুন কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। দার্জিলিং, দক্ষিণ দিনাজপুর, আলিপুরদুয়ার এবং মুর্শিদাবাদে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হবে। শিক্ষাশিক্ষণ কলেজের সংখ্যা ৫০।
এর অর্থ এই নয় যে উচ্চশিক্ষার এই প্রসারে সন্তুষ্ট হওয়া যায়। ১৯৭৭ সালে কংগ্রেস শাসনের অবসানের পর বামফ্রন্ট শাসনের প্রথম যুগে শিক্ষার অগ্রগতি যেমন চোখে পড়ার মতো ছিল, ২০১১-র পরে এই প্রসারও নজরে পড়ার মতো। কিন্তু সারা দেশের বিচারে কিছু প্রদেশ পশ্চিমবঙ্গের চেয়ে এগিয়ে আছে। এবং এই সব প্রদেশ এগিয়ে আছে উচ্চশিক্ষার প্রসারের নানা মাপকাঠিতে, একটি মাত্র সূচকে নয়। তাই এ রাজ্যে উচ্চশিক্ষার প্রাতিষ্ঠানিক অগ্রগতি শিক্ষা ক্ষেত্রে সুফল আনছে বলে আত্মতৃপ্তির উদ্রেক না হলেই ভাল। অবশ্য অনেকে মনে করেন ‘উচ্চশিক্ষা’ বলে কিছু হয় না, ওটা সোনার পাথরবাটি। এই ধারণা ভ্রান্ত প্রমাণিত হলে উচ্চশিক্ষার মঙ্গল, গণশিক্ষার তো বটেই।
সে দিক দিয়ে উচ্চশিক্ষা প্রসারে ন্যূনতম আরও কিছু করার আছে। যেমন তফসিলি জাতির ছাত্রছাত্রীদের ভর্তির হার মোট ভর্তির ১১.১ শতাংশ ছিল ২০১৩-১৪’য় এবং তফসিলি জনজাতির ক্ষেত্রে এই সংখ্যা ছিল মাত্র ৮ শতাংশ। কিছু উন্নতি পরবর্তী চার বছরে হলেও এখনও অনেক পথ বাকি। ২০১৭’য় পশ্চিমবঙ্গে উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রে স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ছিল ১৭; ওই একই বছরে তামিলনাড়ুর ক্ষেত্রে এই সংখ্যা ছিল ১৮১, এবং তেলঙ্গানায় ৫৭। স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা কেন বাড়ল না এই রাজ্যে? এর জন্য দায়িত্ব বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের না আমাদের ধীর গতির, তা একমাত্র ত্রিকালজ্ঞই বলতে পারবেন। অথচ ২০০৪ সালে পবিত্র সরকারের নেতৃত্বে তৈরি রিপোর্ট উল্লেখ করেছিল যে মান নির্ধারণের ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গ প্রথমে অগ্রণী ভূমিকা নিলেও পরে পিছিয়ে পড়ে। এবং প্রাদেশিক স্তরে মান নির্ধারণের জন্য পরিকল্পনা থাকলেও তা বাস্তবায়িত হয়নি।
সব মিলিয়ে সংক্ষেপে বলা যায়, কাজ হয়েছে বেশ, কিন্তু করার অনেক কিছু বাকি। উচ্চশিক্ষায় ভর্তির হারে পশ্চিমবঙ্গ ভারতের প্রথম পাঁচটি প্রদেশের মধ্যে। কিন্তু নানা বিষয়ে ঘাটতি রয়েছে। প্রতিষ্ঠান আছে তো শিক্ষক-শিক্ষিকা কম। প্রশাসনিক পদ ফাঁকা পড়ে আছে। অন্যান্য সরঞ্জামের অভাব আছে। এ সব দিক দিয়ে অনেক কাজ করার রয়েছে। শিক্ষার প্রাতিষ্ঠানিক প্রসার এবং উপযুক্ত পরিকাঠামো— এই দুইয়ের মেলবন্ধনে সময় লাগবে। তবে এটুকু বলতেই হবে, উচ্চশিক্ষা প্রসারের জন্য জমি তৈরি হয়েছে।
