বইয়ের মাঝে অতনু বর্মণ। ফাইল চিত্র
ছড়া কিংবা নাটক যাই হোক না কেন, সবেতেই ছন্দ খোঁজেন অতনু বর্মণ। কারণ ছন্দেই তিনি যেন খুঁজে পান জীবনের আনন্দ। আদতে স্কুল শিক্ষক বছর পঞ্চান্নর অতনু বাবুর শিল্প-সাহিত্য এবং সংস্কৃতির অঙ্গনে অবাধ বিচরণ। নাটক থেকে চলচ্চিত্র, ছড়া থেকে গল্প প্রতিটি ক্ষেত্রে পরিচিত নাম হয়ে উঠেছেন তিনি।
আমোদপুরের বাসিন্দা অতনুবাবুর ডাক নাম বাবুন। ছোট থেকেই মানুষ হয়েছেন সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে। কিন্তু ক্রিকেট-ফুটবল খেলা থেকে শুরু করে চাঁদা তুলে সরস্বতী পুজো করা, সবেতেই তার সমান উৎসাহ ছিল। বাবা সুখরঞ্জন বর্মণ ছিলেন ব্লক কর্মী। মা পারুল বর্মণ প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে আমোদপুর জয়দুর্গা হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষিকা ছিলেন। পাশাপাশি জেলা প্রাথমিক স্কুল বোর্ডের চেয়ারম্যানের দায়িত্বও সামলেছেন। তিন ভাইবোনের বড় অতনুবাবু আমোদপুরের মৃত্যুঞ্জয় প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পড়াশোনার পর জয়দুর্গা হাইস্কুল থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেন। তারপর হেতমপুর কলেজ থেকে বাংলায় স্নাতক এবং রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। বর্তমানে সাঁইথিয়া হাইস্কুলে শিক্ষকতার সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন।
অতনুবাবুর সংস্কৃতি চর্চার হাতেখড়ি স্কুলবেলা থেকে। মামার বাড়ির প্রভাবই তাঁকে সব থেকে বেশি অনুপ্রাণিত করে। তাঁর এক মামা স্বরোজ কুমার রায়চৌধুরী ছিলেন উপন্যাসিক। আর এক মামা প্রদ্যুৎ কুমার রায়চৌধুরী নাটক লেখালিখির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। অভিনয়ের পাশাপাশি নাটক মঞ্চস্থ করতেন। তাঁর নিজস্ব একটি প্রকাশনা সংস্থা ছিল। সেখান থেকেই প্রকাশিত হয় অতনুবাবুর প্রথম কবিতার বই ‘অঙ্কুর’। তখন তিনি ছিলেন পঞ্চম শ্রেনির ছাত্র। মায়েরও লেখালিখির হাত ছিল। ঘরেবাইরে পত্রিকায় নিয়মিত ছোট গল্প লিখতেন।
বালক অতনুর পাঠানো প্রথম ছড়া গুরুত্ব সহকারে প্রকাশিত হয় সন্দেশ পত্রিকায়। উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর আঁকা সন্দেশ লোগোর পাশে। তারপরেও বার কয়েক একই জায়গায় ছাপা হয় তাঁর ছড়া। একই সঙ্গে সমান তালে নাটক, কবিতা, ছড়া, গল্প, প্রবন্ধ সব কিছুই লেখালিখি করেছেন। ছড়ায় বিভিন্ন মনীষীদের জীবনকাহিনী লিখে পাঠক মহলে সাড়া ফেলে দিয়েছেন। তাঁর ‘কহেন কবি কালিদাস’,‘অরূপকথা’, ‘নাসিরুদ্দিন মোল্লা’ ‘ তৃতীয় প্রকৃতি ’ ‘শব্দ নৈশব্দ’ ‘ ছায়া মানবী’, ‘ গোবিন্দ গো গোবিন্দ ’ নাটক নাট্যমহলে সমাদৃত হয়েছে। তাঁর প্রকাশিত ‘ছড়াশঙ্কর’, ‘খুড়ো হে ঘরকে চলো’, ‘নাটুকে ছড়া’, ‘খোলা হাওয়া’, ‘অঙ্কুর’, ‘ছড়াতে নজরুল’, ‘বইবাহিত’, ‘দুজনে মুখোমুখি’ প্রভৃতি বইও পাঠকদের প্রশংসা অর্জন করেছে।
লেখালিখির পাশাপাশি ছাত্রাবস্থা থেকেই অভিনয়ের নেশা রয়েছে তাঁর। ছোটবেলায় মায়ের সাথে করেছেন ‘কর্ণ-কুন্তী-সংবাদ’। দুই বোন পাপিয়া এবং পাপড়ি-সহ পাড়ার ছেলেমেয়েদের জুটিয়ে নিজের লেখা ছোট ছোট নাটক পরিবেশন করেছেন। বালক কালের সেসব কথা আজও মনের মণিকোঠায় অক্ষয় হয়ে আছে। একটা ঘটনার কথা উঠে আসে তার স্মৃতিচারণে। তিনি তখন চতুর্থ শ্রেনির ছাত্র। তাঁর লেখা মিনিট পনেরোর একটা নাটক মঞ্চস্থ করার প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে পাড়ায়। রিক্সায় মাইক বেঁধে নিয়ে গোটা আমোদপুরে সেই নাটকের প্রচার করে এসেছেন স্বয়ং অতনুবাবু।
তারপর অন্যবারের মতোই প্রথম সন্ধ্যায় নাটক পরিবেশন করে মঞ্চ ভেঙে যে যার বাড়ি চলে গিয়েছেন। ঠিক সেই সময়ই দর্শকরা হাজির হয়েছেন। কোথায় তখন মঞ্চ, কোথায় বা নাটকের কুশীলবরা। তাঁরা তো তখন ঘুমিয়ে কাদা। শেষ পর্যন্ত পরিস্থিতির সামাল দেন অতনুবাবুর মা।উপস্থিত দর্শকদের সামনে হাত জোর করে তিনি বলেন, ‘‘ও ছোটছেলে ভুল করে ফেলেছে। ওটা ছেলে ভোলানো নাটক। অনেক আগেই শেষ হয়ে গিয়েছে। প্লিজ আপনারা কিছু মনে করবেন না।’’
সেই কথা শুনে দর্শকরা হাসাহাসি করতে করতে বাড়ি ফিরে যান। সেদিনের সেই ঘটনার স্মৃতিচারণ করতে করতে আজও ভিজে যায় অতনুবাবুর চোখ। তিনি বলেন, ‘‘মা আমার সব কিছুতেই প্রেরণা যুগিয়েছেন। আমি যে সব ছোট ছোট কবিতা লিখতাম তিনি সে সব অন্যকে পড়ে শোনাতেন, আমাকে শোনাতে বলতেন। যেমন খুশি তেমনি সাজোতে নিজে হাতে সাজিয়ে দিতেন। কি ভাবে অভিনয় করতে হবে দেখিয়ে দিতেন। আবৃত্তি করা শিখিয়ে দিতেন। সেদিন তিনি পথটা দেখিয়ে দিয়েছিলেন বলেই আজও সেই পথটা অনুসরণ করে চলতে পারছি।’’
লেখালিখির মতোই অভিনয়েও স্বীকৃতি মিলেছিল ছাত্রাবস্থায়। তিনি যখন ১৫/১৬ বছর বয়সের কিশোর তখন হেতমপুর কলেজে একাঙ্ক নাটক প্রতিযোগিতায় ছাত্রদের নাট্যদল স্টুডেন্টস কয়্যার পরিবেশিত মনোজ মিত্র রচিত ‘তেঁতুলগাছ’ নাটকে শ্রেষ্ঠ অভিনেতা, শ্রেষ্ঠ নির্দেশক হিসাবে পুরস্কৃত হন তিনি। তারপর থেকে তাঁকে আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি। স্টুডেন্টস কয়্যারের পাশাপাশি নাট্যতীর্থ, বীরভূমের আনন, কলকাতা অপেরা, কাঁচড়াপাড়া ব্রাত্যজন নামে বিভিন্ন নাট্যদলে বহু নাটকে অভিনয় করেছেন বা করে চলেছেন। কলকাতার পেশাদার যাত্রাদলেও অভিনয় করেছেন। টিভি সিরিয়্যাল, রিয়েল্যাটি শো করার পাশাপাশি নামী পরিচালকদের ছবিতে অভিনয়ও করেছেন। জনপ্রিয় একটি রিয়েলিটি শোতে চ্যাম্পিয়ানও হয়েছেন। ‘জাকপট’, ‘ মউ বনে আজ ’ ‘জানলা দিয়ে বউ পালালো ’, ‘শেষ অঙ্ক ’, ‘মায়া মৃদঙ্গ’ , ‘ভাড়াটে’ ‘তদন্ত’, ‘টুসকি’, ‘আলেয়া’ প্রভৃতি তাঁর অভিনীত ছবি। অভিনয়ের পাশাপাশি আঞ্চলিক উপভাষায় স্বরচিত কবিতাও আবৃত্তি করেছেন অতনুবাবু। একসময় স্ত্রী তনুশ্রী বর্মণের সঙ্গে তার যুগ্ম গলার আঞ্চলিক ভাষার অ্যালবাম ‘পাবলুর মা ঘুমিন গেলা’ এবং ‘শোন গো যতনে’ মানুষের মুখে মুখে ফিরত। পরবর্তীকালে বাংলাদেশ সরকারের বঙ্গীয় সংস্থার আমন্ত্রণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়েও বীরভূমের উপভাষায় আবৃত্তি পরিবেশেন করে প্রশংসা অর্জন করেছেন তিনি। ‘নাটুকে ছড়া’ নামে অভিনয় জগতের সঙ্গে যুক্ত মানুষদের সুখ দুঃখ নিয়ে আননায়ুধ নামে একটি পত্রিকায় ধারাবাহিক ভাবে ছড়া লিখে চলেছেন ।
এ পর্যন্ত সেই ছড়ার সংখ্যা পাঁচ শতাধিক। ওইসব ছড়া নিয়ে প্রকাশিত ‘নাটুকে ছড়া ’ নামে একটি বইও প্রকাশিত হয়েছে। বর্তমানে শিল্পী কাকলি দাসের সঙ্গে ওইসব নাটুকে ছড়া এবং থিয়েটারের গানের যুগলবন্দীর অন্য স্বাদের অনুষ্ঠানও করে চলেছেন অতনুবাবু। কোনও আক্ষেপ, অনুতাপ বা অনুশোচনা তাঁর নেই। জীবনের কাছে তিনি কৃতজ্ঞ।
তিনি মনে করেন, জীবনে যা পেয়েছেন, যেটুকু পেয়েছেন, যা পেয়ে চলেছেন তা তাঁর জীবন ভরিয়ে দিয়েছে। বিচিত্র অভিজ্ঞতায় তার জীবনপাত্র পূর্ণ হয়ে গিয়েছে। খারাপ অভিজ্ঞতাও তাঁর প্রাপ্তি বলেই মনে করেন। তাই তিনি বলেন, ‘‘চলার পথে জীবন মাঝে মধ্যে ছন্দ হারায়। কিন্তু আমি সবেতেই আনন্দ খুঁজে পাই।’’