উচ্চশিক্ষার এই প্রসার পশ্চিমবঙ্গে একা আসেনি। এত দিন দেশে কেন্দ্রীয় শিক্ষানীতির পরিণামে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষাকে দুয়োরানি করে উচ্চশিক্ষা মর্যাদা পেত। অন্য কিছু প্রদেশের মতো আমাদের প্রদেশেও এই দশকে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার প্রসার হয়েছে। যদিও বিদ্যালয় আরও অনেক গড়া উচিত ছিল। ২০১০-১১’য় বিদ্যালয়ের সংখ্যা ছিল ৫৯,৯৪৬; ২০১৭-১৮’য় ৬৪,০৮১। কিন্তু প্রাথমিক বিদ্যালয় অনুপাতে বেশি। ২০০৪-০৫ সাল থেকে ২০১০-১১’য় নতুন প্রাথমিক বিদ্যালয় হয়েছিল ২৪টি; ২০১৭-১৮’য় ওই সংখ্যা হয় ৮৫১। এই লেখা অবশ্য প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক শিক্ষার প্রসার সম্পর্কে নয়। তাই শুধু এইটুকু উল্লেখ যথেষ্ট যে, উচ্চশিক্ষার প্রসার শিক্ষার সাধারণ প্রসারের অংশ হিসেবে এসেছে। প্রত্যন্ত জেলায়, মফস্সলে কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, স্কুল— এই সবের প্রসারে সংখ্যালঘু, নিম্নবর্ণ, দলিত, আদিবাসী এবং গ্রাম ও জেলার অনেক নতুন মানুষ শিক্ষাঙ্গনে প্রবেশ করতে পেরেছেন।
অবশ্য বিলাপও রয়েছে শিক্ষিত শ্রেণির মধ্যে, যে এই ভাবে উচ্চশিক্ষার গণপ্রসার ঠিক হচ্ছে না, দলবাজি হচ্ছে, পরিকাঠামো উন্নতি আগে হোক ইত্যাদি। কাজেই শিক্ষার প্রসার যে স্বাভাবিক সাধুবাদ পাচ্ছে, তা নয়। এই সব সমালোচনায় কিছু সত্য আছে। কিন্তু নীচের মহলের জনসাধারণের শিক্ষা পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা দুর্বার। কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, স্কুল, সর্বত্র ঢেউ আছড়ে পড়ছে: প্রবেশাধিকার চাই। জনপ্রিয়তাবাদী সরকার যে পথে পারে, বা যেটুকু তারা ভাবতে পারে, তা করছে। ভাল-মন্দ মিশিয়ে প্রবেশাধিকারের প্রসারে এই সরকার সাহায্য করেছে। স্বভাবত শিক্ষিত শ্রেণির অধিকাংশ লোকজন, যাঁরা নিজেদের প্রাতিষ্ঠানিক দুর্গের গৌরব এবং স্বাজাত্য গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন তাঁরা এই গণচাপে শঙ্কিত, সরকারি নীতিতে বিরক্ত।
শিক্ষার প্রসারজনিত সমস্যা এবং সংঘাত নিয়ে আলাপ-আলোচনা খুব কম। সরকারও এক এক নীতি এত সহসা নেয় যে শিক্ষিত শ্রেণির স্পর্শকাতরতার কথা তারা খেয়ালে রাখে না। ফলে সমালোচনার ঢেউ ওঠে। এক দিকে শিক্ষার উচ্চাঙ্গনে প্রবেশের ব্যাপক আকাঙ্ক্ষা এবং চাপ, অন্য দিকে উচ্চশিক্ষিতদের নিজস্ব দুর্গ সামলানোর নিরন্তর প্রয়াস। আলাপচারী শিক্ষা নীতি অনুসরণ ছাড়া এ সংঘাত থেকে নিস্তার নেই। (চলবে)
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, মহানির্বাণ ক্যালকাটা রিসার্চ গ্রুপ